সংখ্যায় বেশি ভোট পেলেই কেউ প্রেসিডেন্ট হতে পারে না, ইলেক্টোরাল আসনটাই সবকিছু, সেই হিসেবেও আবার আছে প্রচুর মারপ্যাঁচ! ২০১৬'র নির্বাচনে ট্রাম্পের চেয়ে প্রায় চল্লিশ লাখ ভোট বেশি পেয়েও যেমন হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি এই সমীকরণের কারণে...

আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের আমলনামার ওপরে রায় দেবেন আমেরিকার ভোটারেরা।যদিও ষাট শতাংশ ভোটার অগ্রিম ভোট দিয়ে ফেলেছেন বলেই খবর আসছে। আমেরিকায় ব্যালট পেপার ভোটারদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়, ভোটার চাইলে বাসায় বসেই ভোট দিতে পারেন। করোনার কারনে এই সংখ্যাটা এবার বেড়েছে। কোভিড-১৯ এর পরে সম্ভবত এবছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই মার্কিন নির্বাচন, কারণ গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নির্ভর করবে এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর। রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প আরেকবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে এলে সেটা বিশ্বের ওপর একরকমের প্রভাব ফেলবে, অন্যদিকে ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেন জিতলে সেই প্রভাব হবে খানিকটা অন্যরকম। আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে খুব একটা বদল না এলেও, প্রধান দুই দলের মানসিকতা যেহেতু বেশ আলাদা, তাই কে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন, তার ওপরে অনেক কিছুই নির্ভর করে। 

আমেরিকার নির্বাচনের খোঁজ খবর নিতে গেলেই আপনি বুঝতে পারবেন, এই নির্বাচন প্রক্রিয়াটা যথেষ্ট জটিল। প্রচুর সমীকরণের মারপ্যাঁচ আছে এখানে, শুধু সংখ্যায় বেশি ভোট পেলেই কেউ প্রেসিডেন্ট হতে পারে না। বাংলাদেশে মোট সংসদীয় আসন সংখ্যা ৩০০টি, কোন রাজনৈতিক দল এর মধ্যে ১৫১টি আসন পেলেই সেই দল সরকার গঠন করতে পারে। আমেরিকায় সরকার গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দরকার হয় ২৭০টি ইলেক্টোরাল কলেজ আসন। আর এখানেই আসে গোলকধাঁধার সবচেয়ে বড় পর্বটা।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজ্যে জনসংখ্যার বিচারে নির্দিষ্ট সংখ্যক ইলেক্টোরাল ভোট রয়েছে। সব মিলিয়ে  ইলেক্টোরাল ভোটেত সংখ্যা ৫৩৮টি। বিজয়ী প্রার্থীকে অন্তত ২৭০ বা তার বেশি ইলেক্টোরাল ভোট পেতে হবে, এই হচ্ছে নিয়ম। যখন কেউ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছেন, তিনি আসলে জাতীয়ভাবে ভোট দেয়ার বদলে বরং স্থানীয় বা রাজ্যের ইলেক্টোরাল কলেজ নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন। দুইটি বাদে অন্য সবগুলো স্টেটের আইন অনুযায়ী, যে প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পাবেন, ওই স্টেটের সব ইলেক্টোরাল ভোট তার পক্ষে যাবে। যেমন, ক্যালিফোর্নিয়ায় ইলেক্টোরাল আসনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, ৫৫টি। এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি ক্যালিফোর্নিয়াতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের চেয়ে বেশি ভোট পান, তাহলে পুরো ক্যালিফোর্নিয়ার ৫৫টি ইলেক্টোরাল আসনই তার নামের পাশে যুক্ত হবে, কোন আসনে তিনি বেশি পেয়েছেন, কোথায় কম পেয়েছেন, সেটা দেখা হবে না।

ইলেক্টোরাল আসনের ফলাফলটাই মুখ্য। Photo Courtesy- BBC

অর্থাৎ, পুরো দেশের মোট ভোটারদের মধ্যে বেশি ভোট পেয়েও কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত নাও হতে পারেন, যেমনটা হতে পারেননি হিলারি ক্লিনটন। ২০১৬'র নির্বাচনে তিনি ট্রাম্পের চেয়ে প্রায় চল্লিশ লাখ ভোট বেশি পেয়েছিলেন। কিন্ত ইলেক্টোরাল আসনে তাকে পেছনে ফেলেছিলেন ট্রাম্প। ২০০০ সালের নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটেছিল, সেবার রিপাব্লিকান জর্জ ডব্লিউ বুশের কাছে হেরে গিয়েছিলেন ডেমোক্র‍্যাট প্রার্থী আল গোর।

ইলেক্টোরাল আসনের অংকে আমেরিকার সবচেয়ে বড় স্টেটগুলো হচ্ছে, ক্যালিফোর্নিয়া (৫৫), টেক্সাস (৩৮), নিউইয়র্ক (২৯), ফ্লোরিডা (২৯), ইলিনয় (২০) এবং পেনসিলভেনিয়া (২০)। এই রাজ্যগুলো দখলে নেয়ার দিকে সবার মনযোগ থাকে। কারণ বড় রাজ্য হাতে থাকা মানে ক্ষমতার খুব কাছাকাছি চলে যাওয়া। তবে তাতে করে ছোট রাজ্যগুলো যে অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তেমনটা নয়, সেগুলো বরং আরও বেশি গুরুত্ব পায়। 

রাজনৈতিক প্রভাবের ভিত্তিতে আমেরিকার স্টেটগুলোকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়, ব্লু-স্টেট, রেড স্টেট এবং সুইঙ্গিং স্টেট। ডেমোক্র্যাটদের ভোটব্যাংক যেসব রাজ্যে বেশি, যেমন ক্যালিফোর্নিয়া, ইলিনয়, এবং উত্তরপূর্ব এলাকার স্টেটগুলোকে বলা হয় 'ব্লু স্টেট' বা নীল রাজ্য। রিপাবলিকান দুর্গ বলে পরিচিত স্টেট যেমন আইডাহো, আলাস্কা, এবং দক্ষিণের অনেক রাজ্যকে বলা হয় 'রেড স্টেট' বা 'লাল রাজ্য'। আর সুইং স্টেট বা দোদুল্যমান রাজ্য হচ্ছে সেসব রাজ্য, যেগুলো প্রার্থীদের কারণে ভোট এদিকে বা ওদিকে যেতে পারে। ২০২০ সালের এরকম দোদুল্যমান স্টেট হিসাবে ধরা করা হচ্ছে অ্যারিজোনা, পেনসিলভেনিয়া এবং উইসকনসিন স্টেটকে।

দুই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বাইডেন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা, দলীয় প্রার্থী বাছাই, আবার দেশভিত্তিক প্রচারণা, মুখোমুখি বিতর্ক, মূল নির্বাচন, ফলাফল- সব মিলিয়ে প্রায় বছরখানেক সময় লেগে যায়। এজন্য দলগুলোর প্রস্তুতি শুরু হয় বেশ আগে থেকে। প্রথমে প্রার্থীকে 'প্রাইমারিস' নামের দলীয় মনোনয়নের প্রথম ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়। তবে বর্তমানে যিনি প্রেসিডেন্ট, তিনি যদি আরও একবার নির্বাচনে প্রতিদ্বদ্বিতা করার অধিকার রাখেন, তাহলে ব্যতিক্রমী কিছু না ঘটলে তিনিই সাধারণত দল থেকে অটোমেটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়ে যান। যেমন ট্রাম্প আরও একবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

প্রাইমারি জয়ের পরে একজন প্রার্থীকে নিজের দলের স্টেট লেভেলের প্রতিনিধিদের মন জয় করতে হবে, তাদের সমর্থন নিতে হবে। এই প্রতিনিধিরা দলের চূড়ান্ত সম্মেলনে তার পক্ষে ভোট দেবেন। এরপরে দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ঘোষণা করা হবে। এখানে পরিবারতন্ত্র বা স্বজনপ্রীতির কোন জায়গা নেই, যিনি যোগ্য, যিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদ সামলাতে পারবেন, সেরকম প্রার্থীকেই মনোনয়ন দেয়া হয়। এই প্রাইমারি নির্বাচন পদ্ধতি পুরোপুরিই আমেরিকান একটা ব্যবস্থা। 

দুই দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ঘোষণা করা হয়ে গেলে গোটা আমেরিকার মানুষ তাকিয়ে থাকে দ্বিপাক্ষিক বিতর্কের দিকে। এটা একটা চমৎকার সংস্কৃতি, দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন যুক্তি দিয়ে, নিজ নিজ রণকৌশলকে ওপরে রেখে ভোটারদের আকৃষ্ট করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। এই বিতর্কের দিকে পুরো বিশ্ব তাকিয়ে থাকে, মিডিয়া সর্বোচ্চ কাভারেজ দেয়, শত শত চ্যানেলে লাইভ টেলিকাস্ট করা হয় চারটা বিতর্ক। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ইস্যুতে কি পদক্ষেপ নেয়া হবে, আগের মেয়াদে কি কি ভুল ছিল, সেসব উঠে আসে এই বিতর্কে। এটা মার্কিন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে আছে। এবার দুুইটি প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্কের দুটিতেই ট্রাম্পকে ধরাশায়ী করেছেন বাইডেন।

২০১৬ নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রেসিডেন্ট বিতর্কে হিলারি ও ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রে ভোট দেয়ার পদ্ধতিটাও একটু আলদা। আঠারো বছরের ঊর্ধ্বে সবাই ভোটার, তবে এখানে ভোটের নির্দিষ্ট দিন কেবল একটাই নয়। বেশিরভাগ স্টেটে আগাম ভোটের সুযোগ দেয়া হয়। যার ফলে তালিকাভুক্ত ভোটাররা নির্বাচন দিনের আগেই তাদের ভোট দিতে পারেন। ডাকযোগে ভোট দেয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে আমেরিকায়। যারা অসুস্থতা, প্রতিবন্ধিতা, ভ্রমণ ও স্টেটের বাইরে পড়াশোনার কারণে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন না, তাদের জন্য ডাকযোগে ভোট দেয়ার সুযোগ দিয়েছে আমেরিকান সংবিধান। নির্বাচনের দিন সশরীরে হাজির হয়েও ভোট দেয়া যায়। আমেরিকার কোথাও আজ পর্যন্ত কেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতি, ব্যালট পেপার ছিনতাই বা জোর করে অন্যের ভোট দিয়ে দেয়ার কোন ঘটনা ঘটেনি। 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সবসময়েই নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। একারনে এই বছরে নির্বাচন হতে যাচ্ছে নভেম্বরের তিন তারিখ, আজ। করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে নির্বাচন পেছানোর একটা দাবী উঠেছিল, তবে এখন যথাসময়েই অনুষ্ঠিত হচ্ছে ভোট। আর এবার রেকর্ডসংখ্যক ভোটার ঘরে বসেই ডাকযোগে ভোট দিয়েছেন। গত নির্বাচনে (২০১৬) মোট প্রদত্ত ভোটের ২১% দেয়া হয়েছিল ডাকযোগে। এবার সেই সংখ্যাটা ৫০-৬০% হয়েছে। নির্বাচনের পরের দিন সকালে বুথফেরত জরিপ আসার পরেই মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কে বিজয়ী হতে যাচ্ছেন। তবে এবার তাতে ব্যতিক্রম ঘটতে পারে। 

যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর ইলেক্টোরাল ভোটের সংখ্যা ২৭০ বা এর বেশি হবে, আগামী চার বছরের জন্য তিনিই হবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, বিশ্ব রাজনীতির দণ্ডমুন্ডের কর্তা। তবে নির্বাচন নভেম্বরে হলেও, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তার দায়িত্ব বুঝে পাবেন ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে। সবগুলো জরিপ এখনও পর্যন্ত বাইডেনের জয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর ট্রাম্প যদি পুনঃনির্বাচিত হন, তাহলে এত ঝামেলার কিছু নেই, তিনিই চালিয়ে যাবেন দায়িত্ব, হয়তো মন্ত্রণালয়ে খানিকটা বদল আসবে। তবে যিনিই নির্বাচিত হন না কেন, এটা স্বীকার করতেই হবে যে, আমেরিকার মতো জটিল নির্বাচন ব্যবস্থা দুনিয়ার আর কোথাও নেই... 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা