গোটা বিশ্বকে যারা গণতন্ত্রের শিক্ষা দেয়, সেই দেশের সংসদ ভবনে যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, সেটা কেউ কল্পনাও করেনি। একটা নির্দিষ্ট দলের উগ্র সমর্থকেরা দলবেঁধে পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে পড়ে তাণ্ডব চালিয়েছেন- এমন নজির বিশ্বের সবচেয়ে কম সভ্য দেশটিতেও পাওয়া যাবে না...
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ, গোটা বিশ্বের ওপর ছড়ি ঘোরানোটা যাদের কাজ। পৃথিবীকে গণতন্ত্রের পাঠ দেয় তারা, কোথাও কারো এক বিন্দু ভুলচুক দেখলে রে রে করে তেড়ে যায়, সেই দেশটাই আজ গণতন্ত্রের গায়ে কালিমা লেপে দিলো। নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী হলো গোটা বিশ্ব। রাত জেগে যারা আমেরিকার সংসদভবন ক্যাপিটলে ঢুকে পড়া ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থকদের তান্ডব দেখেছেন, কিংবা সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনেছেন অভাবনীয় এই সংবাদ- তারা বিস্ময়ে হতভম্ভ হয়েছেন নিশ্চিতভাবেই। যতই উগ্র সমর্থক হোক না কেন, আমেরিকার মতো দেশে এরকম কিছু ঘটতে পারে- এটা বিশ্বাস করা কষ্টকর।
কী ঘটেছে- এই প্রশ্ন না করে বরং প্রশ্ন করুন কী ঘটতে বাকী রয়েছে? ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা বিক্ষোভ করতে করতে জোর করে ক্যাপিটল ভবনে ঢুকে পড়েছে, আইনপ্রণেতাদের বাধ্য করেছে সেনেটের অধিবেশন বন্ধ করে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে। বাইডেনের জয়কে স্বীকৃতি দেয়ার কথা ছিল আজ, সেই অধিবেশন পণ্ড করার জন্যেই শত শত উগ্র সমর্থক ক্যাপিটল ভবনে হামলা চালায়। নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজিত হওয়ার ফল পাল্টে দেওয়ার লক্ষ্যে এই হামলা চালানো হয়। হামলা-সংঘর্ষের ঘটনায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মুখে একপর্যায়ে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশন স্থগিত করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে পরে ফের শুরু হয় অধিবেশন।
সিএনএন বলছে, ক্যাপিটল ভবন ঘিরে হামলা-সংঘাত-সংঘর্ষ চলাকালে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন, এরমধ্যে একজনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। নিহত সেই নারী মার্কিন বিমানবাহিনীর সাবেক এক কর্মকর্তা, ছিলেন, সান দিয়াগোর বাসিন্দা ওই নারীর নাম অ্যাশলি ব্যাবিট। ওই নারী ক্যাপিটল ভবনের ভেতরেই নিহত হন। পরিস্থিতি সামাল দিয়ে শহরজুড়ে সান্ধ্যকালীন কারফিউ জারী করেছেন ওয়াশিংটন ডিসির মেয়র। ওয়াশিংটন ডিসি পুলিশ জানিয়েছে, তারা ৫২ জনের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্য ৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কারফিউ ভঙ্গের অভিযোগে।
বুধবার ক্যাপিটলে যৌথ সভা বসেছিল। কংগ্রেস এবং সেনেটের সদস্যরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এদিনই জো বাইডেনের জয়লাভকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়ার কথা ছিল। অধিবেশনে প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনাও শুরু হয়েছিল। সেখানে কয়েকজন রিপাবলিকান সিনেটর ট্রাম্পের বক্তব্যকে সমর্থন জানাচ্ছিলেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স প্রথমে যৌথ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। বাইডেনের জয়ের বিষয়ে আলোচনা প্রস্তাব আনেন। তখনই কয়েকজন রিপাবলিকান সদস্য অ্যারিজোনায় বাইডেনের জয় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। পেন্স অবশ্য তা গুরুত্ব দেননি। পরে তাদের প্রস্তাব ভোটে খারিজ হয়ে যায়।
সংসদের ভিতরে যখন এসব চলছে, ক্যাপিটল ভবনের বাইরে তখন ধীরে ধীরে জড়ো হচ্ছিলেন ট্রাম্প সমর্থকরা। ট্রাম্পের হার তারা মেনে নেবেন না বলে স্লোগান দিতে থাকেন। বেশ কিছুক্ষণ তা চলার পরে ক্রমশ ক্যাপিটল ভবনের দিকে এগোতে থাকেন তারা, ভেঙে দেন ব্যারিকেড। পুলিশ তাঁদের আটকানোর চেষ্টা করলেও সফল হয়নি, সংখ্যায় তারা ছিল বেশি। মারমুখী ওই সমর্থকেরা ক্যাপিটল ভবনের ভিতরে ঢুকে পড়েন। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস এবং পেপার স্প্রে ছুঁড়তে থাকে, কিন্ত তাতেও লাভ হয়নি, ঠেকানো যায়নি এই উগ্রপন্থী সমর্থকদের। খানিক পরেই ঘটনাস্থলে পৌঁছায় রায়ট পুলিশ। তারা বিক্ষোভকারীদের ঠেকাতে বাধ্য হয়েই গুলি ছোড়ে।
গুলিতে অ্যাশলি ব্যাবিট নামের সেই নারী লুটিয়ে পড়েন। তিনি কট্টর ট্রাম্প সমর্থক ছিলেন। তার কাঁধে গুলি লেগেছিল। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, পরে সেখানে তার মৃত্যু হয়। কিছু সংবাদ সংস্থা ব্যাবিট ছাড়াও আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবী করেছে, যদিও তাদের পরিচয় বা তারা আদৌ মারা গেছেন নাকি আহত হয়েছেন, সেটা নিশ্চিত করে জানা যায়নি। ওয়াশিংটনের মেয়র স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ছয়টা থেকে কারফিউ জারি করেছেন। তবে এরপরেও আইন অমান্য করে যত্রতত্র বিক্ষোভকারীদের ঘুরতে দেখা গেছে। মার্কিন কংগ্রেসের অধিবেশন অবশ্য বন্ধ করা হয়নি। গভীর রাত পর্যন্ত অধিবেশন চলেছে। আগামী ১৫ দিনের জন্য ওয়াশিংটনে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে।
হামলার ঘটনার পর পুলিশ ক্যাপিটল ভবন থেকে আইনপ্রণেতাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়। ক্যাপিটল ভবন থেকে ট্রাম্প-সমর্থকদের হটিয়ে দিতে পুলিশকে অন্তত তিন ঘণ্টা ধরে চেষ্টা চালাতে হয়। এসময় ট্রাম্প-সমর্থকেরা পুলিশের ওপরও হামলা করে। ভবনের ভেতর থেকে হামলাকারীদের সরিয়ে দিতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোঁড়ে। স্থানীয় সময় গতকাল বুধবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ক্যাপিটল ভবনকে নিরাপদ ঘোষণা করে পুলিশ। পরে আইনপ্রণেতারা আবার অধিবেশনকক্ষে ফিরে আসেন, পুনরায় শুরু হয় যৌথ অধিবেশন।
কংগ্রেস ভবনে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার ঘটনায় গতকাল এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ নিয়েছে ফেসবুক ও টুইটার। ওই দাঙ্গার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দুটির কর্তৃপক্ষ ট্রাম্পের ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। ফেসবুকের কর্তৃপক্ষ তাদের এই প্ল্যাটফর্মে ট্রাম্পকে পোস্ট করা থেকে ২৪ ঘণ্টার জন্য আটকে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, এর আগে দাঙ্গায় অংশগ্রহণকারী সমর্থকদের পাঠানো ট্রাম্পের একটি ভিডিও অপসারণ করেছে তারা। সেই ভিডিওতে ট্রাম্প তার সমর্থকদের বাড়ি ফিরে যেতে বললেও নিজের বক্তব্যে আবারো নির্বাচনে কারচুপির অসত্য অভিযোগ তুলেছেন। ফেসবুক বলেছে, ট্রাম্পের এমন বক্তব্য সহিংসতাকে আরও উস্কে দিতে পারে। ফেসবুকের মালিকানাধীন ইনস্টাগ্রামেও ট্রাম্প ২৪ ঘণ্টার জন্য নিষিদ্ধ থাকবেন।
টুইটার কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট ১২ ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। এটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারেও প্রথমবারের মতো সতর্ক করে দিয়েছে তারা। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, অ্যাকাউন্ট সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়ে তারা এটাই বুঝিয়েছে যে ট্রাম্প টুইটারের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করেছেন। ট্রাম্পের আজকের ভিডিও সরিয়ে নিয়ে ইউটিউব জানিয়েছে যে তারা ভিডিওটি সরিয়ে নিয়েছে কারণ সেটি ‘নির্বাচনে কারচুপি সংক্রান্ত তথ্য ছড়ানোর নীতি’ ভঙ্গ করেছে। নির্বাচনের ফল সামনে আসার পর থেকেই ট্রাম্প পরাজয় মেনে না নিয়ে বরং বিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছিলেন, আর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে।
গোটা বিশ্বকে যারা গণতন্ত্রের শিক্ষা দেয়, সেই দেশের সংসদ ভবনে যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, সেটা কেউ কল্পনাও করেনি হয়তো। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে সংসদ ভবনে হাতাহাতি, ধস্তাধস্তি বা চেয়ার ছুঁড়ে মারার ঘটনা আগেও ঘটেছে, আহত-নিহত হবার খবরও এসেছে। কিন্ত একটা নির্দিষ্ট দলের উগ্র সমর্থকেরা দলবেঁধে পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে পড়ে তাণ্ডব চালিয়েছেন- এমন নজির বিশ্বের সবচেয়ে কম সভ্য দেশটিতেও পাওয়া যাবে না। সেই নজিরই স্থাপিত হলো আমেরিকার বুকে। একটা বর্ণবাদী, হুজুগে মেতে থাকা রগচটা উন্মাদকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করলে কি খেসারতটা দিতে হয়, সেটা আমেরিকার মানুষ আজ নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে...