'ইউরেনিয়াম ভর্তি ব্যাগ', সংবাদমাধ্যমের ভুল ও প্রতারকদের শুভঙ্করের ফাঁকি
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
রামপুরা থেকে ইউরেনিয়াম ভর্তি ব্যাগ উদ্ধার হয়েছে বলে খবর প্রকাশ করেছে অনেক গণমাধ্যম, যে ইউরেনিয়াম দিয়ে নিউক্লিয়ার বোমা বানানো যায়, বিদ্যুৎ বানানো যায়- সেই তেজস্ক্রিয় ধাতু ব্যাগের ভেতরে কেন? ঘটনাটা আসলে কী ঘটেছে?
রামপুরা থেকে ইউরেনিয়াম ভর্তি একটা ব্যাগ র্যাব উদ্ধার করেছে বলে কয়েকটি পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। মূলত, র্যাব এর পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি কেই তারা কোট করেছে।
আমার এনালাইসিস অনুযায়ী, এখানে কোনো ইউরেনিয়াম নাই। প্রতারকরা ইউরেনিয়াম এর কথা বলে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে এই জিনিস বিক্রির চেষ্টা করত। র্যাব তাদের মুখের শোনা কথায় বিশ্বাস করে এটাকে 'ইউরেনিয়াম' বলে সাংবাদিকদের কে জানিয়েছে। পত্রিকাতেও এটাই ছাপা হয়েছে।
আমরা হয়ত জানি, ইউরেনিয়াম একটি তেজস্ক্রিয় ধাতু। এটাকে পোড়ালে প্রচুর শক্তি পাওয়া যায়। এটা দিয়ে নিউক্লিয়ার বোমা বানানো যায়, বিদ্যুৎ বানানো যায় (পাবনার রূপপুরের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট এর মতো)। তবে এটা অনেক বিপজ্জনক। পরিবেশে তেজষ্ক্রিয়তা ছড়ায়।
রামপুরের উদ্ধার করা বস্তুটাকে কেন ইউরেনিয়াম বলে মনে হচ্ছে না, তার সপক্ষে কিছু যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টা করছি।
১. ভ্যাট ট্যাক্স ফাকি দেয়ার জন্য বা বিভিন্ন কারনে অনেকে চিনির গায়ে লবন লিখে রাখেন। সোনার গায়ে ইমিটেশন লিখে রাখেন, রুপার গায়ে এলুমিনিয়াম লেখেন। কিন্তু এই ব্যাগের গায়ে লেখা ছিল, ইউরেনিয়াম!!! (URANIUM ATOMIC ENERGY METALIC ELEMENT ATOMIC WEIGHT 222.07 (A) 2L.B LABPROS)
এ ধরনের সেন্সেটিভ পণ্যের ক্ষেত্রে কোনো কোড নাম ব্যবহার করাই বেশি সমীচীন ছিল। রসায়নে ইউরেনিয়ামকে সাংকেতিকভাবে U-235 বা U-238 লেখার চল রয়েছে।
২. ইউরেনিয়াম একটি তেজষ্ক্রিয় মৌল। এর অনেকগুলা আইসোটোপ আছে। সবচেয়ে স্টেবল (স্থায়ী) দুইটা আইসোটপ এর এ্যাটমিক ওয়েট ২৩৫ এবং ২৩৮, ২২২ নয় কোনোভাবেই। ২২২ এটমিক ওয়েট (আনবিক ভর) রয়েছে রেডন নামের আরেকটি মৌলের। সেটা স্থির (স্টেবল) কোনো পরমাণু না। হাফ লাইফ (অর্ধায়ু) মাত্র ৪ দিন। বোঝানোর সুবিধার জন্য বলি, ধরুন, আজকে ১ কেজি রেডন-২২২ কিনলে, ৪ দিন পরে সেটা আধা কেজি হয়ে যাবে, ৮ দিন পরে ২৫০ গ্রাম হয়ে যাবে, ১৬ দিন পরে ১২৫ গ্রাম... এইভাবে কমতে থাকবে। পুরাই লস প্রজেক্ট। এই মৌল নিয়ে ব্যবসা করতে চাইবে না কেউ।
ইউরেনিয়াম এর হাফ লাইফ অনেক বেশি। U-235 এর হাফ লাইফ ৭০৪ মিলিয়ন বছর। U-238 এর হাফ লাইফ ৪.৪৭ বিলিয়ন বছর। ওগুলা নিয়ে ব্যবসা করলে লাভ আছে। সহজে ওরা ক্ষয় হয়ে যাবে না। ২২২.০৭ এটমিক ওয়েট ওয়ালা কোনো মৌল পাওয়া না গেলেও, একটা যৌগ পাওয়া গেল। C7H11I. ( 4- iodo methylcyclohexane) এটা জৈব যৌগ। তেজষ্ক্রিয় নয় মোটেই।
৩. তেজষ্ক্রিয় পদার্থ থেকে প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর রেডিয়েশন (আলফা রশ্মি, বিটা রশ্মি, গামা রশ্মি) বের হয়। এজন্য তেজষ্ক্রিয় পদার্থকে খুব ভালভাবে শীসা বা অন্য কোনো ভারী ঘন ধাতুর কন্টেইনারে রেখে সংরক্ষন করা হয়। পাতলা চামড়ার ব্যাগ বা প্লাস্টিক বা অন্য কোনো জায়গায় এটা রাখা হলে সেই ব্যাগ রেডিয়েশন ঠেকাতে পারবে না।
যদি রামপুরার ওই চামড়ার ব্যাগের মধ্যে আসলেই ইউরেনিয়াম থাকত, তাহলে তার রেডিয়েশনের প্রভাবে ৩ পাচারকারী, আটককারী র্যাব সহ আশেপাশের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তাদের শরীরে রেডিয়েশন জনিত রোগ দেখা দিত।
২০১০ সালে দিল্লী ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রি ল্যাবের পুরনো কিছু যন্ত্রপাতি বিক্রি করা হয়েছিল এক লোহা লক্কড়ের ভাংগারির দোকানে। ওই যন্ত্রপাতির মধ্যে কয়েকটা রেডিও এক্টিভ ছিল। যে সকল ভাংগারির দোকানদার ওই যন্ত্রপাতির সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের অনেকেই তখন অসূস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মোট ১১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, এক জন মারা গিয়েছিলেন। (টিভি সিরিয়াল স্যাক্রেড গেমস এ অনিরাপদ অবস্থায় তেজষ্ক্রিয় পদার্থ পরিবহন, এবং পাচারকারীদের অসূস্থতা দেখানো হয়েছে)
৪. যে কোনো পদার্থ তেজষ্ক্রিয় (রেডিও এক্টিভ) কিনা সেটা চেক করার জন্য অনেক মেশিন আছে (যেমন- গাইগার মুলার কাউন্টার)। সন্দেহজনক জায়গায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা সেই গাইগার মুলার কাউন্টার দিয়ে দিয়ে চেক করে, এখানে রেডিও এক্টিভিটি কি নরমাল আছে, নাকি বেশি পরিমানে আছে?
রামপুরার এই ব্যাগ কে কি গাইগার মুলার কাউন্টার দিয়ে চেক করা হয়েছে? রেডিয়েশন কত বেকেরেল দেখিয়েছে ? র্যাব সেটা জানায়নি। সম্ভবত চেক করা হয়নি। র্যাবের কাছে এই মেশিন আছে কিনা, সেটাও প্রশ্ন।
সম্ভবত "প্রতারক"দের কথা শুনেই র্যাব এটাকে ইউরেনিয়াম বলে দাবি করছে। নিজেরা ভেরিফাই করেনি।
৫. র্যাব যা যা উদ্ধার করেছে তা হল- একটি চামড়ার বাক্স, একটি ছোট চামড়া ও স্টিলের বক্স, একটি রিমোট, একটি ম্যানুয়েল বই, একটি গ্যাস মাস্ক, একটি ইলেটকট্রিক মিটার, একটি রাবারের ড্রপার, একটি স্টিলের ঢাকনাযুক্ত কাঁচের পট, পাঁচটি কাঁচের তৈরি ছোট চিকন পাইপ, একটি কাঁচি, একটি মিটার, একটি কালো কম্পাস, দুটি পাইপ, একটি মেটাল ছাঁকনি, একটি ক্যাটালগ, একটি জোড়া হ্যান্ড গ্লাভস, একটি চামড়ার জ্যাকেট (গ্রাউন)।
এসব পাইপ, রবার, কাচি, কম্পাস এর সাথে ইউরেনিয়াম এর কোনো সম্পর্ক জানা নাই। এসব কুটির শিল্পের যন্ত্রপাতি দিয়ে ইউরেনিয়াম কে হামান দিস্তায় গুড়া করে বোমা বানানো যায় না।(টিভি সিরিয়াল 'চেরনোবিল' এ নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট এর অনেক যন্ত্রপাতি, কার্যপ্রণালী দেখানো হয়েছে। আগ্রহী হলে দেখতে পারেন।)
৬. ২০১৪ সালে একইভাবে ১১ জন প্রতারক কে পুলিশ এ্যারেস্ট করেছিল। তারা কথিত ইউরেনিয়াম বিক্রির চেষ্টা করছিল। সেই সময় সংবাদ সম্মেলনে ডিবির উপকমিশনার (দক্ষিণ) কৃষ্ণপদ রায় বলেছিলেন- ওই কথিত ইউরেনিয়ামের ব্যাগের সঙ্গে থাকা ক্যাটালগে ইউরেনিয়াম ইটমিক ওয়েট-২২২.০৭ (এ) লেখা রয়েছে।
আসামিরা দাবি করেছেন, এর ওজন প্রায় দুই পাউন্ড, যার বাজারমূল্য ৫০ কোটি টাকা। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা ধনীদের কাছে গিয়ে ইউরেনিয়ামের আন্তর্জাতিক চাহিদা সম্পর্কে ধারণা দিয়ে লোভে ফেলার চেষ্টা করতেন। লাখ টাকা বিনিয়োগ করে কোটি টাকা মিলবে বলেও লোভ দেখাতেন তাঁরা। বিভিন্ন বিদেশি গবেষণাগার এগুলো কিনতে সদা প্রস্তুত বলে তারা ওই ব্যক্তিদের ইউরেনিয়ামে বিনিয়োগ করতে আকৃষ্ট করেন। তারা প্রাথমিকভাবে সম্ভাব্য ক্রেতাকে একটি ভিডিও দেখান। ক্রেতার ৫০ লাখ টাকা আছে নিশ্চিত হলে তারা ইউরেনিয়ামের সুদৃশ্য চামড়ার ব্যাগটি দেখান। আর বাক্সটির সঙ্গে থাকা যন্ত্রপাতি ও রাশিয়ান ও ইংরেজি ভাষার ক্যাটালগ দেখে অনেকে বিনিয়োগে আগ্রহী হন। এভাবে কয়েকজন ক্রেতা কিছু টাকা বিনিয়োগ করার পর গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।
বিভিন্ন সময় প্রতারকেরা ‘ব্রিটিশ আমলের সীমানা পিলারে ইউরেনিয়াম’ আছে বলে গুজব তৈরি করে তা সংগ্রহ ও বিক্রির নামে প্রতারণা করেছে। এই চক্রটিও একই প্রক্রিয়ায় কয়েকজনকে ইতিমধ্যে প্রতারিত করেছে।'"
সামারি- ২০১৪ এর প্রতারক চক্রই, বা তাদের ভাবশিষ্যরা নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে এই "নকল ইউরেনিয়াম" বিক্রির চেষ্টা করছে। এখানে বিপদের কিছু নাই, ভয়ের কিছু নাই। ওদের ব্যাগ থেকে রেডিয়েশন বের হচ্ছেনা।
বাংলাদেশে এটা নতুন কিছু না। বিভিন্ন প্রতারক চক্র সীমানা পিলার, তক্ষক, ম্যাগনেট, বজ্রপাতে মৃত ডেডবডির হাড়, জিনের বাদশার, আলাউদ্দিনের চেরাগ সহ অনেক আজাইরা জিনিসকে বহুমূল্য বানিয়ে ব্যবসা করে। অনেক তাদের কথা বিশ্বাস করে ধরাও খায়। ইউরেনিয়াম বিক্রির ব্যবসাটা তাদের লেটেস্ট সংযোজন বলে মনে হচ্ছে।
(লেখক -মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার)
রেফারেন্স- (অনেক মজার মজার নিউজ লিংক আছে। পড়ে দেখেন,মজা পাবেন)
অন্যান্য পত্রিকার নিউজ
২০১৪ সালের নিউজ লিংক
- প্রথম আলো
- বিডিনিউজ২৪ কম
- দিল্লী ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রি ল্যাবের রেডিয়েশনের খবর
- আলাউদ্দিনের চেরাগ বিক্রির খবর
- ম্যাগনেটিক রাইস কয়েন বিক্রির খবর
- নাসার বিজ্ঞানীর রাইস পুলার বিক্রির খবর
- তক্ষক বিক্রির খবর
- জ্বিনের বাদশার গুপ্তধন বিক্রির খবর
- ম্যাগনেটিক পিলার বিক্রির খবর
- বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তির হাড় বিক্রির খবর
- তেজষ্ক্রিয় কয়েন বিক্রি নিয়ে তালাশের প্রতিবেদন
- ইউরেনিয়াম এর উইকিপিডিয়া পেজ