শাই রিশেফ নামের একজন ইসরাইলি-আমেরিকান শিক্ষা-উদ্যোক্তা ভাবলেন, একটা অনলাইন বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে হবে। যেখানে শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী সবাই ঘরে বসেই অংশগ্রহণ করতে পারবে। ঘরই হবে ক্যাম্পাস, ল্যাপটপ ক্লাসরুম, ইন্টারনেট হবে চোখ। খুলে ফেললেন- ইউনিভার্সিটি অব দ্য পিপল...
আমাদের হাতে যে মুঠোফোন বা টেবিলের উপরে যে ল্যাপটপ, তাতে অধিকাংশ মানুষজন দুটি কাজই বেশি করেন, হয় সিনেমা-সিরিজ দেখেন অথবা ফেসবুক স্ক্রল করেন। অথচ এই যে মুঠোফোন বা ল্যাপটপ এগুলো দিয়ে অনেকরকম অসাধ্যসাধনই করা যায় নানাভাবে। ঠিক এটুকু পড়েই অনেকে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছেন। ভাবছেন, জ্ঞানের কথা বলতে এসেছি। মোটেও না। এমনিতেই দেশে মহামারী। সবার মাথার ওপরে অদৃশ্য এক পেন্ডুলাম ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, নট নড়নচড়ন হয়ে। কেউই মাথায় ভারী জিনিস, জ্ঞানগম্যির কথাবার্তা নিতে পারছেনা। সেরকম অবস্থায় এসে কারো মাথার উপর চাপ বাড়ানোর কোনো ইচ্ছেই আমার নেই।
যেটা বলছিলাম, ইন্টারনেট ব্যবহার করে ভালো কাজ তো অনেক হচ্ছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপে এই বদ্ধ সময়ে এসে মানুষ অনেক বেশি ইন্টারনেট-নির্ভরও হয়ে যাচ্ছেন। এ্যাপের মাধ্যমে খাবার আসছে। অনলাইনে কোর্স, সভা, সেমিনার, আড্ডার হিড়িক বাড়ছে। তাই এ সময়ে এসে আমি যে বিষয়টি নিয়ে লিখছি, সেটা মানুষের কাছে হয়তো খুব অত্যাশ্চর্য কিছু মনে হবেনা। তাও বলি।
২০০৯ সালের দিকে শাই রিশেফ নামের একজন ইসরাইলি-আমেরিকান শিক্ষা-উদ্যোক্তা ভাবলেন, একটা অনলাইন বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে হবে। যেখানে শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী সবাই ঘরে বসেই অংশগ্রহণ করতে পারবে শিক্ষা কার্যক্রমে। ঘরই হবে ক্যাম্পাস, ল্যাপটপ ক্লাসরুম, ইন্টারনেট হবে চোখ। খুলে ফেললেন- ইউনিভার্সিটি অব দ্য পিপল। যদিও এটা অমন কোনো "আউট অব দ্য বক্স" কনসেপ্ট না। কারণ এরকম অনলাইন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এডুকেশনাল একাডেমি অজস্র আছে। এখন হয়তো এমন মানুষকে খুঁজে পাওয়াই দায় হবে, যে জীবনে নিদেনপক্ষে একটিও অনলাইন কোর্স করেননি। কিন্তু যে বিষয়টি এই ইউনিভার্সিটি অব দ্য পিপল'কে আলাদা করেছে সবার চেয়ে, তা হলো, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি পুর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের কোর্সগুলো যেভাবে রেগুলেট করা হয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়েও সেভাবেই নিয়ন্ত্রিত হয় সব। কোর্স শেষ করার পরে ডিগ্রি দেয়া হয়। যে ডিগ্রি ব্যবহার করা যায় সবখানে।
অনার্স, মাস্টার্স দুইটিরই অপশন আছে এখানে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং যে বিষয়টি অন্যান্য অনলাইন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থক্য করে দেয়, তা হলো, এখানে পড়াশোনা করা যাবে সম্পূর্ণ ফ্রি'তে। এক্সামের আগে একটা ফি দিতে হয়। যেটাও সাকুল্যে ১০০ ডলারের বেশি না। অনেকেই এতটুকু পড়ে পিছিয়ে যাবে। একশো ডলার কী কম টাকা? না, আমাদের জন্যে এ টাকা হয়তো অনেক। এ কারণেই যদি কেউ এই টাকাটুকুও না দিতে চান, তাও তিনি পারবেন এখানে পড়াশোনা করতে৷ বিনামূল্যেই পড়াশোনা করবেন। অর্থাৎ টাকার কারণে থেমে থাকবেনা পড়াশোনা।
"দ্য এডুকেশন রেভ্যুলিউশন"কে ট্যাগলাইম বানিয়ে এগিয়ে চলা এ ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে টাকাপয়সা না লাগার কারণ, এই বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে না লেগেছে ইটকাঠ, না লেগেছে জমি। এখানের শিক্ষকেরাও স্বেচ্ছায় এসে পড়ান। তাই বলে ভাববেন না, হয়তো দক্ষ মানুষেরা নেই এখানে। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড সহ বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় ৭০০০ জন শিক্ষক আছেন এখানে, বিভিন্ন বিষয়ে কোর্স নেয়ার জন্যে। বইপত্রও লাগছেনা আলাদা করে। অনলাইনেই রাখা হচ্ছে সব। যেহেতু খুব বেশি খরচ হচ্ছেনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের, শিক্ষার্থীরাও তাই পড়াশোনা করতে পারছেন ফ্রি'তে!
বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসংখ্যা ৩৭০০০ এর মতন। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় ২০০টি দেশের ছেলেমেয়ে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। মজার বিষয় হচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়েও আছে হোম ওয়ার্ক, ক্লাস টেস্ট, এসাইনমেন্ট, স্যারের পানিশমেন্ট ! অনলাইন বলেই যে স্যারের বকাঝকা থেকে পার পাওয়া যাবে, বিষয়টি সেরকম নয় মোটেও।
ইউনেস্কোর এক জরিপে উঠে এসেছিলো, ২০২৫ সাল নাগাদ পৃথিবীর একশো মিলিয়ন মানুষ উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। এর কারণ এই নয় যে, টাকাপয়সা বা মেধার অভাব। কারণ একটাই, শিক্ষার্থীদের সংখ্যার তুলনায় ক্লাসরুম থাকবেনা। পর্যাপ্ত জায়গা থাকবেনা। সেই চিন্তা থেকেই "একশো মিলিয়ন" শিক্ষার্থীকে যুক্ত করার জন্যেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে কম খরচের এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মাথায় আসে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট "শাই রিসেফ" এর।
একটা বিশেষ কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আরেকটু স্বকীয়। বিভিন্ন দেশের শরণার্থীদের জন্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে আলাদা বৃত্তি। শরণার্থী মানুষগুলো যখন দেশ হারিয়ে, সীমান্ত হারিয়ে, পরিবার হারিয়ে কোনঠাসা ক্রমশ, যাদের সব অধিকার যখন নিয়মিতই বিলুপ্ত হচ্ছে ধাপে ধাপে, তারাও যাতে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হন, সেজন্যেই এই অসাধারণ উদ্যোগ।
"শিক্ষা" এমনিতেই এখন পরিণত হয়েছে ব্যবসাতে। অধিকার থেকে আস্তে আস্তে "সুযোগ" এর দিকে যাচ্ছে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। সেরকম এক পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে কোনো টাকাপয়সা ছাড়াই আমেরিকান লেভেলের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছেলেমেয়েকে "দক্ষ" করতে চাইছেন এক ব্যক্তি। "মানবকল্যানে বিজ্ঞান" রচনা ছোটবেলায় তিনি নিশ্চয়ই পড়েননি। কিন্তু নিজেই বিজ্ঞানকে ব্যবহার করছেন মানুষের কল্যানে। সেখানেই শাই রিসেফ এবং তাঁর বিনাপয়সার "ইউনিভার্সিটি অব দ্য পিপল" সার্থক।
যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতিগত, সংস্কৃতিগত, চামড়াগত, অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব নেই মোটেও। যেখানে সবাই সমান। উদ্দেশ্য একটাই- আলোকিত মানুষ হওয়া।