এই প্রজন্মকে যদি প্রশ্ন করা হয় আপনি কি সুখী? আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি ১০০ জনের মধ্যে ৯৮ জন বলবে তারা সুখী না! কিন্তু কেন?
প্রযুক্তি নির্ভর পৃথিবীতে এখন সব কিছুই হাতের মুঠোয় মেলে। পিঙ্ক ফ্লয়েড এর গান শুনতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয় না, ক্যাপ্রিও এই মুহূর্তে কোথায় সেটা জানতে একটা ক্লিকই যথেষ্ট। লি মিন হো কে চাইলেই মেসেজ করতে পারেন। এর থেকে মজার বিষয় ঘরে বসে পৃথিবীর যে কোন যায়গা দেখে ফেলা যায়। হাজার হাজার মাইল দূরে এক সেকেন্ডে মেইল করে ফেলা যায়।
সব কিছু কত সহজ, অথচ এই প্রজন্মকে যদি প্রশ্ন করা হয় আপনি কি সুখী? আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি ১০০ জনের মধ্যে ৯৮ জন বলবে তারা সুখী না! কিন্তু কেন?
ইংরেজী ভাষায় মিলেনিয়ালস প্রজন্ম বলে একটা টার্ম আছে, যার মানে হল ১৯৮৪ সালের পরে যাদের জন্ম তাদেরকে এই মিলেনিয়ালস প্রজন্ম বলা হয়। প্রশ্ন হল কেন তাদেরকে একটা নির্দিষ্ট গ্রুপ বা ছকে ফেলা হচ্ছে?
উত্তরটা দিতে হলে সাইমন সিনেক এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ কৌশল বিষয়ের অধ্যাপক এই ব্রিটিশ লেখকের নাম অনেকেই জানেন। মিনেলিয়ালস গ্রুপ নিয়ে সাইমন সিনেক এর চমৎকার একটা স্পীচ আছে। সাইমন বলেছেন- মিলেনিয়ালস প্রজন্মটা একটা ফেইক পৃথিবীতে বাস করছে। এখানে ভার্চুয়াল জীবনে সবাই সবাইকে সুখি দেখাচ্ছে। ইন্সটাগ্রাম, ফেইসবুক সহ সোশ্যাল মিডিয়াগুলো দেখলে মনে হয় কারও জীবনে কোন কষ্ট নেই, কোন দুঃখ নেই, আর দুঃখ যা আছে সেটাও দুঃখের এক ধরনের সুখি বিজ্ঞাপন। অথচ বাস্তবতা মোটেও তা না, বাস্তবতা কঠিন এবং প্রচণ্ড প্রতিকূল।
সাইমন এর সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। ফটোশপের মাউন্ট এভারেস্ট জয়টা হল ভার্চুয়াল আর বাস্তবে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করতে বহু দিনের শ্রম, ধৈর্য এবং সময়ের প্রয়োজন হয়। প্রযুক্তি কিছু বিষয় সহজ করে দিলেও সম্পর্ক, ভালবাসা , আর পেশাগত অগ্রগতি অর্জন মোটেও অ্যাপস নির্ভর না। এসবের জন্য কোন অ্যাপ নেই যে ক্লিক করেই অর্জন করা যাবে। যেহেতু এই প্রজন্ম সব কিছু সহজে পেয়ে অভ্যস্ত তাই তারা সম্পর্ক, ভালবাসা , আর প্রেশাগত অগ্রগতিও সহজেই পেতে চায়। আর যখন পায় না, তখনি হতাশ হয়, রেগে যায়, জীবনের প্রতি ভালবাসা হারায় ।
যে কোন সম্পর্ক এক দিনে তৈরি হয় না। এই কারণে স্কুলের দশ বছরের বন্ধুদের মতো বন্ধু , প্রাইভেট ভার্সিটির এক সেমিস্টারের বন্ধুরা কখনো হয় না। একটা লাইকের বন্ধুত্ব একটা ডিজলাইকে ভেঙ্গে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়া দম্পতিদের সুন্দর সুন্দর ছবি দেখে তাদের বিবাহিত জীবন সুখি মনে হলেও তাদের সুখি জীবনের পথটা মোটেও দু চার হাজার লাইকে নির্ধারিত হয় না। দুটো মানুষের অসংখ্য প্রতিকুলতা পেরিয়ে সম্পর্কের স্থায়িত্ব কিংবা সুখ অর্জিত হয়। সেটা প্রেম, বন্ধুত্ব কিংবা যে কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
কেন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এত হতাশা? কেন সম্পর্কের ভিত্তি এত নড়বড়ে ? কারণ এক সাথে আড্ডা দিচ্ছে অথচ দুজনার চোখ মোবাইলের দিকে। আগে যেখানে এক সাথে হাসত, এক সাথে বসে কোন প্রোগ্রাম দেখত এখন সেখানে বিজি ভার্চুয়াল এ কে কত লাভ পেল, কে কত লাইক পেল, কার কমেন্টে কী হল সেসব নিয়ে। তাহলে সম্পর্কটা কিভাবে গড়ে উঠবে? সম্পর্ক একটা দীর্ঘ সময়ের প্রক্রিয়া , সেখানে বিশ্বাস, আস্থা, ভাল লাগা, ভালবাসা নামক অনুভুতিগুলো এক দিনে এক মাসে তৈরি হয় না, সে জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই সময়টা কেউ কাউকে দিচ্ছে কোথায়? দুটো মানুষ আড্ডা দিচ্ছে কিন্তু চোখ আর মন পরে থাকে ফেইসবুক ওয়ালে, সেখানে আন্তরিকতা তৈরি হবে কি করে?
গত দশ বছরের আমাদের দেশে কতজন লেখক, কত জন গায়ক, কত জন চিত্রশিল্প তৈরি হয়েছে ? একটা ব্লগার প্রজন্ম গড়ে উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা হারিয়ে গেছে এখন সবাই ভাইরাল স্ট্যাটাস লেখক হচ্ছে। এতে করে কোন লেখা যত দ্রুত ভাইরাল হচ্ছে তত দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন আইডিয়া কোন অ্যাপ না যে ক্লিক করলেই বের হবে , নতুন আইডিয়ার জন্য জন্য ভাবতে হয়। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কিংবা চায়ের দোকানের আড্ডায় কিংবা কোন একটা বই পড়তে পড়তে হঠাৎ করে নতুন কোন আইডিয়ার জন্ম হয়। সেই মুহূর্তগুলো নিয়ে নিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। তাহলে আইডিয়া কোথা থেকে আসবে?
শেষ করি নিজের কথা বলে, আমি মাঝে মাঝেই সোশ্যাল মিডিয়া থেকে একেবারেই দূরে চলে যাই। সেই কয়দিন বই পড়ি, ছবি তুলি, পাহাড় পর্বত চষে বেড়াই , বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই , এবং এর চেয়ে ভাল বিষয় হল আমার সেল ফোনটাকে তখন আমার বন্ধুদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। বিষয়টা অসাধারণ!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন