উমা অধিকারী: করোনার ভয় অগ্রাহ্য করে অন্যের সন্তানের জীবন বাঁচিয়েছেন যে মা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সদ্যপ্রসূত বাচ্চাটা ক্ষুধার যন্ত্রণায় কেঁদে চলেছে পাঁচ ঘন্টা ধরে, তার মা তখনও অচেতন। অন্য প্রসূতিরা কেউ বুকের দুধ দিতে রাজী হচ্ছেন না করোনার ভয়ে। তখন ছুটে এলেন হাসপাতালের নার্স উমা অধিকারী...
গর্ভধারিণী মায়ের সি সেকশন করে সন্তানের জন্ম দেয়া হয়েছে। মায়ের অবস্থা তখনও ক্রিটিক্যাল, অচেতন হয়ে পড়ে আছেন তিনি। এদিকে সদ্যপ্রসূত বাচ্চাটি কাঁদছে ক্ষুধার যন্ত্রণায়। সে তো আর পারিপার্শ্বিকতা বোঝে না। এরকম পরিস্থিতিতে অন্য কোন প্রসূতি মায়েদের দুধ খাওয়ানো হয় শিশুকে। কিন্ত করোনাকালে সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা মায়েদের কেউই বাচ্চাটিকে নিজের দুধ খাওয়াতে রাজী হচ্ছিলেন না। একটানা কয়েক ঘন্টা কেঁদে যখন দুর্বল হয়ে পড়েছে শিশুটি, তখন খবর পেয়ে ছুটে এলেন সেই হাসপাতালেরই এক নার্স। কিছুদিন আগে মা হয়েছেন তিনি। উমা অধিকারী নামের সেই নার্স পরম মমতায় কোলে নিয়েছেন বাচ্চাটিকে, নিজের বুকের দুধ খাইয়ে সেই মুহূর্তে তাকে নতুন একটা জীবন উপহার দিয়েছেন। স্বার্থপরতা আর কপটতার হাজারো উদাহরণের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মন ভালো করে দেয়া একটা গল্প লিখেছেন উমা।
ঘটনাটা ঘটেছে গত বৃহস্পতিবার, ভারতের আর জি কর হাসপাতালে। লেবার ওয়ার্ড নাইট ডিউটিতে ছিলেন উমা। এক-একদিন এক-এক ওয়ার্ডে ডিউটি করতে হয় তাকে। বাড়িতে সাড়ে আট মাসের ছেলেকে রেখে এসে পিপিই-মাস্ক পরে রোগীদের দেখাশুনা করছিলেন অন্যান্য দিনের মতোই। সেখানেই ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর বিপাকে পড়লেন উমা। কারণ প্রসবের দু-তিন ঘণ্টা পরও স্তন থেকে দুধ নিঃসরণ হচ্ছিল না তাঁর। কিন্তু দুধ না পেয়ে কেঁদেই চলেছে শিশুটি।
সাধারণত এমন পরিস্থিতিতে মাদার-বেবি সেন্টারের শরণাপন্ন হন মা। অনেক সময় ওয়ার্ডের অন্যান্য মায়েরা এগিয়ে আসেন স্তন্যপান করাতে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এখন সবকিছুই এলোমেলো। করোনার ভয় সবাইকে এতটাই ভীত করে তুলেছে যে, সদ্য মা হওয়া ওয়ার্ডের অন্যান্য মহিলাদের কেউই এগিয়ে আসতে সাহস পাননি। পাছে তারা সংক্রমিত হয়ে যান, আক্রান্ত হয় নিজেদের সন্তান! একারণে বাচ্চাটা ঘন্টাধরে কেঁদে চললেও কারো মন গলেনি, পাষাণ হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারেনি সেই আর্তনাদ।
উমা তখন অন্য এক ওয়ার্ডে ছিলেন। কান্না শুনে ছুটে এসেছেন, প্রথমে অন্যান্য মায়েদের অভয় দেয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্ত কেউ রাজী হয়নি বাচ্চাটিকে দুধ দিতে। শেষমেশ উমা নিজেই ঝুঁকি নিয়েছেন, বাড়িতে রেখে আসা নিজের আট মাসের বাচ্চার কথা না ভেবে শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়েছেন, সব রকমের সাবধানতা অবলম্বন করে তাকে নিজের বুকের দুধ পান করিয়ে বাচ্চাটার তৃষ্ণা মিটিয়েছেন।
অথচ এই উমা অধিকারীই নিজের পাড়ার লোকেদের কাছে হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন, কারণ তিনি যে হাসপাতালে কাজ করেন, সেখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। পাড়ার লোক এসে তার বাড়ি ঘেরাও করেছে, বলেছে, হয় চাকরি ছাড়ো, নয়তো বাড়ি ছাড়ো। তুমি হাসপাতাল থেকে এপাড়ায় ভাইরাস বয়ে আনবে, সেটা হতে দেয়া যাবে না। উমা যতোই তাদের বুঝিয়েছেন যে, তিনি যথোপযুক্ত প্রোটেকশন ব্যবহার করেই রোগীদের সেবা করছেন।
তাছাড়া উমার একটা দুধের বাচ্চা আছে, যার বয়স মাত্র আট মাস। না উমা তার সন্তানকে ছেড়ে থাকতে পারবেন, না বাচ্চাটা মাকে ছাড়া বাঁঁচবে। হাসপাতাল বা অন্য কোথাও থেকে ডিউটি করা তার পক্ষে সম্ভব নয়- কিন্ত পাড়ার লোকে সেসব কথায় পাত্তা দিতে চায়নি। শেষমেশ থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন, পুলিশের পরামর্শে পরিবারের সবার মেডিক্যাল স্ক্রিনিং করিয়ে তবে সেই সমস্যা থেকে বেরোতে পেরেছিলেন তিনি।
সেই উমা অধিকারী মানুষের দুর্ব্যবহারের কথা ভুলে গিয়ে, মাতৃস্নেহের অপত্য ভাণ্ডার উজার করে দিয়েছেন অপরিচিত একটা বাচ্চার জন্যে। ছোট্ট শিশুটার কান্নার শব্দে যখন কারো হৃদয় গলছিল না, তখন উমা ছুটে এসেছেন। বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল তখন, তার বাচ্চাটার সঙ্গে ডিউটির সময় একবারই ভিডিওকলে দেখা হয়। সেই সুযোগটাও উমা ফিরিয়ে দিয়েছেন, কারণ নতুন একটা প্রাণকে বাঁচানোর জন্যে তিনি তখন মায়া আর ভালোবাসা বিলিয়ে দিচ্ছেন। নিজের বাচ্চার জন্যে তার যতোটা ভালোবাসা, তারচেয়ে কম কিছু যে অন্যের সন্তানের জন্যে নয়- সেটাই দেখিয়েছেন উমা।
সত্যিকারের মা তো উমাই, যিনি সব শিশুকেই নিজের সন্তান বলে মনে করেন। দিনশেষে উমার মতো মায়েরা জিতে যায়, হেরে যায় করোনার ভয়। উমার এমন সাহসকে কুর্নিশ জানাচ্ছেন তার সহকর্মী, বন্ধুবান্ধবরা। তবে উমা এত প্রশংসাতেও নির্বিকার। পিপিই পরে তিনি এখন পরদিনের নতুন চ্যালেঞ্জের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দেবী দূর্গার মতো ‘দশভূজা’ মায়ের প্রতিমূর্তিটাই যেন ফুটে উঠছে উমার অবয়বে...