করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা তাদের আলাদা করতে পারেনি, বরং আরও শক্ত করে তারা জড়িয়ে ধরেছেন একে অন্যকে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এক দম্পতি এভাবেই ভালোবাসার এক বিরল নিদর্শন স্থাপন করে চলেছেন প্রতিদিন...
আপনার জীবনসঙ্গী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, জীবন বিপন্ন হয়েছে তার, সংস্পর্শে থাকা যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে এই ঘাতকের আক্রমণে। কী করবেন তখন? তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেই দায়িত্ব শেষ করবেন? বাকী কাজ ছেড়ে দেবেন ডাক্তার আর নার্সদের কাঁধে? তারপর সুস্থ হলে আলহামদুলিল্লাহ, আর খারাপ কিছু হলে ইন্নালিল্লাহ? চীনের তাং হাই কিন্ত এমনটা করেননি। জীবন সঙ্গীর প্রতি ভালোবাসার অনুপম এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি, সংক্রমণের শঙ্কা মাথায় নিয়েই আক্রান্ত স্ত্রীর সেবা করে চলেছেন তাং হাই। একটা মুহূর্তের জন্যে স্ত্রীকে চোখের আড়াল করছেন না, ভালোবাসার মানুষটি যাতে ভেঙে না পড়েন, সেজন্যে অসম্ভব একটা যুদ্ধে নেমেছেন তিনি।
চীনের উহান শহরে তাং হাই এবং টিং লি'র সুখের সংসার ছিল। স্বামী ফিল্মমেকার, স্ত্রী নার্সের চাকুরি করেন উহানের এক হাসপাতালে। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তারা, ঘর আলো করে এসেছিল এক সন্তান, সেও স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে এখন। কিন্ত সুখের সংসারে হঠাৎই হানা দিলো করোনা নামের কালো মেঘ। উহান শহরটা যখন করোনার আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে, টিং লি'র ডাক এলো তখন, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে তাকে, যেতে হবে হাসপাতালে।
স্ত্রী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন, এটা জেনেই তাকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগের ওয়ার্ডে তাকে বিদায় জানিয়ে এসেছিলেন তাং হাই। সপ্তাহ দুয়েক পরে যখন শুনলেন যে অসুস্থদের সেবা করতে গিয়ে টিং লি নিজেই করোনাভাইরাসের কবলে পড়েছেন, তখন ভয় পেয়ে দূরে সরে যাওয়ার পরিবর্তে স্ত্রীকে আগলে রাখার পথেই হাঁটলেন তাং হাই। হাসপাতালে ভর্তি না করে তাকে নিয়ে এলেন বাসায়, ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন তার নানীর কাছে, যাতে করোনা তাকে গ্রাস করতে না পারে। তারপর একটা অসম্ভবপ্রায় যুদ্ধ শুরু করলেন তাং হাই, যে গল্পটা আজ থেকে কয়েকশো বছর পরেও ভালোবাসার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে কমপক্ষে চৌদ্দদিন কোয়ারেন্টিন পিরিয়ডে রাখা হয় রোগীকে, হাসপাতালের পরিবর্তে নিজেদের বাড়িতেই সেটা শুরু করলেন তাং হাই। নিজে সারাদিন ভারী প্রোটেক্টিভ স্যুট পরে থাকছেন, মুখটা ঢেকে রাখছেন মুখোশে। টিং লি স্বামীকে অজস্রবার বলেছেন, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিতে, নিজেকে নিয়ে এসব ঝামেলা দেখতে তার ভালো লাগছে না। কিন্ত তাং হাই সেসবে পাত্তা দেননি, তিনি জানেন, এই মুহূর্তে স্ত্রীর পাশে থাকাটা দুজনের জন্যেই খুব প্রয়োজন। তার উপস্থিতি টিং লি'কে খানিকটা হলেও ভালো থাকতে, আরেকটু জোর লড়াই করতে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
দিনগুলো ভীষণ বোরিং, ঘর থেকে বেরুনোর কোন উপায় নেই টিং লি'র। তাং হাইও সারাদিনই বাসায় থাকেন, স্ত্রীর পছন্দের আইটেমগুলো রান্না করেন, তাকে খাইয়েও দেন। গল্প করেন দুজনে, মাঝে একটা নিরাপদ ব্যবধান থাকে। স্ত্রীকে চকলেট গিফট করেন তাং হাই, বাইরে গিয়ে ফুল কিনে নিয়ে আসেন। নিয়ম করে ঘর পরিস্কার করেন, প্রতিদিন প্রোটেক্টিভ স্যুট বদল করেন, স্ত্রীর ব্যবহৃত জামা-কাপড় আর মাস্ক ফেলে আসেন ময়লা ফেলার নির্ধারিত বাক্সে। তাং হাই প্রতিদিন স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেন, তাকে যাতে করোনাভাইরাস আক্রমণ করতে না পারে। না, মৃত্যুকে তিনি ভয় পান না, তার ভয় একটাই- তিনি বিছানায় পড়ে গেলে তার স্ত্রীকে দেখার কেউ থাকবে না, টিং লি ভেঙে পড়বেন, নিজেকে সামলাতে পারবেন না আর।
ভিডিওকলে ছেলের সঙ্গে কথা বলেন দুজনে, বাচ্চাটাকে বুঝতে দেন না যে তার মা মৃত্যুর খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। আচমকা এক ঝড় এলোমেলো করে দিয়েছে এই দম্পতির জীবনকে, কিন্ত সেই ঝড়ের আঘাতে বিচ্ছিন্ন না হয়ে তারা শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছেন একে অপরকে। দুজনে স্পর্শসুখ থেকে বঞ্চিত অনেকদিন ধরে, হাত ধরা যায় না, চুমু খাওয়া তো অসম্ভব কিছু, একটাবার জড়িয়ে ধরতে পারেন না কেউ কাউকে। তবুও ভালোবাসার অদৃশ্য শক্তিতে তারা পাশে থাকেন পরস্পরের, প্রতিটা সেকেন্ডে তাদের বন্ধনটা দৃঢ় হয় আরও।
দিনগুলো ভীষণ দীর্ঘ, কাটতেই চায় না যেন। নেটফ্লিক্স, রান্না, গল্প- সবকিছু করেও যেন ফুরোয় না সময়। তাই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে নিজেদের এই জার্নিটাকে ক্যামেরায় ধরে রাখার পরিকল্পনা করেছেন তাং হাই। ফিল্মমেকার যেহেতু, ভিডিওগ্রাফির পোকা তো মাথায় ছিলোই। দৈনন্দিন বিষয়গুলোই ক্যামেরায় বন্দী করছেন তাং, সেগুলো আপলোড করছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আরও একটা উদ্দেশ্য আছে এটার- করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে উহানের প্রতিটা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে চাইছেন তিনি।
প্রতিটা পর্বের শুরুতে তিনি স্ত্রীর শারীরিক অবস্থার কথা জানান, দিনটা কেমন গেল সেটা বলেন গল্পের ছলে। রান্না, গল্প আর খুনসুটিগুলো ভিডিওর মাধ্যমে দর্শকদের জানান তিনি। নিজের ভেতরটা ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে গেলেও ক্যামেরার সামনে, স্ত্রীর চোখের সামনে স্বাভাবিক থাকার প্রাণপন চেষ্টা করেন তিনি। উহান আর চীনের আরও অনেক জায়গা থেকে হাজার হাজার মানুষ করোনার বিরুদ্ধে নিজেদের সংগ্রামের গল্পগুলো শেয়ার করেন ভিডিওর কমেন্টবক্সে, একটা মিলিত লড়াই চলে সেখানে, একে অন্যকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেন প্রাণপনে। আমরা জানিনা এই মানুষ দুটো করোনা নামের দৈত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিততে পারবেন কিনা, শুধু প্রার্থনা করতে পারি তাদের জন্যে। ভালোবাসার শক্তি নিশ্চয়ই মৃত্যুদূতের আক্রোশ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে টিং লিকে।
লায়লা মজনু বা শিরি ফরহাদের গল্প বইয়ে পড়েছি, শুনেছি। তাং হাই আর টিং লির এই গল্পটা কি ভালোবাসার মাপকাঠিতে এরচেয়ে কম কোথাও? নিজের জীবনকে বিপন্ন করে ভালোবাসার মানুষটার পাশে দাঁড়ানোর সাহস কয়জনই বা দেখাতে পারেন? আমরা যারা হৃদয়ভাঙা মানুষ, কর্পোরেট ভালোবাসার এই যুগে এসে এমন বাস্তব গল্পগুলো ভালোবাসা নামের অধরা বস্তুটার প্রতি আমাদের আকর্ষণ বাড়িয়ে দেয় বহু গুণে...
তাং হাই এবং টিং লি দম্পতির দিনযাপনের চুম্বক অংশ দেখতে পাবেন এখানে- https://bit.ly/2SBo8vh