গেম অফ থ্রোনসের বদৌলতে সবাই তাকে চেনে। কিন্তু এই মানুষটার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কোন ধারণা আছে আমাদের?

ভদ্রলোকের আসল নাম পিটার ডিঙ্কলেজ। যদিও এই নামে তিনি যতটা না পরিচিত, তার চেয়ে বেশি পরিচিত তিনি ল্যানিস্টার হিসেবে, দ্যা টিরিয়ন ল্যানিস্টার! ‘গেম অফ থ্রোনস’ টিভি সিরিজটাই ছিল পিটারের জীবনের গেম চেঞ্জার। অথচ, একসময় যিনি নিজের উপর কি ভীষণ বিরক্ত ছিলেন, মানুষও তাকে নিয়ে কি পরিমাণ অবজ্ঞা করতো, শুধু তিনি স্বাভাবিক উচ্চতার নন বলে।

বাংলায় একটা শব্দ আছে, ‘বামন’। পিটারকে সবাই বামন বলেই চিনতো। কেউ পিটারকে নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখায়নি কখনো যতদিন না পর্যন্ত সে সফল, কেউ পিটারকে রাস্তা দেখিয়ে দেয়নি, পিটার নিজেও সহজ রাস্তা বেছে নেননি। নিজের অস্বাভাবিকতার উপর বিরক্ত হলেও এটাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে চাননি। “বামন কি আর হাত বাড়ালেই চাঁদের দেখা পায়?”- গানটা পিটারের শুনবার কথা না, তবে শুনলেও যে তিনি বিশ্বাস করতেন না, সেটা তার আজকের সফলই জীবনই বলে। এই গানের কথাগুলো যে মিথ্যা পিটারের জীবনের গল্পের কাছে।

পিটার ডিঙ্কলেজ দেখিয়ে দিয়েছেন, হাত বাড়ালেই কিছুই পাওয়া যায় না, তবে লেগে থাকলে,হাল ছেড়ে না দিলে জীবন কাউকে নিরাশ করে না, সে যদি বামনও হয়, সমাজের চোখে খাটোও হয়, তবুও না, জীবন সবসময়ই প্রত্যাশার চেয়ে বেশি উপহার নিয়ে আপনার জন্য বসে আছে যদি আপনি কম কম অজুহাত দেখান, এবং প্রত্যাশায় চেয়েও বেশি চেষ্টা করে যান।

১৯৬৯ সালে নিউ জার্সির মরিসটাউনে জন্মেছিলেন পিটার। জন্মগতভাবেই তিনি একটি উপহার পেলেন, ‘একোনড্রোপ্লাসিয়া’। এই রোগ যাদের হয়, তাদের হাড়ের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে পিটার যে কিনা তার পরিবারে প্রথম খর্বকায় ব্যক্তি, বামন অবস্থায় তাকে দেখে তার আশেপাশের মানুষরাও খুশি ছিল না। সবাই পিটারের এই রোগকে খুব বাজে দৃষ্টিতে দেখেছে, আর কেউ এমন হলো না, সে কেন এমন অস্বাভাবিক হলো এই ভাবনাই যেনো পিটারের চারপাশের মানুষ ভাবছিলো প্রতিনিয়ত।

গেম অফ থ্রোনসের টিরিয়ন ল্যানিস্টার

পিটার সেটা বুঝতেও পারতো। ফলে, নিজের উপর তার খুব রাগ হতো ছোটবেলায়, ত্যাক্ত বিরক্ত লাগত সব কিছুর উপর। কিন্তু, একটু বড় হতেই পিটার নিজেকে বোঝালো, “তোমার শুধু অবজ্ঞাকে সহজ ভাবে নেয়ার একটা সেন্স অফ হিউমার থাকলেই হলো। কারণ, এটা তোমার সমস্যা নয়, তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা।”

১৯৯১ সালে পিটার বেনিংটন কলেজ থেকে ড্রামার উপর গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করলো। সে জানতো সে কী হতে চায়, সে চেয়েছিলো অভিনেতা হবে। পিটার জানতো, অভিনয় করার সুযোগ পাওয়াটা খুব সহজ হবে না। বিশেষ করে খর্বাকৃতির মানুষের জন্যে তো নয়ই, কারণ কেউই এই ধরনের বামন মানুষদের কথা মাথায় রেখে স্ক্রিপ্ট লিখে না, যদিও বা দুই একটি চরিত্র থাকে সেগুলো হয় খুবই জঘন্য এবং ছোট বামুন মানুষদের আরো নিচু হিসেবেই দেখানো হয় এগুলোতে নয়ত দেখানো হয় ভাঁড়ের চরিত্রে, যে সারাক্ষণ শুধু জোর করে কাতুকুতু দেয়া টাইপ নিরামিশ জোকস বলে বেড়াবে।

পিটার অপেক্ষা করছিল এমন একটি ক্যারেকটার তাকে দেয়া হবে, যেখানে খর্বাকৃতি মানুষদের ইচ্ছাকৃত ভাবে ছোট করা হবে না এবং যে চরিত্রের কিছুটা গভীরতা থাকবে। কিন্তু ৪ ফুট, পাঁচ ইঞ্চি মানুষটার জন্য সেরকম কোনো চরিত্র আসলো না। এইদিকে না আছে তার ব্যাংক একাউন্ট, না আছে টাকা। কিছু তো করতে হবে। পিটার গতানুগতিক চাকরি করতে চাননি। তার ভিতরে একজন অভিনেতার বসবাস, যে সেটা প্রকাশ করতে চায়। সে লিখতে ভালবাসে। সে চায় লেখালেখি, অভিনয় এগুলো কেন্দ্র করেই জীবন আবর্তিত হোক।

কিন্তু, মাঝে মধ্যে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয় সবচেয়ে কঠিন স্বপ্নটাকে সত্যি করার জন্যে। আপনি হয়ত চান সারাজীবনই গতানুগতিক চাকরি করবেন না, নিজের ভালবাসার কাজটাই করবেন, কিন্তু সেই জন্য ওই পর্যায়ে যেতে তো সারভাইব করতে হবে, টিকে থাকতে হবে। তাই তিনি চাকরিতে ঢুকে গেলেন। এমন চাকরি যা কোনোদিনই করতে পারতেন না যদি না তিনি নিজের স্বপ্নের প্রতি স্থির না থাকতেন। বেনিংটন কলেজে অনেক বছর বাদে সফল হওয়ার পর সমাবর্তনে যখন অতিথি হয়ে আসেন তখন তিনি তার চাকরির গল্প বলছিলেন এভাবে,

“...নয়টা-পাঁচটা চাকরি আমি চাইনি। আমি ছিলাম একজন অভিনয়শিল্পী, একজন লেখক। বেনিংটনের স্নাতক। তবু আমাকে একটা চাকরিতে ঢুকতে হয়েছে। পাঁচ মাস একটা পিয়ানোর দোকানে পিয়ানোর উপর জমে থাকা ধুলা পরিস্কার করে বেড়িয়েছি। একজন শেক্সপিয়ার বিশেষজ্ঞের সম্পদের দেখভাল করেছি। কিছুদিন বেকারও ছিলাম। নানা রকম কাজের পর অবশেষে প্রফেশনাল এক্সামিনেশন সার্ভিস নামে একটা প্রতিষ্ঠানে ঢুকলাম ‘ডেটা এন্টারার’ হিসেবে। সেখানেই ছিলাম টানা ছয় বছর। হুম ছয় বছর! বেনিংটনে যতটা সময় কাটিয়েছি, তার চেয়েও বেশি!”

কাজটা একদমই পছন্দ করতেন না ডিঙ্কলেজ, কিন্তু তবুও করে যেতেন এবং প্রতি শুক্রবার অসুস্থ হয়ে যেতেন। কারণ তার আগের দিন কাজের চাপ খুব বেশি পড়ে যেতো তার উপর। এতো কষ্টের মধ্যে তিনি দিনের পর দিন এই কাজটাই করতেন মনের বিরুদ্ধে কারণ তিনি এখানে অন্তত একটা মাথাগোঁজার ঠাই পেয়েছিলেন। 

ব্রুকলিনের একটা কারখানার ছোট চিলেকোঠাই ছিলো তার থাকবার জায়গা। তার অবস্থার মতো ঘরটার অবস্থাও ছিলো একইরকম, করুণ। বন্ধু বলতে ছিলো অসংখ্য ইঁদুর যারা ঘরময় দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াতো। ঘরে একটা জানালা ছিলো, মজার ব্যাপার হলো পিটার ডিঙ্কলেজের উচ্চতা জানালার উচ্চতার চাইতেও কম, ফলে সেই জানালার ওপারে কী আছে উঁকি দিয়ে দেখা হতো না তার। তার শুধু মনের এক খোলা জানালা ছিলো, সে জানালায় অবারিত স্বপ্ন দেখা আটকাতে পারেনি চিলেকোঠার সেই উঁচু জানালাটা।

নিজের মনের জানালায় নিজেকে উঁকি দিয়ে নিশ্চয়ই অনেক দূরে দেখতে পেতেন, অনেক সুন্দর কোনো আগামি দিনের কল্পনা করতে পারতেন। এরকমই এক জীবন কাটিয়েছিলেন পিটার ডিঙ্কলেজ। কিন্তু, তিনি আশা করতেন সবসময়ই এমন যাবে না। তিনি নিজের স্বপ্ন তখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন, রেখেছিলেন বলেই আজকে সেই স্বপ্নই তাকে বাঁচিয়ে রাখছে।

'গেম অফ থ্রোনস' পিটার ডিঙ্কলেজের জীবনে গেম চেঞ্জার হয়ে এসেছে

২৯ বছর বয়সে পিটারের মনে হলো, অনেক তো হলো, এবার যা কিছুই হোক, যেখানেই সুযোগ আসুক সে অভিনয় করবে, টাকার অঙ্ক যত কমই হোক তাতে কিছু যায় আসে না। অভিনয় করতে হবে, কারণ এটাই সে করতে চেয়েছে সবসময়। ফলে সে বোরিং একঘেয়ে সেই চাকরিটা ছেড়ে দিলো। ১০ বছর একটা ইঁদুরের ঘরে থেকে, ছয়টা বছর একই চাকরি করে কিছুটা ভয়ও যেনো মনে ঢুকে গিয়েছিলো পিটারের, এই যে পরিবর্তন হতে যাচ্ছে সেটা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে? উত্তর জানা নেই, তবে যেহেতু এরকম কিছু তিনিই চেয়েছিলেন তাই তার ভেতরে চাপা ভয়ের সাথে একটা রোমাঞ্চও নিশ্চয়ই কাজ করছিলো।

বেনিংটনের সমাবর্তনে এই সময়টা নিয়ে পিটার বলেছিলেন, “...আমার মা-বাবার অত টাকা ছিল না। কিন্তু আমাকে সেরা স্কুলে পাঠাতে তাঁরা ভীষণ কষ্ট করেছেন। স্নাতকেরা, তোমাদের হয়তো কথাটা শুনতে ভালো লাগবে না, স্নাতক শেষ করার পর আমার দায়িত্ব আমিই নিয়েছিলাম। নিজের আয়ে নিজে চলতাম। আমি দেখতে পাচ্ছি, অভিভাবকেরা হাততালি দিচ্ছেন, স্নাতকেরা দিচ্ছে না। কিন্তু সত্যি বলছি, আমি একটুও আলসেমি করিনি। এখন আমি অলস হতে পারি, তখন ছিলাম না। বাকি জীবনটা এমনভাবে গড়ে তোলো যেন সেই তোমার সঙ্গে তোমার দেখা হয়, যেমনটা তুমি হতে চাও। একটা মোক্ষম সময় আসবে, সেই অপেক্ষায় থেকো না। অপেক্ষায় থাকলে সেই মুহূর্তটা আর কখনোই আসবে না।”

আলসেমি করেননি বলেই গেম অফ থ্রোনস টিভি সিরিজটি তার জীবনের গেম চেঞ্জার হয়ে এসেছে, এখানে তিনি সেই আকাঙখিত চরিত্রটির দেখা পেয়েছেন যে চরিত্রের গভীরতা আছে, এখানে তাকে দেখানো হয়েছে একজন বুদ্ধিমান যার প্রতিটি কথাই বুদ্ধিদীপ্ত এবং চরিত্রটি গোটা সিরিজেরই অন্যতম সেরা একটি চরিত্র।

গেম অফ থ্রোনস বইয়ের লেখক এই টিরিয়ন ল্যানিস্টার চরিত্র হিসেবে পিটারকে আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন, যার মর্যাদা পিটার রাখেন প্রত্যেকটি দৃশ্যে একদম নিখুঁত ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দিয়ে। আজ পিটার আমেরিকার টিভি অভিনেতাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকের দিক দিয়ে পঞ্চম! এতো গ্ল্যামারাস, এতো উঁচু উঁচু মানুষদের থেকেও তার কদর এখন সবচাইতে বেশি। যাকে দেখে সবাই অবজ্ঞা করতো এখন তার উপরই সবাই ক্রাশ হয়।

কত আমেরিকান ভাবে যদি পিটারের মতো বুদ্ধিদীপ্ত ভঙ্গিতে তারা কথা বলতে পারতো, যদি তাদের চুল পিটারের মতো হতো, যদি পিটারের মতো প্রতিভা তাদের থাকতো! পিটারকে কেউ এসে অনুপ্রেরণা দিয়ে যায়নি। যখন সবাই তাকে অবজ্ঞা করেছে হীনমন্যতায় ডুবে গিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তিনিও তো আত্মহত্যা করে বসতেই পারতেন। করেননি।

গ্র‍্যাজুয়েশনের পর চাইলে ওসব চাকরিতে না গিয়ে মনের দুঃখে ডিপ্রেশনে থেকে হারিয়ে যেতেই পারতেন। কেউ সফল হলে আমরা বলি, হি/শি ওয়াজ লাকি। কেউই লাকি না, ভাগ্যের এতো ঠেকা পড়ে না কাউকে স্বেচ্ছায় গিয়ে সাহায্য করার, তাদের কাছেই ভাগ্য ধরা দেয় যারা দিনের পর দিন দূর্ভাগ্য মেনে নিয়েও টিকে থাকে। পিটার তেমনই একজন, এজন্যেই আজ সে দ্যা টিরিয়ন ল্যানিস্টার, ওয়ান অব দ্যা মোস্ট হ্যান্ডসাম ম্যান ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড উইথ অনলি ফোর ফিট এন্ড ফাইভ ইঞ্চিস!

-

* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা