যেভাবে লকডাউন ছাড়াও করোনা মোকাবেলা করা সম্ভব...
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এখন আমরা যদি আমাদেরকে বাকিদের সাথে সরাসরি তুলনা করি, তবে সেটা আমাদের হতাশ করা ছাড়া আর কোনো সুফল বয়ে আনবে না। আমাদের উচিত হবে, তাদের পদক্ষেপগুলো বিশ্লেষণপূর্বক আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া...
বাংলাদেশ থেকে তুলে নেয়া হয়েছে ‘লকডাউন’, এমন অবস্থায় নানা মুনির নানা মত। কেউ বলছেন, এটা সোজা আত্মহননের সিদ্ধান্ত। মরতে মরতে যে কয়জন বাঁচে। আবার আরেক দল দাবী তুলেছেন, এছাড়া উপায় ছিলো না। সবকিছু খুলে না দিলে, করোনার আগে মানুষ না খেয়েই মরা শুরু করতো।
অতোটা জটিল বিশ্লেষণে যেতে চাইছি না। ব্যাপারটাকে একটু সহজ করার চেষ্টা করি। করোনা বাংলাদেশে আসার আগে অনেকগুলো দেশ দাপিয়ে বেড়িয়েছে। আমরা চাইলেই খুব সহজে সেসব দেশের ভুলগুলো থেকে অগ্রীম শিক্ষা নিতে পারতাম। কিন্তু না আমরা সেটা করিনি। আমরা পরীক্ষার অপেক্ষায় ছিলাম, তার আগের রাতে পড়বো বলে। শেষমেশ সে সৌভাগ্য আমাদের হয়নি।
আমাদের গোলা ভরা ধান, আর মুখ ভরা প্রতিশ্রুতি ছিলো। পারতপক্ষে কোনো প্রস্তুতি আমরা নেইনি। নেয়ার চেষ্টাও করিনি। আমরা অপেক্ষা করছিলাম আক্রান্ত হবার। কবে আমরাও আক্রান্ত হবো, কবে মৃত্যুমিছিল শুরু হবে, তারপর না হয় ভাবা যাবে। ভাবতে ভাবতে রেকর্ডের পর রেকর্ড ভাঙছি আমরা, মৃত্যুর সংখ্যায়, আক্রান্তের সংখ্যায়।
করোনাভাইরাসের ওয়ার্ল্ডোমিটারে এখন আমরা একুশ নাম্বার স্থানে অবস্থান করছি। এভাবে চলতে থাকলে সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন এই ২১ থেকে ২ সরে যাবে, আমরা ১ এ চলে আসবো।
এখন হয়তো ঐ একুশের চেতনায় ঘুরে দাঁড়াবার সুযোগ নেই, তবে সীমিত পরিসরে ড্যামেজ কন্ট্রোলের একটা চেষ্টা আমরা করতে পারি। করোনার ব্যাপারে যত রকম ভুল করা যায় আমরা ইতিমধ্যেই করে ফেলেছি, আক্রান্ত ও মৃতের ক্রমবর্ধমান সংখ্যাটা সেই সাক্ষীই দেয়। এখন আমরা যা করতে পারি সেটা হচ্ছে যতটা সম্ভব ক্ষতিটা কমানো। কিন্তু কীভাবে?
যে দেশগুলো এখন পর্যন্ত করোনাযুদ্ধে সফল হয়েছে, তারা সবাই কঠোর লকডাউন মেনেই সেটা করেছে। এদিকে আমরা যেহেতু লকডাউন খুলেই দিয়েছি, আমাদের উচিত হবে এমন কোনো দেশেকে অনুসরণ করা, যারা লকডাউট শিথিল করেও সাফল্য পেয়েছে। এমনই একটা দেশ তুরস্ক। আসুন তাদের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু শেখার চেষ্টা করা যাক।
বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ই মার্চ। পক্ষান্তরে, তুরস্কে করোনাভাইরাস সংক্রমণের অস্তিত্ব জানা গিয়েছিলো গত ১১ই মার্চ। এরপর থেকে বেশ দ্রুত দেশের প্রতিটি জায়গায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। একমাসের মধ্যেই তুরস্কের সবগুলো প্রদেশ আক্রান্ত হয়।
চীন এবং ব্রিটেনের তুলনায় বেশ দ্রুত গতিতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে তুরস্কে। অনেকে আশংকা করেছিলো যে দেশটিতে মৃতের সংখ্যা অনেক বাড়বে। তুরস্কের অবস্থা হয়তো ইটালির মতো হয়ে উঠতে পারে – এমন শংকাও ছিলো।
কিন্তু প্রায় তিন মাসের মাথায় এসেও সেটা ঘটেনি। এমনকি তুরস্কে পুরোপুরি লকডাউনও দেয়া হয়নি। করোনার ওয়ার্ল্ডোমিটারে তুরস্কের বর্তমান অবস্থান ১০ নাম্বারে। মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে সাড়ে ৪ হাজার। কিন্তু অনেক চিকিৎসক মনে করেন প্রকৃত অর্থে মৃতের সংখ্যা এর দ্বিগুণ হতে পারে।
কারণ, যারা পরীক্ষার মাধ্যমে কোভিড-১৯ রোগী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে, তাদের মধ্যে কেউ মারা গেলে সেটিকে পরিসংখ্যানে দেখানো হয়। পরীক্ষা ব্যতীত যারা মারা যাচ্ছেন, তাদেরকে পরিসংখ্যানে দেখানো হয় না। কিন্তু তারপরেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ংকর দিনগুলোতে তুরস্কে মৃতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিলো।
যদিও করোনা পরিস্থিতি নিয়ে শেষ কথা বলে দেয়ার সময় এখনো আসেনি, তবুও তুরস্ক বেশ পরিষ্কারভাবেই একটি বড় ধরণের দুর্যোগ পাশ কাটিয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরাও এমনটাই বলছেন। যে কয়েকটি দেশ মোটামুটি দ্রুততার সাথে টেস্ট করেছে এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা মানুষদের সনাক্ত করার মাধ্যমে তাদের আলাদা করেছে, সংক্রমণের বিস্তার কমাতে সক্ষম হয়েছে তুরস্ক তাদের মধ্যে অন্যতম।
তুরস্কে যখন সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছিলো তখন দেশটিতে বেশ কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। এর মধ্যে ছিলো- গণ পরিবহনসহ বিভিন্ন জায়গায় বাধ্যতামূলক মাস্ক ব্যবহার, রেস্টুরেন্ট ও কফি-শপ বন্ধ করা, জনবহুল জায়গায় শপিং বন্ধ রাখা এবং মসজিদে জমায়েত বন্ধ করা। লকডাউন ছাড়াও, তারা এই প্রক্রিয়াতে সাফল্য পেয়েছে। আমরা যদি স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতেই চাই, তবে তাদের এই সাফল্যকে পুঁজি করে আমাদেরও কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি এবং ২০ বছরের কম তাদের পুরোপুরি বাসায় আটকে রাখা হয়েছিলো সেখানে। এছাড়া ছুটির দিনগুলোতে কারফিউ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বড় শহরগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সংক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইস্তাম্বুল শহর। এই শহরটি তার ছন্দ হারিয়েছে- হৃৎস্পন্দন ছাড়া হৃদপিণ্ডের মতো অবস্থা হয়েছে ইস্তাম্বুল শহরের।
তবে ধীরে ধীরে সব বিধি-নিষেধ শিথিল করা হচ্ছে, তুলে নেয়া হয়েছে লকডাউন। সেখানে করোনা টেস্টের রেজাল্ট জানানো হচ্ছে ২৪ ঘন্টার ভেতরেই, কাউকে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে না, লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে না।
তুরস্ক থেকে কিছু শেখার আছে অনেক কিছু। প্রথম দিকে তারাও উদ্বিগ্ন ছিলো ভীষণ। প্রতিদিন ৩৫০০ সংক্রমণ ছিলো। টেস্ট করার বিষয়টি কাজে লেগেছে। তবে টেস্টের ফলাফলের জন্য পাঁচ-সাতদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এভাবেই তুরস্কের প্রশংসা করেছে। উল্লেখ্য, এই তুরস্কই দীর্ঘ সময় যাবত সীমান্ত খোলা রাখার মতো ভুল করেছিলো।
কোভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর জন্য তুরস্কের কিছু সুবিধা রয়েছে। দেশটির জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ, শিক্ষিত এবং হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেডের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি। অর্থাৎ, তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা যেমন উন্নত, তারা তেমন সচেতনও বটে।
এখন আমরা যদি আমাদেরকে তাদের সাথে সরাসরি তুলনা করি, তবে সেটা আমাদের হতাশ করা ছাড়া আর কোনো সুফল বয়ে আনবে না। আমাদের উচিত হবে, তাদের পদক্ষেপগুলো বিশ্লেষণ করে আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করা। আমাদের দেশে এখনো করোনা টেস্টের সংখ্যা খুবই খুবই কম।
বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ৩,০৮,৯৩০। নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে শনাক্তের হার ২১.৪৩ ভাগ। আর শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১.৩৮ শতাংশ। এতোদিনে তিন লাখের জায়গায় যদি ত্রিশ লাখ টেস্ট করানো হতো তাহলে কী হতো? সেই প্রস্তুতি কী থাকা উচিত ছিলো না আমাদের? যেখানেই আমরা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছি।
এবার নিজেই হিসেব করে দেখুন, আমাদের টেস্টের সংখ্যাটা যদি বাড়ানো হয় তবে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে...