তুরস্কের ভাস্কর্য নির্মাণের ঘোষণা ও ভাস্কর্য বিরোধীদের জালে আত্মঘাতী গোল
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে তুরস্ক। এদেশের ভাস্কর্য বিরোধিরা কি এখন এরদোয়ানের কুশপুত্তলিকায় আগুন দেবে? তুরস্কের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে? নাকি আঙ্কারা অভিমুখে প্রতিবাদের ডাক দেবে?
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে রাজপথ গরম করার পাঁয়তারায় ছিল যারা, তাদের মাথার ওপরে মোটামুটি বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়েছে আজ। ভাস্কর্য বিতর্ক চলমান থাকার মাঝখানেই তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মুস্তফা ওসমান তুরান সাংবাদিকদের সামনে এসে ঘোষণা দিলেন, তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এবং ঢাকার কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য নির্মাণ করবে তুরস্ক।
শুধু তাই নয়, তুর্কির বিজনেস ক্যাপিটাল ইস্তাম্বুল আর বাংলাদেশের বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামেও এ রকম কিছু করা যায় কি না, সেটি নিয়েও আলোচনা চলছে। ভাস্কর্যবিরোধী শিবিরে এখন অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট টাইপের একটা নীরবতা বিরাজ করছে, খেলার মাঝখানে এমন আত্মঘাতী গোল হজম করতে হবে, এরকমটা কল্পনাতেও ছিল না তাদের।
ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করা হলে সেই ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলা হবে বলে হুমকি দিয়েছিলেন খেলাফত মজলিশের মামুনুল হক। আরও বলেছিলেন, ভাস্কর্য নির্মাণের পাঁয়তারা করা হলে তৌহিদী জনতাকে সঙ্গে নিয়ে শাপলা চত্ত্বর অবরোধ করা হবে। লম্বা একটা সময় ধরে সেই ঘৃণ্য বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায়নি ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোও স্রোত কোনদিকে যায় সেটা বোঝার চেষ্টা করেছে। টানা একযুগ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, এরপরেও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ইস্যুতে তারা যে পরিমাণ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগেছে, সেটা মেনে নেয়ার মতো ছিল না। প্রগতিশীল মানসিকতার মানুষজন সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানালেও, আওয়ামী লিগের তরফ থেকে প্রতিবাদটা এসেছে অনেকটা দেরী করে।
আর এই বিলম্বের সুযোগটা নিয়েছে ভাস্কর্যবিরোধী গোষ্ঠী। ভাস্কর্য আর মূর্তিকে এক করে তারা প্রচারণা চালিয়েছে, মুসলিম দেশে ভাস্কর্য নির্মাণ করা যাবে না। হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী তো বলেছেন, তার বাবার ভাস্কর্য নির্মাণ করা হলে সেটাও নাকি ভেঙে ফেলবেন, ইসলামে ভাস্কর্যের কোন স্থান নেই। কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কোন ইসলামিক রাষ্ট্র নয়, গণতান্ত্রিক সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এখানে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী- সবার সমান অধিকার। সেই দেশে কীভাবে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ভাস্কর্য বানাতে দেয়া হবে না, বানানো হলে ভেঙে ফেলা হবে টাইপের হুমকি দেয়া হয়?
দেরিতে হলেও আওয়ামী লিগের ঘুম ভেঙেছে, অঙ্গসংগঠনগুলোও আড়মোড়া ভেঙে উঠেছে, এবং তারা রাস্তায় নেমে মামুনুল গং এবং ভাস্কর্যবিরোধীদের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। কয়েকদিন আগেও গর্জন করতে থাকা লোকগুলো তখন মেনি বেড়ালের মতোই চুপসে গেছে, তাদের গলায় শোনা গেছে আপসের সুর। এখান থেকেই পরিস্কার, ভাস্কর্য বা ধর্ম রক্ষা- দুটোই তাদের কাছে ছিল ইস্যু, মূল উদ্দেশ্য ছিল অরাজক একটা পরিস্থিতি তৈরি করে সরকারের কাছ থেকে কিছু সুবিধা আদায় করে নেয়া, যেটা তাদের পূর্বসূরিরাও নিয়েছে।
কয়েকদিন ধরেই ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে আসা লোকজন কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। আজ তুরস্কের রাষ্ট্রদূতের এই ঘোষণা তাদের কফিনে যেন পেরেক ঠুকে দিলো। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান্ব তুরস্কের রাষ্ট্রদূত এরদোয়ান আসবেন- এটা যেমন নিশ্চিত হয়েছে, তেমনই তুরস্ক নিশ্চিত করেছে যে, তারা ঢাকায় এবং আঙ্কারায় দুটি ভাস্কর্য নির্মাণ করবে দুই দেশের মহান দুই নেতার স্মরণে। আঙ্কারায় নির্মিত হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য, আর ঢাকায় বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউতে নির্মাণ করা হবে তুরস্কের জাতির পিতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য। দুটি ভাস্কর্যের নির্মাণ ব্যায়ই বহন করবে তুরস্কের সরকার।
তুরস্কের এই ভাস্কর্য নির্মাণের ঘোষণাটি কেন ভাস্কর্যবিরোধীদের কাছে আত্মঘাতি গোল হয়ে এসেছে, এবার সেটা ব্যাখ্যা করি। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এদেশের অজস্র মানুষের কাছে হিরো, অনেকে তাকে ক্রুসেডের সালাউদ্দিন আইয়ুবির মতোই কেউ একজন হিসেবে ভাবে। বিশেষ করে ধর্ম নিয়ে যারা প্রতিনিয়ত উস্কানি দেয়, ধর্মকে ব্যবহার করে যারা নিজেদের আখের গোছায়, এই গোষ্ঠীটার কাছে এরদোয়ান ভীষন জনপ্রিয়। এরদোয়ানের মতো শাসক বাংলাদেশেও চায় তারা, এরদোয়ানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেলে তারা যেন বর্তে যায়!
কথায় কথায় তুরস্কের উদাহরণ টেনে আনা এই লোকগুলো কখনও খোঁজ নিয়ে দেখে না যে, সেদেশের আনাচেকানাচে মোস্তফা কামাল পাশার কত ভাস্কর্য এবং আবক্ষমূর্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারা জানে কেবল বিরোধিতা করতে, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিতে, আর মতের অমিল হলেই গালাগালি করতে, হুমকি দিতে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্মুক্ত এই দুনিয়ায় চাইলেই যে কোন কিছুর খোঁজ বের করা যায়, কিন্ত সেই ইচ্ছা বা শক্তি, কোনোটাই তাদের নেই। কূপমণ্ডূকতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে ঘৃণার বিষবাস্প ছড়িয়ে বেড়ানোই এদের কাজ।
সেই তুরস্ক যখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে আজ, তখন এই লোকগুলোর প্রতিক্রিয়া জানতে খুব ইচ্ছে করছে। এরা কি এখন এরদোয়ানের কুশপুত্তলিকায় আগুন দেবে? তুরস্কের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে? আঙ্কারা অভিমুখে প্রতিবাদের ডাক দেবে? নাকি এরদোয়ান আসল মুসলমান নয়, তুরস্কের ইসলামও সত্যিকারের ইসলাম নয়- এই টাইপের ফতোয়া জারী করবে?
এই লোকগুলোকে খুব কঠোর ভাষায় বুঝিয়ে দেয়া দরকার যে, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটা ধর্মনিরপেক্ষতার শপথ নিয়ে স্বাধীন হয়েছিল, এখানে ধর্মান্ধতার কোন জায়গা নেই, জায়গা নেই ধর্ম নিয়ে ব্যবসারও। এখানে মসজিদ থাকবে, মন্দির থাকবে, ভাস্কর্য থাকবে, মূর্তি থাকবে, এখানে মাঠে ঈদের জামাত হবে, গানের কনসার্টও হবে। এই বৈচিত্র্যতাটাই বাংলাদেশের সৌন্দর্য্য, সেটাকে হারিয়ে দেশকে আফগানিস্তান বা পাকিস্তানে পরিণত হতে আমরা দেবো না। কোনোভাবেই না।