ট্রাম্প বনাম ইউএসএ: ঘৃণার বিরুদ্ধে ভালোবাসা নিয়ে আমেরিকার এক হবার গল্প
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এই হীরক রাজা ক্ষমতায় থাকলে এক দশকের মধ্যেই মুসলিমদের সাথেও হলোকাস্টের মতো কিছুই ঘটবে। তারপর আসবে ইহুদিদের পালা, তারপরে কৃষ্ণাঙ্গ। সমকামী ও অন্যান্য মাইনোরিটি বহু আগেই শেষ হয়ে যাবে। তাই সবাই এক হলো। শুরু হলো 'ট্রাম্প বনাম ইউএসএ' লড়াই...
গত ইলেকশনে, মানে ২০১৬ সালের নভেম্বরে যখন হিলারি এবং ট্রাম্প একে অন্যের মুখোমুখি, এবং আমরা সবাই নিশ্চিত আমেরিকা ইতিহাসে প্রথমবারের মতন কোন নারী প্রেসিডেন্ট পেতে যাচ্ছে, আমরা তখন হাসপাতালে। আমার এক ভাগ্নির জন্ম হয়েছিল সে রাতে।
আমরা ওয়েটিংরুমে অপেক্ষায় ছিলাম। টিভিতে ইলেকশনের ভোট গণনা চলছিল এবং পর্দার সামনে একঝাঁক হিস্প্যানিক (ল্যাটিন) লোকজন জড়ো হয়ে অধীর আগ্রহে তা দেখছিল। সবার মুখ পাংশুবর্ণ। কারন হিলারির চেয়ে ট্রাম্প তখন বহুদূর এগিয়ে। এই গতি অব্যাহত থাকলে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবে। এই লোকটা নিজের প্রচারণায় প্রকাশ্যে বর্ণবাদি বক্তব্য দিয়েছে। সে বলেছিল ম্যাক্সিকো-আমেরিকা বর্ডারে দেয়াল তুলে দিবে। সে বলেছিল ইল্ল্যিগাল ম্যাক্সিকানদের ধরে ধরে বাড়ি ফেরত পাঠাবে। সে বলেছিল মুসলিমদের হাতে ব্যাজ ধরিয়ে দিবে, যাতে সবাই দেখামাত্রই চিনতে পারে এরা মুসলিম।
বাতাসে তখন গুজব ভাসছে, মসজিদ বন্ধের ব্যবস্থাও সে করবে। শ্বেতাঙ্গছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিটা মানুষ তখন নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত। মোহাম্মদ আলীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ইহুদি নেতা তাই প্রকাশ্যেই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। হোয়াইট সুপ্রিমিস্টরা মনে প্রাণে চাইছে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসুক, তাই কৃষ্ণাঙ্গরাও এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। যদি ট্রাম্পের মতন বর্ণবাদী, আধাপাগল, নির্লজ্জ মিথ্যুক ক্ষমতায় আসে, কেবল আমেরিকাই না, গোটা বিশ্ব একটা বিশাল ধাক্কা খাবে। আমেরিকানরা কি এই বোকামি করবে? ওকে ক্ষমতায় আনবে?
দেখা গেল সেটাই হতে চলছে। এবং পরদিন সকালে উঠে দেখি ঘটনা ঘটে গেছে। হিলারিকে পছন্দ হয়নি বলে অনেক ডেমোক্রেটরা ভোট দেয়নি। রিপাবলিকানরা সেই ভুল করেনি। বুশের সময়ে যত ভোট এসেছিল, ট্রাম্পও তত ভোটই পেল। ওবামার ভোটারদের অনেকেই হিলারিকে ভোট না দেয়ায় ট্রাম্প ক্ষমতায় চলে আসে। স্প্যানিশ কমিউনিটি, মুসলিম কমিউনিটি, ইহুদি কমিউনিটি, সমকামী সবার মুখ তখন অন্ধকার। কালোদের মনে হয়না কিছু এসেছে বা গেছে। ওরা যেন ধরেই নিয়েছে ওরা এমনিতেও মার খাবে, ওমনিতেও মার খাবে। শুরু হয় মার্কিন ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকারতম অধ্যায়।
আমার স্ত্রী তখন খুব বেশিদিন হয়নি আমেরিকায় এসেছে। সেও ভয়ে আধমরা হয়ে গেল। সে তখনও সিটিজেন না। গ্রীনকার্ড নিয়ে থাকছে। ওর টেনশন এই ব্যাপারে যে না জানি আমাদেরকে "মুসলিম" হবার অপরাধে এদেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়! তাকে বুঝালাম যে কোন সভ্য দেশ ইচ্ছা করলেই এমনটা করতে পারেনা। ইউএস নাগরিকত্ব আমাকে ওরা দিয়েছে এবং সেটা ওরা কেবল তখনই কেড়ে নিতে পারবে যদি আমি কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত থাকি, কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী কোন অপরাধ করি। এবং এদেশটা আমাদের মতন না যে সরকারের বিরুদ্ধে একটা টু শব্দ করলেন, অমনি আপনাকে জেলে ভরে দিবে বা দেশ থেকে বিতাড়িত করবে।
ফ্রান্সকে নিয়ে এমন মন্তব্য যেমন অনেকে করছেন। অনেকে বলছেন, ফ্রেঞ্চরা যদি বাংলাদেশী মুসলিমদের দেশে ফেরত পাঠায় তাহলে এর দায়ভার কে নিবে! না, এই ভয় অমূলক। ফ্রেঞ্চ সরকার বৈধভাবে বাস করা কোন বাঙালি, ইন্ডিয়ান, আফ্রিকান কাউকেই দেশে ফেরত পাঠাতে পারবে না। তা যতই ওদের সরকারি নীতির সমালোচনা করুন না কেন। প্রসঙ্গ ওঠায় বলি, ছোটবেলা থেকে প্রথমআলো পত্রিকায় শিশির ভট্টাচার্য্য নামের এক কার্টুনিস্টের পলিটিক্যাল কার্টুন দেখে দেখে বড় হয়েছি। মজার মজার সেসব ব্যঙ্গ চিত্র ছিল সমসাময়িক সমাজের প্রতিচ্ছবি। এক দশকের উপরে হলো এই শিশির ভট্টাচার্য্য বা অন্য কোন কার্টুনিস্টকে পলিটিক্যাল কার্টুন আঁকতে আর দেখা যায় না। এই হচ্ছে আমাদের দেশের "বাক স্বাধীনতা।"
আর ফ্রেঞ্চদের বাক স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়ে দেয়া বাংলাদেশী কবিরা নিজের দেশের এই আচরণ দেখে নীরব হয়ে যান। ভাইয়ারা, আগে প্লিজ নিজের সরকারকে বুঝান, নিজের দেশকে নিয়ে আলোচনা করুন, তারপরে নাহয় অন্যকে নিয়ে ভাববেন?
যাই হোক, বৌকে বুঝালাম আমেরিকান ডেমোক্রেসিতে "চেক্স এন্ড ব্যালেন্স" কি। বুঝালাম আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রীর মতন এদেশে প্রেসিডেন্ট সব ক্ষমতার অধিকারী নয়। এফবিআই বা পুলিশ ডিটেক্টিভ কোন তদন্ত শুরু করতে হলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষা করেনা। কারোর সাথে কোন অন্যায় ঘটলে সে পুলিশ প্রশাসন আদালত ইত্যাদি ফেলে প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপ কামনা করেনা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী পদ হলেও প্রেসিডেন্টও কোর্ট ও কংগ্রেসের উপর নির্ভরশীল। ট্রাম্প যাই চাক না কেন, সুপ্রিম কোর্ট ও কংগ্রেসের বাঁধার কারনে তা করতে পারবেনা।
তা ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরে বিরাট বিরাট র্যালি গেল ওয়াশিংটনে। হলিউড সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে সাধারণ জনতা, সবাই গিয়েছেন ওয়াশিংটনে কেবলমাত্র একটি বাক্য শোনাতে, "নট মাই প্রেসিডেন্ট!" আমাদের ক্যানভাস গ্রূপেরই এডমিন রনিয়া রহিম দলবল নিয়ে ছুটে গিয়েছিল রাজধানীতে। ঠান্ডার মধ্যে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি নিজের "ভালবাসা" ব্যক্ত করেছে।
ট্রাম্প এসেই নিজের চরিত্র তুলে ধরলো। সাতটি দেশের মানুষের উপর ভ্রমন নিষেধাজ্ঞা জারি করলো। "কাকতালীয়ভাবে" এর বেশিরভাগই মুসলিম। নিষেধাজ্ঞা ছিল তৎক্ষণাৎ। মানে, ধরেন ইরান থেকে প্লেনে উঠছে এক ব্যক্তি, তখন পর্যন্ত তাঁর ভিসায় কোন সমস্যা নেই। তিনি প্লেনে থাকাবস্থায় এই নিয়ম চালু হলো। তিনি এয়ারপোর্টে নেমে শোনেন তাঁকে এদেশে প্রবেশ করতে দেয়া হবেনা। তাঁর অপরাধ? তিনি ঐ সাত দেশের একটির নাগরিক।
শুধু তাই না, নিয়মটা এমন ছিল যে ধরেন কোন ইরানি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নিয়েছে। তাঁর বর্তমান পরিচয় তিনি ব্রিটিশ। তাঁকেও প্রবেশ করতে দিবে না। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দেশের নানানপ্রান্তের এয়ারপোর্টে হাজার হাজার যাত্রী আটকা পড়ে গেলেন। অনেকেই এসেছেন বেড়াতে, অনেকে এসেছেন পরিবারের সাথে দেখা করতে, অনেকে এখানে পড়াশোনা করেন।
ট্রাম্পের এই ইতরামির জবাব দিল সাধারণ জনতা। এরা এয়ারপোর্টে গিয়ে প্রতিবাদ করলো। শুধু মুসলিমরাই নয়, ইহুদিরাও এগিয়ে এলো এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তাঁরা ভাল করেই জানে, একশো বছর আগে ইউরোপে তাঁদের বিরুদ্ধে এই প্রোপাগান্ডা চালিয়েছিল জার্মান সরকার। জার্মানির যাবতীয় ঝামেলার জন্য সরাসরি ওদের দায়ী করে প্রচারণা চালিয়েছিল। জনতা বেকুব হয়ে থাকে। ওরা তাই করে যা নেতারা বলে। ফলে মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে যখন ইতিহাসের নৃশংতম গণহত্যা শুরু হয়, সাধারণ জনতা বাঁধা দেয়নি।
উল্টো জার্মান ইঞ্জিনিয়াররা উন্নতমানের গ্যাস চেম্বার নির্মাণ করেছিল। জার্মান ডাক্তার নার্স থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত অতি নিপুণতার সাথে গণহত্যায় সামিল হয়েছে। ওরা ভাল করেই জানে এমন ঘটনাকে প্রশ্রয় দিলে আগামী এক দশকের মধ্যেই মুসলিমদের সাথেও এমনটাই ঘটবে। তারপরে ইহুদি। তারপরে কৃষ্ণাঙ্গ। সমকামী ও অন্যান্য মাইনোরিটি বহু আগেই শেষ হয়ে যাবে। তাই সবাইকেই এক হতে হবে। সবাই এক হলো। শুরু হলো "ট্রাম্প বনাম ইউএসএ" লড়াই প্রথম পর্ব।
নাইন ইলেভেনের পরে এয়ারপোর্টে মুসলিমরা চোরের মতন চলাফেরা করতেন। বোরখা বা জোব্বা বা লম্বা দাড়ি থাকলেই লোকে সন্দেহের চোখে তাকাতেন। প্লেনে ওঠার আগে গেটের চিপায় দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছে বলে অনেক যাত্রীই নিজের ফ্লাইট বদল করেছেন, এমন ঘটনা ঘটতো নিয়মিত। "আল্লাহু আকবার" মানে ছিল মানুষ হত্যার আহ্বান। অথচ এই আন্দোলনে দেখা গেল অমুসলিম মেয়েরা হিজাব মাথায় এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে। নামাজের সময়ে মুয়াজ্জিন আজান দিলেন, এবং সব মুসলিম জামাতে নামাজ আদায় করছেন। প্রতি সিজদায়, প্রতি রুকুতে প্রতিটা "আল্লাহু আকবার" তাকবীরে অমুসলিমরা পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিয়েছেন।
ট্রাম্পকে তখন অবশ্যই ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। ওর কারনে অনেকের মন থেকে ইসলামভীতি দূর হয়ে গিয়েছিল। ওরা সাধারণ মুসলিমের সাথে মিশেছে, ভুল ভাল যা ছিল দূর হয়েছে। এ ঘটনা না ঘটালে যা ঘটতো না নিশ্চিত। এই কারণেই আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, ঘটনা যাই ঘটুক না কেন, সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ একজনের হাতেই থাকে। তিনিই পারেন ছাইয়ের স্তুপ থেকে ফিনিক্স পাখিকে ওড়াতে। বহু উকিল ফ্রিতে মামলা লড়েছেন। একে একে ছাড়া পেয়েছেন আটকে পড়া যাত্রীগণ। ইউএসএ সেলিব্রেট করেছে একতাবদ্ধ হবার।
ট্রাম্পের নিয়্যত ছিল পরিষ্কার, চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। কিন্তু ওকে নানাভাবে বাঁধা দিয়েছে সুপ্রিমকোর্ট। ওর অনেক কাজকেই অবৈধ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। নাহলে আড়াইশো বছরে একের পর এক মহান থেকে মহত্তম নেতার কঠোর তপস্যায় নির্মিত এই দেশটা প্রথম সপ্তাহেই ধসে যেত।
কিন্তু আম জনতার ভিড়ে হেট ক্রাইম বেড়েই চললো। দেশের নানানপ্রান্ত থেকে আসতে লাগলো সহিংসতার খবর। মুসলিম নারীর শরীরে আগুন দেয়া হয়েছে। মুসলিম পুরুষের চলন্ত গাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে। মসজিদের ঈমামকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। মারধর করেছে দাড়িওয়ালা লোককে। হিজাব/বোরখা পরিহিতারা নিয়মিতই দুয়োধ্বনির শিকার হয়েছেন। ২০১৭ সালের জুন মাসের দশ তারিখ আমার পাশের শহরের মসজিদের সামনে, যেখানে প্রতি জুম্মার নামাজে আমি যেতাম, কারন আমার অফিসের পাঁচ মিনিট দূরত্বে তার অবস্থান, সেখানে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নিল শ্বেতাঙ্গ এক্সট্রিমিস্টরা। টেক্সাস বলে কথা, ভারী অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করায় আইনি কোন বাঁধা নেই। পুলিশ মজুদ রয়েছে সশস্ত্র পাহারায় যাতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। ওরা ক্রমাগত উষ্কানীমূলক স্লোগান দিয়ে চলেছে।
মুসলিমরাও তখন যে যার বাড়ি থেকে অস্ত্র এনে দেখিয়ে দিয়েছে যে তোদের ঐ খেলনা দিয়ে আমরাও খেলতে পারি। যখন তখন যুদ্ধ লাগি লাগি অবস্থা এমন সময়ে মসজিদ থেকে এক যুবক বেরিয়ে এসে বলল "চলো, একসাথে লাঞ্চ করতে করতে আলোচনা করা যাক।" দল বেঁধে দুই পক্ষ্যই গেল "হালাল গাইজে" লাঞ্চ করতে। আলোচনা শেষে যে যার বাড়িতে ফিরে গেল। ওদের অনেক ভুল বোঝাবুঝির অবসান সেখানেই ঘটে গেছে। ফক্স নিউজের প্রোপাগান্ডা শুনে লাফাতে লাফাতে ওরা বন্দুক নিয়ে মানুষ মারতে হাজির হয়েছিল।
কিন্তু পেনসিলভেনিয়ার সিনাগগের মানুষেরা এতটা ভাগ্যবান ছিল না। সেখানে নৃশংসতম বন্দুক হামলায় নিহত হলেন এগারোজন ইহুদি। গোটা দেশে ইহুদিরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। এইবার ওদের পাশে সবার আগে এসে দাঁড়ালো ওদের মুসলিম "কাজিন" ভাইয়েরা। মানসিক সাপোর্টের পাশাপাশি মুসলিমরা নিজেরা নিজেরা চাঁদা তুলে ওদের ফিউনারেলসহ যাবতীয় আর্থিক সহযোগিতার জন্য টাকা তুলে দিল। আরও নানানভাবেই ওদের সাহায্য করলো। গোটা দেশে নানান সিনাগগে গিয়ে গিয়ে ওদের সাহস দিল। বুঝিয়ে দিল, ওরা একা নয়। আবারও ঘৃণার বিরুদ্ধে ভালবাসা নিয়ে আমেরিকা এক হলো।
এর আগে পরে নানান সময়েই ঘৃণার চাষাবাদ হলো এদেশে। হোয়াইট সুপ্রিমিস্টরা অতীতে শেষ কবে এতটা অনুপ্রাণিত হয়েছিল মনে নেই। প্রকাশ্যে বর্ণবাদী পোস্টার ঝুলাতে থাকে। বিশ্বের বিপরীতপ্রান্তে, ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে যে হামলা হলো, শহীদ হলে অর্ধশতাধিক লোক, সেটাতো এরই যোগসূত্র। অবৈধ অধিবাসীদের জীবনের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়। দেখা গেছে সকালে কেউ বেবিসিটারের কাছে বাচ্চা রেখে কাজে গেছে। সেই কাজের অফিসেই আইস (ইমিগ্রেশন এন্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট) অতর্কিতে অভিযান চালিয়ে অবৈধ অধিবাসীদের গ্রেপ্তার করে ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে গেছে। বেবি সিটার ডেকেয়ারে রয়ে যাওয়া বাচ্চাগুলোর কি হবে? কেউ পরোয়া করেনি।
কয়েক দশক ধরে এদেশে থেকেছেন। এদেশেই ব্যবসা বাণিজ্য চাকরি করে সংসার গড়েছেন। ছেলে মেয়ে বেড়ে উঠেছে। বিশ তিরিশ বছর ধরে নিজের দেশে যাওয়া হয়না। নিজের জন্মভূমি এখন বিদেশ হয়ে গেছে। আইস এসে সেই লোকেদের ধরে ধরে ফেরত পাঠিয়েছে। একদম নিঃস্ব অবস্থায়। জীবনের সব সঞ্চয়, সম্পদ, সম্পত্তি ফেলে এক বস্ত্রে বিদায় নিতে হয়েছে। অনেক বাংলাদেশির ক্ষেত্রেও শুনেছি এমন ঘটনা ঘটেছে।
কাউকে কাউকে পরিবার ছেড়ে যেতে হয়েছে। কাউকে পরিবারকে ছাড়তে হয়েছে। ডিটেনশন সেন্টারে মা বাবা থেকে জোর করে বিচ্ছিন্ন করা পাঁচ শতাধিক শিশুকে ফেরত দেয়ার সময়ে অভিভাবকদের ট্র্যাক খুঁজে পাচ্ছিল না কর্তৃপক্ষ। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। অথচ জনতার একাংশ ছিল নির্বিকার। কারন প্রেসিডেন্ট সাহেব এমনভাবেই এদের উপস্থাপন করেছেন যেন ওরা সবাই ভয়াবহ অপরাধী, ভয়ংকর কোন কীট পতঙ্গ। সমাজের অবক্ষয়ের জন্য ওরা দায়ী!
রিপাবলিকান সরকারের আমলে দেশের মানুষের কিছু লাভ হয়েছে সত্য, যেমন ইনকাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশি ক্যাশ টাকা পকেটে এসেছে। যেই রিসেশন আসি আসি করছিল, সেটা আসতে পারেনি। এক্ষেত্রে ট্রাম্পের সমর্থক না হলেও রিপাবলিকানদের এই নীতির আমি সমর্থক। সহজভাবে বুঝিয়ে বলি। ধরুন সরকারের কাছে ট্যাক্সের একশো টাকা আছে যা জনতার কাছে বিলিয়ে দিতে হবে। জনতার ভিড়ে মজনু ফজলু যেমন আছেন, তেমনই বিল গেইটস, জেফ বেজসও আছেন। ডেমোক্রেটরা করে কি, সবাইকে সমান টাকা ফেরত দেন।
রিপাবলিকানরা মজনু ফজলুকে কম দিয়ে বিল গেইটস ও জেফ বেজসদের বেশি দেয়ার পক্ষপাতী। এর ফলে লাভটা হয় এই যে, বেশি টাকা পেয়ে মাইক্রোসফট এবং এমাজন ব্যবসায় খাটাতে পারে। ফলে আরও বেশি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। বেশি বেশি লোক কাজ করতে পারে। যেখানে মজনু ফজলু বাড়তি টাকা পেয়ে একটা এক্সট্রা ভ্যাকেশন করতে পারে, ক্যাসিনোয় গিয়ে জুয়া খেলতে পারে এবং কিছু বাড়তি বিয়ারের বোতল কিনে খেয়ে টাল হতে পারে। ট্রাম্পের সময়ে তাই বেকারত্বের হার কমে গিয়েছিল অনেক। কোরিয়া বা ইরানের সাথে যুদ্ধ লাগি লাগি করেও লাগেনি।
বিশেষ করে ইরান যখন মার্কিন ক্যাম্পে রকেট হামলা করেছে, তখন একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষে নিজের অহংকার, জেদ, শক্তি নিয়ন্ত্রণে রাখাটা ছিল রীতিমতন অবিশ্বাস্য একটি ব্যাপার। ইরান দখল করতে আমেরিকার তিন সপ্তাহও সময় লাগতো না। এবং এরপরে চলতো কয়েক দশক ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ঝরতো লাখে লাখে প্রাণ, এবং নষ্ট হতো কোটি কোটি ডলার। এসব কিছু ঘটেনি কেবলমাত্র আমেরিকা পাল্টা আক্রমন করেনি বলেই। নিঃসন্দেহে এটি অনেক বড় সাফল্য।
কিন্তু এসবের তুলনায় ক্ষতির পরিমানও ব্যাপক। বিশেষ করে রেসিজম ও হেট ক্রাইম যে পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে, সেটা ইউনাইটেড স্টেটসের ইউনিটি ভেঙ্গে দিতে যাচ্ছিল। এর বিনিময়ে ট্যাক্সে মাসে এক দুইশ ডলার সেভ এমন কোন ঘটনা না। আরও চার বছর যদি ট্রাম্প বা এ জাতীয় কোন ব্যক্তি ক্ষমতায় থাকে, তাহলে আরও কি যে করবে কে জানে! গোটা বিশ্বে এই যে ব্যাপকহারে বর্ণবাদী বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে, এর প্রত্যক্ষ কারন হোয়াইট হাউজের গদিতে এক চরম বর্ণবাদি বসে আছে।
যাক, আশা করি জনতা সেটা বুঝতে পেরেছে। আবারও এক হয়েছে, এবং একযোগে বর্ণবাদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলেছে। ভোট দিয়েছে। যার ফল আমরা দেখতে পারছি, বাইডেনের হোয়াইট হাউজ সিংহাসন থেকে চুল পরিমান দূরত্বে অবস্থান। বাইডেন আসলেই যে পৃথিবী স্বর্গসুখে ভেসে যাবে এমনটা না। সবই নির্ভর করবে আমাদের, মানে সাধারণ জনতার উপর। এইটা আমরা সিদ্ধান্ত যে, আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে কি ধরনের পৃথিবী ছেড়ে যেতে চাই। আমরা যা করবো, ওরা সেটাই পাবে।
লেখাটি ফেসবুক গ্রুপ ক্যানভাসে পূর্বপ্রকাশিত
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন