ট্রাম্প যদি প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়তে না চান, তাহলে কী হবে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
জো বাইডেন জিতে গেছেন, তবু পরাজয় মানতে রাজী নন ট্রাম্প, নিজেকে জয়ী ঘোষণা করে হুমকি দিচ্ছেন সুপ্রীম কোর্টে যাওয়ার। ট্রাম্প কি ক্ষমতা ছাড়বেন আদৌ? না ছাড়লে কী হবে? হোয়াইট হাউজ থেকে তাকে বের করাটা কি সম্ভব?
চারদিন ধরে সরল দোলকের পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা কাঁটাটা স্থির হলো অবশেষে, পেনিসেলভানিয়ায় জিতে বিশটা ইলেক্টোরাল ভোট বগলদাবা করার পাশাপাশি ২৭০- এর ম্যাজিক্যাল ফিগারটাও পেরিয়ে গেলেন জো বাইডেন, নিশ্চিত হয়ে গেল, আগামী চার বছরের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনিই দায়িত্ব পালন করবেন। রিপাবলিকান প্রার্থী এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনও অবশ্য পরাজয় স্বীকার করেননি, গতকালও নিজেকে জয়ী হিসেবে দাবী করেছেন, সুপ্রীম কোর্টে যাওয়ার হুমকি তো আছেই।
আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্প ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন আগামী ২০শে জানুয়ারী। অনেকের মধ্যেই সংশয় কাজ করছে, পাগলাটে এই লোকটা কি না কি করবেন এই ভেবে। ইতিমধ্যেই ট্রাম্পের সমর্থকদের অনেকে অস্ত্র হাতে শো-ডাউন দিয়ে বেড়াচ্ছে টেক্সাস, নিউইয়র্ক, ফ্লোরিডার মতো শহরগুলোতে। সতর্ক অবস্থানে আছে পুলিশ, রিপাবপলিকান আর ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে যাতে কোন গণ্ডগোল না বাঁধে, সেদিকেই খেয়াল রাখছে তারা। আমেরিকায় নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার নজির নেই। কিন্ত ট্রাম্পের চার বছরের শাসনামলে যে উগ্রপন্থার চাষ হয়েছে, সেখান থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত যে কোন কিছুই ঘটতে পারে। পুলিশকে তাই সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতেই হচ্ছে।
নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। পেনিসেলভানিয়া আর নেভাডায় তো দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান কেবল কয়েক হাজার! কাজেই সাংবিধানিকভাবে ট্রাম্পের অধিকার আছে এই ভোটকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যাওয়ার। ভোট পুনঃগণনার দাবী জানানোর। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে খুব একটা লাভ হবে না ট্রাম্পের। বরং নিজেকে এবং আমেরিকার নির্বাচন ব্যবস্থাকেই বিতর্কিত করা হবে। তবে জটিল আইনি ফাঁকফোকর দিয়ে এখনও একটা সংকট তৈরি করার সম্ভাবনা আছে ট্রাম্পের সামনে। আর ধুরন্ধর ট্রাম্প সেই সুযোগটা ছাড়বেন না বলেই ধারনা অনেকের।
তবে সেই ফাঁকফোঁকর খোঁজার আগে বলে নেয়া যাক, আইন অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রমগুলো কি হবে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের জানুয়ারির ২০ তারিখ, দুপুর ১২টায়। একই দিনে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন শপথ নেবেন, আর ডোনাল্ড ট্রাম্প হারাবেন হোয়াইট হাউজে থাকার অধিকার। সাধারণত নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পরাজিত প্রার্থী হাজির থাকেন, ২০০৮ সালে ওবামার শপথ গ্রহণে হাজির ছিলেন জন ম্যাককেইন, ২০১৬-তে ট্রাম্পের শপথ গ্রহণে হাজির হয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী এবং বিচার বিভাগ সহ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ বাইডেনের হাতে চলে আসবে। তখন তিনি চাইলে ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউজ থেকে বিতাড়নের আদেশও দিতে পারবেন।
এখনও পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফল সবটাই মিডিয়ার ঘোষিত, আনুষ্ঠানিকভাবে কোন রাজ্যের ফলাফল এখনও ঘোষণা করা হয়নি। নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কে বিজয়ী হলেন তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার প্রক্রিয়াটা আসলে বেশ দীর্ঘ একটা প্রক্রিয়া। এখন পপুলার ভোটগুলো গোণা হচ্ছে। এই গোণা যখন শেষ হবে তখন তা দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সার্টিফাই করতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা করে থাকেন অঙ্গরাজ্যগুলোর গভর্নর বা সেক্রেটারি অব স্টেট। আগামী ১৪ই ডিসেম্বর পপুলার ভোটের ভিত্তিতে রাজ্যগুলোর ইলেকটোরাল কলেজের সদস্যরা সমবেত হয়ে তাদের ভোটগুলো দেবেন।
সাধারণত নিয়ম হলো - একেকটি রাজ্যে পপুলার ভোটে যে প্রার্থী বিজয়ী হন তিনিই ওই রাজ্যের সবগুলো ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে যান। সেকারণেই পপুলার ভোটের ফল জানার সাথে সাথেই সবাই ধরে নেন যে ইলেকটোরাল ভোটের ফল কী হবে। এখন, যদি এমন হয়, ভোটগণনায় যে ফল পাওয়া গেল- সেটা অঙ্গরাজ্যের কর্তৃপক্ষ সার্টিফাই করলেন না, তখন একটা সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে, সেই রাজ্যে পুনঃনির্বাচনের দাবীও উঠবে। তবে এরকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা অনেক কম, এবং ট্রাম্প যে রাজ্যগুলোর ফল নিয়ে আপত্তি করছেন- সেগুলোতেও অঙ্গরাজ্য কর্তৃপক্ষ সার্টিফাই করবেন বলেই ধারনা করা হচ্ছে।
ট্রাম্পের হাতে শেষ এবং সবচেয়ে বড় আশা যেটা, সেটা হচ্ছে অঙ্গরাজ্যগুলোর আইনসভা এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। ইলেকটোরাল কলেজের সদস্য নির্ধারণ করার দায়িত্ব হচ্ছে অঙ্গরাজ্যগুলোর আইনসভার। আইনসভাগুলো চাইলে জো বাইডেনের সমর্থক প্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে নিজেদের পছন্দমত ইলেকটোরাল কলেজের প্রতিনিধিদের ফেডারেল কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে পারেন। সেক্ষেত্রে ইলেকটোরাল ভোটের দুটো স্লেট হতে পারে একটা হচ্ছে যা আসলেই পপুলার ভোটের রায় প্রতিফলিত করবে- আরেকটি হবে রাজ্যের আইনসভাগুলোর আলাদা করে পাঠানো রায়।
তারা যে ভোট দেবেন তা আবার গোণা হবে জানুয়ারির ৬ তারিখ কংগ্রেসে। কংগ্রেসের সেই বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। তিনি যদি ইলেকটোরাল কলেজের ভোটগুলোর দুটি স্লেটের একটা রেখে অন্যটা ফেলে দেন বা দুটোর কোনটাই গ্রহণ না করেন - তাহলে একটা সাংবিধানিক সংকট দেখা দিতে পারে। এখানে সংকটটা হচ্ছে- ভাইস প্রেসিডেন্ট দুটো স্লেটই প্রত্যাখ্যান করলে কোন প্রার্থীরই ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট হবে না। সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট কে হবেন তা নির্ধারণ করবে কংগ্রেস।
প্রতিটা অঙ্গরাজ্য তখন একটা করে ভোট পাবে। কিন্তু বর্তমানে ২৩টি অঙ্গরাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে ডেমোক্র্যাটদের, ২৬টিতে রিপাবলিকানদের। এভাবে ভোট হলে ২৬টি ভোট পেয়ে যাবেন ট্রাম্প, এবং তিনিই প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন। এটা হবে বিপজ্জনক একটা পরিস্থিতি, এরকম সংকটে আমেরিকা কখনও পড়েনি, এবারও হয়তো পড়বে না, তবে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না একেবারে। এমন কিছু ঘটলে হাউজের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি (যিনি একজন ডেমোক্র্যাট) হয়তো এই প্রক্রিয়া বিলম্বিত করতে বা থামিয়ে দিতে পারেন, তাহলে এক পর্যায়ে তার হাতেও দায়িত্ব এসে পড়তে পারে।
ট্রাম্প চাইছেন গোটা ব্যাপারটাকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে, কারন সুপ্রীম কোর্টে তার মতাদর্শের প্রধান বিচারপতি আছেন, ট্রাম্পের আশা, তিনি হয়তো তার পক্ষে রায় দেবেন। কিন্ত রিপাবলিকান মনস্ক বিচারপতি দলকে দেশের ওপরে ঠাঁই দেবেন কিনা, এটা একটা বড় প্রশ্ন। সবকিছু যে ট্রাম্পের হিসেব অনুযায়ী চলবে, সেরকমটা না-ও হতে পারে, না হবার সম্ভাবনাই বেশি। এর বাইরে ট্রাম্প তার সমর্থক হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট মিলিশিয়াদের রাস্তায় নেমে আসার আহবান জানাতে পারেন, তাতে সহিংসতা বাড়বে। নিজের আখের গোছানোর জন্য ট্রাম্প এতটা নিচে নামবেন কিনা- সেই প্রশ্নের উত্তর সময়ের হাতেই তোলা রইলো।
তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- বিবিসি ও ড. আলী রিয়াজ।