ট্রেভর ওয়ালফোর্ড ছিলেন বাকিংহামের প্যালেসের প্রধান কর্মকর্তা। সেখান থেকে বের হয়ে এসে করেছেন অজস্র সব চাকরী। শেষ বয়সে চাকরী হারিয়ে হয়েছেন বেকার। এরপর চাকরীর জন্যে করলেন যে অদ্ভুত কাজ, তা বিস্মিত করেছে সবাইকে!

সাদাত হোসেন মান্টো একবার বলেছিলেন,

জীবন কে যেই মুহুর্ত থেকে আপনি বিশ্বাস করবেন, আপনি ভুল করবেন।

কথাটি আসলে গভীর ভাবনার। সে ভাবনায় আপাতত না যাই। ভাসাভাসা ভাবেও যদি দেখি, তাহলে বুঝতে পারবো, জীবন বরাবরই অদ্ভুত, অনিশ্চিত এক কনসেপ্ট। সেরকমটাই আমরা দেখি বিভিন্ন মানুষের জীবনে। সবার জীবনের গল্পই মূদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তবে কখন কোন পিঠ আসবে, সেটি জানে না কেউই। এই যেমন 'ট্রেভর ওয়ালফোর্ড' নামের ভদ্রলোকের কথাই ধরুন না কেন। পুরো জীবনটাই কী ওলটপালটের তার! খুব অল্প বয়সে বাকিংহাম প্যালেসে চাকরি করতে ঢুকেছিলেন৷ এরপর নানা উত্থানপতন এর পর বৃদ্ধ বয়সে এসে হয়েছেন বেকার। আবার চাকরীও জুটিয়েছেন। তাও অভিনব পদ্ধতিতে। গল্প তা নিয়েই।

ট্রেভর ওয়ালফোর্ড সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি, তার লিঙ্কডইন এর পোস্ট থেকে। তিনি চাকরী খুঁজছেন। বয়স ৬৩! তখনই আগ্রহ জন্মায় তাকে নিয়ে। জীবনবৃত্তান্ত ঘাঁটতে গিয়ে পেলাম আরো বিস্ময়কর তথ্য। তিনি শিক্ষানবিশ কর্মী হিসেবে বাকিংহাম প্যালেস এ যখন যুক্ত হন, তখন তার বয়স পনেরো বছর! সেখান থেকে তিনি বাকিংহাম প্যালেসের প্রধান কর্মকর্তা হন। সেখানে কাজ করেন অনেকটা দিন।

এখান থেকে বের হয়ে তিনি কাজ করেছেন অনেক জায়গায়৷ এবং কর্মক্ষেত্রের সবখানেই বেশ সফলও ছিলেন তিনি। যুক্তরাজ্য ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের অনেক নামীদামী হোটেলে কাজ করেছেন। এরমধ্যে ছিলো লন্ডনের বিখ্যাত রিটজ হোটেলও। শেষে তিনি যুক্ত হন একটি ক্রুইজ লাইনের সাথে। ২০০৬ সালে। এই ক্রুইজ লাইনের সাথে তিনি ছিলেন গত চৌদ্দ বছর।করোনাভাইরাস শুরুর পর যখন সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছাঁটাই চলছে, তখন ক্রুইজ কোম্পানির পক্ষ থেকে এক সকালে এক মেইল পান তিনি। সেখানে লেখা, তাকে ছাঁটাই করা হচ্ছে। কোম্পানির পক্ষে তাকে রাখা আর সম্ভব নয়।

মহাফাঁপড়ে পড়লেন ওয়ালফোর্ড। এই বৃদ্ধ বয়সে এসে হয়ে গেলেন বেকার! কিন্তু তিনি এত সহজে দমে যাওয়ার পাত্রও না। লিঙ্কডইন এ একটা পোস্ট করে দিলেন নিজের সিভিসহ, চাকরীর জন্যে। সেই পোস্ট ভাইরাল হলো। কিন্তু চাকরীর অফার নিয়ে কেউ এলো না। তবে তিনি জনপ্রিয় হয়ে গেলেন সারাবিশ্বে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া সবখানেই তার গল্প মানুষকে আকৃষ্ট করলো। মানুষকে বিষাদগ্রস্ত করলো। কিন্তু সমস্যা একটাই। কেউ তাকে চাকরী দিচ্ছে না তখনো। মানুষ 'আহা-উহু' করছে, কিন্তু চাকরীর বেলায় কেউ আর সাড়া দিচ্ছে না।

এরপর তিনি চরমপন্থা অবলম্বন করলেন। নিজের সবচেয়ে দামী স্যুট গায়ে চাপিয়ে এবং মুখে মাস্ক লাগিয়ে হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে চলে গেলেন রেল স্টেশনে। সাথে নিলেন ১০০ কপি প্রিন্ট করা নিজের সিভি। চাকরীর জন্যে নিজেই দাঁড়ালেন রাস্তায়৷ এই স্টান্টবাজি করা ছাড়া হাতে আর কোনো উপায়ও ছিলো না।এবং এই বিষয়টা আখেরে বেশ কাজেও দিলো। চুরাস্কো'র সিইও রব ক্যাম্পবেলের নজরে পড়লেন তিনি। তাকে ইন্টারভিউ এর জন্যে ডাকা হলো।

চাকরীর জন্যে এভাবেই প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি!   

ঘন্টাখানেক ইন্টারভিউ এর পরেই তিনি সিলেক্টেড হন চাকরীর জন্যে। ট্রেইনিং ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত তিনি। তার এখন একটাই কাজ,  তিনি খবরদারি করবেন এই কোম্পানির ৩৩৭ জন কর্মীর ওপরে, যারা কর্মরত আছেন এই কোম্পানির ইংল্যান্ডের ১০টি শাখায়। ওয়ালফোর্ড নিজেও ভাবেন নি, এভাবে চাকরী পেয়ে যাবেন তিনি। ভাবেন নি, চুরাস্কো'র সিইও রব ক্যাম্পবেলও। তারা বেশ ক'দিন ধরেই ভাবছিলেন এক্সপার্ট একজনকে তাদের হোটেল ব্যবসায় নিয়োগ করবেন। তখনই ওয়ালফোর্ডকে পেয়ে যান তারা কাকতালীয়ভাবে। এবং হোটেল ব্যবসার ক্ষেত্রে ওয়ালফোর্ডের জ্ঞান যে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে, তা ইন্টারভিউ থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো। তাই এই মানুষটিকে নিয়োগ না দেয়ার কোনো কারণই ছিলো না তাদের কাছে।

ওয়ালফোর্ডের গল্প শুনে আমার প্রথমেই মনে এসেছিলো অনেককাল আগে দেখা রবার্ট ডি নিরো অভিনীত 'দ্য ইন্টার্ন' সিনেমাটি, যেখানে ডি নিরো বৃদ্ধ বয়সে এসে কাজ করছেন একটি সংস্থার সাথে। বয়সজনিত যোগসূত্রের কারণে ওয়ালফোর্ড এর গল্প আমার মনে ধরে যায়। সে সাথে এটাও উপলব্ধি হয়, যে মানুষটি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বাকিংহাম প্যালেস থেকে, সেখান থেকে ভাগ্যের ফেরে কত জায়গাতেই না যেতে হয়েছে তাকে! শেষপর্যন্ত সব হারিয়ে আরেকটা চাকরী যখন পেলেন, তার আগেও হয়ে গেলো একপ্রস্থ নাটকীয়তা।

হয়তো এই নাটকীয়তাগুলোই আছে বলেই জীবন এত ধূসর রহস্যময়, জীবন এত ভয়ঙ্কর সুন্দর। অন্তত ট্রেভর ওয়ালফোর্ডের গল্প তো সেরকমই বলে।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা