জীবনে সুখী থাকার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো টক্সিক মানুষজন। তাই জীবন থেকে টক্সিক মানুষগুলোকে মুছে ফেলে, শুধু তাদের সাথেই যোগাযোগ রাখুন, যাদের সাথে দুদণ্ড সময় কাটালে ইতিবাচক অনুভূতি সৃষ্টি হবে, সুখময় ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা যাবে। কীভাবে চেনা যাবে টক্সিক মানুষ?

১. তারা মানুষকে ইমোশনালি দুর্বল করে দেয়। তাদের যদি কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদ বা তর্ক হয়, তারা এমনভাবে সেটার সমাপ্তি টানে (যেমন: 'আচ্ছা যাও, তুমিই সবসময় ঠিক, আর আমিই সবসময় ভুল') যেন অপরদিকের মানুষটাকেই মনে মনে যন্ত্রণা পেতে হয়।

২. তারা এমন একটা ভাব দেখায় যেন তারা সবই বোঝে। কিন্তু আসলে তাদের মাঝে আত্মকেন্দ্রিকতা ছাড়া আর কিছুই নেই। অন্য কেউ তার নিজের কোনো দুঃখ-কষ্টের কথা শেয়ার করলেও, তারা সেটাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের ব্যাপারে কিছু বলতে শুরু করে। অর্থাৎ তারা অন্যের মাঝে এমন একটা চিন্তার জন্ম দেয় যেন কেবল তাদের অনুভূতি বা অভিজ্ঞতাগুলোই মুখ্য, বাকি সবারটা গৌণ। 

৩. সহানুভূতিশীলতা বলতে কোনো শব্দ তাদের অভিধানে থাকে না। পৃথিবীটা তাদের জন্য একদমই একচোখা। তাদের নিজেদের যদি কিছুতে সমস্যা হয়, তাহলেই শুধু সেটা সমস্যা। আর যদি তাদের কিছুতে সমস্যা না হয়, অন্য কারো যে সমস্যা হতে পারে, সেটা তারা বোঝার চেষ্টাও করবে না।

৪. তারা সবসময় অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। খুব ছোট ছোট বিষয় থেকে শুরু করে লাইফ চেঞ্জিং ডিসিশন, সবখানে তারা নিজেদের মতটাকেই চাপিয়ে দিতে চায়। কিন্তু এত সূক্ষ্মভাবে তারা কাজটি করে যে মনে হয় তারা যা করছে, অন্যের ভালোর জন্যই করছে, কিংবা সিদ্ধান্তটা আসলে অন্য কারোই নেয়া, তারা তাতে শুধু সায় দিচ্ছে। এভাবেই তারা ইমোশনালি অন্যকে কন্ট্রোল করে, ম্যানিপুলেট করে। 

৫. তারা সাধারণত কাউকে কোনো কাজের জন্য ধন্যবাদ দেয় না, কিংবা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। আর ভুলবশত কখনো যদি করেও বসে, তখনো তাদের শব্দচয়ন এমন হয় যে শ্রোতার মনে ভালো লাগার অনুভূতি জন্মানোর পরিবর্তে খারাপ লাগার অনুভূতিই সৃষ্টি হয়। যেমন: 'তুমি আমার অনেক উপকার করলে, যদিও আমার এক্সপেকটেশন ভিন্ন কিছু ছিল।'

৬. তারা কোনো জিনিসের ভালো দেখতে পারে না। কিংবা ভালো জিনিসগুলোকে তারা টেকেন ফর গ্র‍্যান্টেড বলে মনে করে। তারা যেকোনো জিনিসের শুধু খারাপ দিকগুলোতেই ফোকাস করে। তাদের কথাবার্তায় শুধু হতাশা, রাগ, ক্ষোভ ইত্যাদি প্রকাশ পায়। তাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললে মনে হবে যেন দুনিয়ার সবকিছুই খুব খারাপ। ইতিবাচকতার কোনো স্থান এখানে নেই। ফলে তারা কাউকে কখনো অনুপ্রাণিত করতে পারে না। পারে শুধু অন্যের আত্মবিশ্বাস বা মনোবল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে।

৭. তারা নিজেদেরকে সবসময় ভিকটিম মনে করে, সবার সামনে নিজেদেরকে দুঃখী হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। যেকোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই তারা উঠেপড়ে লাগে এটি প্রমাণ করতে যে এতে ক্ষতিটা তাদেরই সবচেয়ে বেশি হয়েছে, সুতরাং অন্য কারো কিছু বলার থাকতে পারে না। এভাবেই তারা অন্যের মুখ বন্ধ করিয়ে দিয়ে সবটুকু এটেনশন নিজেদের দিকে টেনে নিতে চায়।

৮. তারা অনেক বেশি নেগেটিভ এনার্জি তৈরি করে। কেউ যদি চায় খুব বাজে পরিস্থিতিতেও নিজেদের মানসিক ইতিবাচকতা ধরে রাখতে চায়, তারা তা হতে দেয় না। যেমন: কেউ হয়তো বলল, 'ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে, আমরা আবার আগের মতো আনন্দ করতে পারব।' জবাবে তারা বলবে, ' না না, আমি সেরকম কোনো লক্ষণই দেখতে পাচ্ছি না। সামনে আমাদের জন্য আরো কঠিন দুঃসময় অপেক্ষা করছে।'

৯. তারা অন্যের ব্যাপারে খুব খোলামেলা আর নিজেদের ব্যাপারে খুব রক্ষণশীল হয়। অন্য কারো ব্যাপারে মজা নেয়ার বেলায় তারা দুবার ভাবে না। কেউ যদি তাদের মজায় কষ্টও পায়, তারা বলে, 'কী ভাই, তুমি একটা সিম্পল জোকও নিতে পারো না!' অথচ সেই তাদেরই বিরুদ্ধে কেউ যদি কিছু বলে বা তাদের নিয়ে মজা করে, তারা ট্রিগার্ড হয়ে যায়, এমন একটা ভাব দেখায় যেন তাদের নিয়ে কারো কোনো কথা বলার অধিকারই নেই।

১০. তারা কোনো ব্যক্তির আড়ালে তার ব্যাপারে নিন্দামন্দ করতে খুবই পছন্দ করে। বলা যায় তাদের অবসর সময় কাটানোর সবচেয়ে ভালো উপায়ই হলো অন্যের ব্যাপারে কথা বলা, অন্যকে জাজ করা, এবং পরোক্ষভাবে এটা প্রমাণ করা যে অন্য সবাই খারাপ, শুধু তারাই ভালো। 

১১. তারা কখনো কারো কাছে ক্ষমা চায় না। তাদের আচরণে কেউ যদি অত্যন্ত কষ্ট পেয়ে থাকে, এবং সেটা সাফ জানিয়েও দেয়, তবু তারা ভদ্রতার খাতিরেও দুঃখ প্রকাশ করে না। এমন একটা গোঁ ধরে বসে থাকে যেন দুঃখিত হলে তাদের জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে, এবং নিজেদেরকে যেকোনোভাবেই হোক সঠিক প্রমাণ করতে পারার মাঝে, তাদের জীবনের সার্থকতা নিহিত। আবার কেউ কেউ তাচ্ছিল্যভরে বলে, 'আচ্ছা যাও, আমি সরি।' এরপর তারা বারবার মনে করিয়ে দেয়, 'আমি কিন্তু সরি হয়েছিলাম!'

১২. কারো জন্য কিছু করার পর সেটা তারা চেপে রাখে না। বরং ঢাকঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানান দেয় যে কার জন্য তারা কী কী করেছে। এখানেও তারা অনেকটা ভিকটিম কার্ড প্লে করার চেষ্টা করে, 'আমি ওর জন্য এই এই ভালো করেছি, তার প্রতিদানে ও আমার সাথে এই এই খারাপ করেছে।'

১৩. তারা অত্যন্ত ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে থাকে। কারো সফলতা বা উন্নতি তাদের দুই চোখের বিষ। তাদের আশেপাশের কেউ যদি সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায়ও খুব ভালো কোনো অবস্থানে যায়, তারা সেটি সহ্য করতে পারে না। বরং সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় সফল ব্যক্তিটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে, তাকে টেনে নিচে নামাতে। যেমন: কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলে তাদের প্রথম কথাই হয়, 'আরে ও তো প্রশ্ন কিনেছিল!'

১৪. তারা যেকোনো আলাপচারিতায় কেবল সেই পর্যন্তই আগ্রহ দেখায়, যতক্ষণ সেটির নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে রয়েছে। যখনই তারা দেখে যে অন্যপাশের মানুষটিও কিছু বলতে শুরু করেছে, তখন আর তাদের মাঝে কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। তখন তারা কোনো একটা অজুহাতে মাঝপথেই আলোচনার ইতি টানে। একইভাবে যেকোনো তর্কের ক্ষেত্রেও নিজেদের যুক্তিটা তারা সবিস্তারে পেশ করলেও, অন্যের যুক্তিতে মনোনিবেশের চেষ্টাই করে না। অর্থাৎ, সবক্ষেত্রেই নিজেদেরকে অন্যের চেয়ে বড় জাহির করার একটা প্রবণতা তাদের মাঝে লক্ষ্য করা যায়।

জীবনে সুখী থাকার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো এমন টক্সিক মানুষজন। তাই আমি এই লকডাউনের ভিতর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি জীবন থেকে টক্সিক মানুষগুলোকে মুছে ফেলার, এবং শুধু তাদের সাথেই যোগাযোগ রাখার, যাদের সাথে দুদণ্ড সময় কাটালে ইতিবাচক অনুভূতি সৃষ্টি হবে, সুখময় ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা যাবে। এখন পর্যন্ত এই কাজে অনেকটাই সফল হয়েছি। যাদেরকে আমার কাছে টক্সিক বলে মনে হয়, তাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে, এবং ইতিবাচক মানুষদের সাথে কথা বলা বাড়িয়ে দিয়ে, এখন মানসিকভাবে অনেকটাই ভালো আছি। 

কিন্তু জরুরি যে বিষয়টা সাধারণত নজর এড়িয়ে যায় তা হলো, টক্সিক মানুষজনকে না হয় এড়িয়ে চললাম, কিন্তু আমি নিজেই টক্সিক না তো? সেক্ষেত্রে আমার আশেপাশের মানুষজন যেমন আমার সান্নিধ্যে কষ্ট পাবে, তেমনই আমি সারাদিন নিজের সাথে সময় কাটাতে গিয়েও নিজেকে নানাভাবে কষ্ট দেব। ফলে শতভাগ সুখ বা স্বস্তি আমার পক্ষে লাভ করা সম্ভব হবে না। তাই এই তালিকাটি করলাম, এবং আমার মনে হয় এই তালিকার অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যই আমার মাঝে খুব ভালোভাবে বিদ্যমান। আমি চেষ্টা করব, এই বাজে অভ্যাসগুলো কাটিয়ে ওঠার। কারণ নিজে নন-টক্সিক হতে পারাটাই মানসিক সুখের প্রধান সোপান।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা