আমাদের পাশ্ববর্তী দেশের মতো বিদেশীরা কি সত্যিই স্বাচ্ছন্দ্যে বাংলাদেশে আসতে পারেন? পর্যটকরা যে কারণে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে আগ্রহী হচ্ছেন না...
নাস ডেইলির একটা ভিডিও'র কথা মনে পড়ছে এই মুহুর্তে। তিনি পৃথিবীর বহু দেশ ঘোরা মানুষ, কিন্তু এখন পর্যন্ত তার বাংলাদেশে আগমণ ঘটেনি। সম্ভবত, ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় তিনি একটি ভিডিও বানিয়েছিলেন, দিস কান্ট্রি নিডস এটেনশন শিরোনামে। তিনি তুলে ধরেছিলেন নিরাপদ সড়কের দাবিতে আলোচিত সেই কিশোর বিদ্রোহের চালচিত্র। নাস ডেইলিকে তখন থেকেই আমাদের দেশে অধিক সংখ্যক মানুষ চিনতে শুরু করেন।
নাস ডেইলি তার অন্য এক ভিডিওতে বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশ সহ কয়েকটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশে আসতে চেয়েও পারেননি। কারণ, তার পাসপোর্ট। তিনি যেহেতু একজন প্যালেস্টাইনি-ইসরায়েলি নাগরিক তাই তিনি বাংলাদেশে আসার অনুমতি পাননি। রোহিঙ্গাদের সাথে তার একটি প্রজেক্টে অংশ নেয়ার কথা ছিল বাংলাদেশে, কিন্তু তিনি আসতে পারেনি ভিসা রিজেকশনের কারণে। তিনি সেই ভিডিও'তে বলেছিলেন তাকে প্যালেস্টাইনি কিংবা ইসরায়েলি হিসেবে না দেখে নাস হিসেবে দেখতে। যাহোক, দেড়শো দেশের অধিক ঘুরে ফেলা নাস ডেইলির মতো লোক বাংলাদেশে নাহয় আসতে পারনি, ইসরায়েলের সাথে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই কিংবা অন্য কোনো কারণে।
কিন্তু, এমনিতেও বিদেশীরা কি সত্যিই স্বাচ্ছন্দ্যে বাংলাদেশে আসতে পারেন? আমাদের পাশ্ববর্তী ভারত, নেপাল, ভূটানের মতো দেশ। সেই হিসেবে আমাদের দেশে বিদেশী পর্যটক এমনিতেই কম। পর্যটকরা কেন বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে আগ্রহী হচ্ছেন না, তার বিবিধ কারণ আছে। কিছু কারণ, আজকে বলে যাই। এই বিষয়ে সলো ট্রাভেলার অফ বাংলাদেশ গ্রুপে ফরহাদ প্রধান ভাইও লিখেছেন। তার লেখা দেখেই মনে হয়েছে বিষয়টি নিয়ে লেখা দরকার। ট্যুরিজম সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকরা বিষয়গুলো ভেবে দেখতে পারেন।
ভিসা- প্রথমত বাংলাদেশীরা যেমন বর্তমানে ভিসা ছাড়া ৪২টির মতো দেশে ভ্রমণ করতে পারেন, তেমনি বাংলাদেশেও অনেক দেশের নাগরিক ভিসা ছাড়া আসতে পারেন৷ সেই দেশগুলো কোনগুলো? আমরা নিজেরাই জানি না, জানেন না হয়ত আগ্রহী পর্যটকরাও। যেদেশের নাগরিকরা ভিসা ছাড়াই বাংলাদেশে আসতে পারেন, তাদের উদ্দেশ্যে কি আমাদের বিশেষ কোনো ব্র্যান্ডিং হয়েছে কিংবা এই তথ্যটি কি খুব প্রচলিত সেই দেশের নাগরিকদের মধ্যে? সম্ভবত না।
দ্বিতীয় কথা হলো, ভিসার প্রসেসটাও খুব একটা সহজ না। বাংলাদেশের ভিসা প্রাপ্তিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন মাসেরও অধিক সময় লেগে যায়। ভিসা ফিও নাকি বেশি৷ ১০০-২০০ ডলার! অন এরাইভাল ভিসা ফি প্রতিবার ৫০ ডলার! এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে এরকম প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে কতজন বিদেশী ট্রাভেলার আগ্রহী থাকবেন বাংলাদেশে আসতে! পর্যটন-কেন্দ্রিক পরিকল্পনাতে এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভাবা উচিত। পর্যটন খাত থেকে রাজস্ব আয়ের ইচ্ছা থাকলে ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি প্রসেস এস্টাবলিশ করতেই হবে, বিকল্প কিছু নেই৷
যাতায়ত সমস্যা- আপনি খেয়াল করেছেন, আমাদের দেশ থেকে পৃথিবীর অনেক দেশেই সরাসরি যাওয়া যায় না। কারণ, সরাসরি বিমান নেই। ট্রানজিট ব্যবহার করতে হয়। সময়ক্ষেপন হয়, টিকেটের দামও বেশি দিতে হয়। এই একই সমস্যা বিদেশীদের ক্ষেত্রেও। তারা যখন আমাদের দেশে আসতে চান, তখন কিভাবে আসবেন, সেই ভাবনাতেই আগ্রহে ভাটা পড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়। আমাদের ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যদি হাব হত, তাহলে হয়ত এই সমস্যা কিছুটা কমত।
থাকার সমস্যা- আমার এক বন্ধু কয়েকদিন আগে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া - তিনদেশে একসাথে ভ্রমণ করতে গেছে। সে জানালো অনলাইনে হোটেল বুকিং দিলে বরং তুলনামূলক কম খরচে রুম পাওয়া যায়। অনস্পট কখনো কখনো খরচ বেশি। কিন্তু আমাদের দেশের বেলায় উল্টো। বাংলাদেশে কোনো বিদেশী পর্যটক অনলাইনে যে টাকায় বুকিং দিয়ে আসলেন, এদেশে এসে দেখলেন তার তিনভাগের এক ভাগ অর্থ দিয়ে এর চেয়ে ভাল রুম পাওয়া যায়। সেই বিদেশীর মনে তখন স্বভাবতই বিরুপ ধারণা সৃষ্টি হতে পারে বাংলাদেশ নিয়ে। হয়ত সে তার জীবদ্দশায় আর কাউকে রিকোমেন্ড করবে না বাংলাদেশে যাওয়ার জন্যে।
অথচ, ভুটান ঘুরে এসে আমাদের বাঙ্গালি বন্ধুরাই বলে আবারো যাবো দোস্ত, তুইও যাবি চল। আমাদের দেশে কিছু পর্যটন স্পটে গেলে বিদেশী কেন স্বদেশী মানুষদের সাথেই তারা কিভাবে প্রতারণা করে তার উদাহরণ পাওয়া যাবে ভুরি ভুরি। এদেশে অনেক পর্যটন স্পটের সিজনাল ব্যবসায়ীরা ভাবে, 'পাইছি ট্যুরিস্ট, কামাইয়া লই।' এই মনোভাব দেশের পর্যটনকে ধ্বসিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। এজন্যে ইদানিং কালে মানুষ অভ্যন্তরীণ ট্যুরের চেয়েও ভারত, নেপাল, ভুটান ভ্রমণে বেশি উৎসাহী হচ্ছে। এটার হার আরো বাড়বে যদি না আমাদের ট্যুরিজমের মৌলিক জায়গাগুলোর অবনতি হ্রাস না পায়।
খাবার দাবার- কারো কারো কাছে খাবারের গুরুত্বটা সবচেয়ে বেশি৷ অনেক পর্যটক থাকেন, যার আগ্রহ থাকে স্থানীয় খাবার টেস্ট করার দিকে। আমাদের দেশের খাবারের কি অবস্থা তা প্রতি রমজানে টিভি খুললে বেশ ভালো চোখে পড়ে। নামিদামি ব্র্যান্ড, রেস্টুরেন্টগুলোতে যে পরিমাণ ভেজাল খাদ্য পাওয়ার খবর আমরা শুনি, লোকাল রেস্টুরেন্ট বা খাবারের দোকানে কি দশা থাকে তা বলাই বাহুল্য। এই খাবারের দিকটা আসলে শুধু পর্যটকদের কথা ভেবেই নয়, সাধারণ মানুষের কথা ভেবেও এইদিকটা নিয়ে একটু সিরিয়াসলি কাজ করা উচিত৷ ভেজাল খেতে খেতে আমরা সর্বংসহা হয়ে পড়ছি বটে, কিন্তু আদতে যে ক্ষতি হচ্ছে তার ক্ষত খুব গভীর। ধীরে ধীরে হয়ত আমরা বুঝব, আমরা এমন এক জাতি যারা কিভাবে নিজেদের মানুষদের নিজেরা তিলে তিলে মারছি।
লোকাল ট্রান্সপোর্ট- ভারতে রাত দুইটা বাজেও যদি আপনি কোনো ট্যাক্সি নেন, ভাড়া মিটারে যা আসবে বা যা নির্ধারিত সেই ভাড়াই কেবল আপনার পে করতে হবে। কোনো জুয়াচুরি নেই৷ ভারত তো পাশের দেশ, আরো উন্নত কোনো দেশে যান, যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে অন্তত আপনাকে কষ্ট করতে হবে না আর যা-ই হোক। ট্রেন, বাস সব কিছু সুষ্ঠু নিয়মে চলতে দেখবেন। আমাদের দেশেই কথা একবার শুধু চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন।
সকাল বেলা রিকশাওয়ালা যখন বুঝে এটা অফিস টাইম, সে ভাড়া দ্বিগুণ চাইবে। সিএনজি পাওয়া এবং একই সাথে মিটারে যেতে রাজি- এমন যদি কোনোদিন খুব দ্রুত ঘটে সেদিন আপনি নিজেই অবাক হয়ে যাবেন। আর বাস? বাদুরঝোলা কাকে বলে নিজে প্র্যাকটিক্যালি জেনে যাবেন এশহরের বাসে উঠে। ট্রেন? ঢাকা নারায়ণগঞ্জ ট্রেনের প্রতিদিনের চিত্র একবার দেখেই শান্তি। আমাদের গণপরিবহনের অবস্থা ও অভিজ্ঞতা আমাদের জন্যেই খুব সুখকর নয়। বিদেশীদের কি অবস্থা হবে, তা ভেবে বেচারাদের জন্যে নিজেরই খারাপ লাগছে। আর কোনো সলো নারী বিদেশী ট্রাভেলার হলে তার নিরাপত্তা ইস্যু নিয়েও ভাবার আছে৷
চিকিৎসা - আরেকটি মৌলিক প্রয়োজন। কিন্তু একজন ট্রাভেলার যদি সরকারি হাসপাতালে বিকেলের দিকে যান, গেলে দেখবেন হয়ত সেখানে নেই কোনো কর্তব্যরত ডাক্তার। প্রাইভেটে গেলে গুণতে হবে অনেকগুলো টাকা। সামান্য সমস্যায় অনেকগুলো টাকা গচ্ছা দেয়ার পর কোনো বিদেশী ট্রাভেলার কেমন বোধ করবেন ভাবতেই পারছেন নিশ্চয়ই।
প্যাকেজিং- কি চমৎকার সব প্যাকেজ দেখেছি, বেশি দূর না, এশিয়ার দেশগুলো নিয়েই। অনেক রকম প্যাকেজ, যার যেভাবে সুবিধা কাস্টোমাইজ করে নেয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশে কাস্টোমাইজ প্যাকেজ পাওয়ার আশা করা যেমন তেমন - দৃষ্টান্ত দেখাবার মতো কোনো ট্যুর পরিকল্পনাও চোখে পড়বে না বাংলাদেশ নিয়ে। একজন বিদেশী নিসচয় গায়েবি খবর পাবেন না বাংলাদেশ সম্পর্কে। তাকে জানানোর উপায় থাকতে হবে। বাংলাদেশে ভিজিট বাংলাদেশ নামক একটা ওয়েবসাইট ছিল, সেটা এখন বন্ধ। আর ট্যুরিজম বোর্ড, পর্যটন কর্পোরেশনের ওয়েবসাইটও এমন আহামরি কোনো ইনফো হাব হয়ে যায়নি এখনো।
এছাড়া, নিরাপত্তা ইস্যু, সাংস্কৃতিক ভাবে রিজার্ভড মানসিকতা, প্রায় ৮০ শতাংশ দেশের বাংলাদেশে কোনো হাইকমিশন না থাকা, সময় মেনে চলার মানসিকতা না থাকা ইত্যাদি কারণ তো আছেই। এসব কিছু ছাপিয়েও যে বিদেশী ট্রাভেলার বাংলাদেশে আসে তাকে বরং ফুল দিয়ে বরণ করে উচিত আমাদের!