যেকোনো ট্যুরের সফলতা বা ব্যর্থতা অনেকাংশেই নির্ভর করছে তার প্রস্তুতির উপর। চলুন চোখ বোলানো যাক এমনই কিছু কাজের ও চিন্তার ওপর, যেগুলো ট্যুরের আগেই আপনার করে বা ভেবে নেয়া আবশ্যক।

আমাদের প্রাত্যহিক ছকে বাঁধা জীবনে একটুখানি শান্তির হিমেল পরশ নিয়ে আসে বিভিন্ন ট্যুর। বিশেষ করে যারা ঢাকা শহরের জ্যামে সিদ্ধ হয়ে নয়টা-পাঁচটা অফিস করেন, কিংবা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভার্সিটি ক্যাম্পাসে নানাবিধ কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকেন, তাদের ক্লান্তিতে ওষ্ঠাগত জীবনে কয়েকটা দিনের সজীবতা এনে দিতে পারে ট্যুরগুলো। 

নানা রকমের ট্যুরই তো দেয়া যায়। পরিবারের সদস্যদের সাথে, বন্ধুদের সাথে, কিংবা অফিস কলিগদের সাথে। সঙ্গীদের সাথে আপনার সম্পর্কই নির্ধারণ করে দেয় ট্যুরের চরিত্র। তবে শেষ পর্যন্ত ট্যুরটি যে চরিত্রেরই হোক না কেন, সেই ট্যুরটির সফলতা বা ব্যর্থতা নির্ভর করে বিশেষ কিছু ব্যাপারের ওপর। এবং সেই সবগুলো ব্যাপার হয়তো আগে থেকে ঠিক করে নেয়া যায় না। কিন্তু এমন কিছু কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো সম্পর্কে ট্যুরের আগেই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা যায়। চলুন চোখ বোলানো যাক এমনই কিছু কাজের ও চিন্তার ওপর, যেগুলো ট্যুরের আগেই আপনার করে বা ভেবে নেয়া আবশ্যক।

আগে থেকেই উত্তেজিত হবেন না, একটু ভাবুন

একটু আগেই যেটা বলছিলাম, আপনার সঙ্গী কারা সেটির উপরই ট্যুরের চরিত্র অনেক বেশি নির্ভর করে। কেউ একটা ট্যুরে যাচ্ছে শুনেই হুট করে অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে তাতে নাম লিখিয়ে ফেলাটা খুব বড় রকমের বোকামি। হতে পারে আপনি অনেক এক্সট্রোভার্ট একজন ব্যক্তি, সবার সাথে মানিয়ে-গুছিয়ে চলতে পারেন, তাই যে কারও সাথে ট্যুর দিতেই আপনার কোন সমস্যা নেই। 

কিন্তু একই সাথে আপনার অন্যদের কথাও একবার চিন্তা করে নেয়া জরুরি। আপনি অন্যদের সাথে যেভাবে মানিয়ে নিতে পারছেন, অন্যরা হয়ত তা না-ও পারে। আর সেজন্যই আপনার উচিৎ হবে ট্যুরের আগেই আপনার যাত্রাসঙ্গীরা কেমন হবে, আপনি তাদের কাছে ওয়েলকামিং কিনা এসব বিষয়ে নিজের মনে মনে খানিকটা পর্যালোচনা করে নেয়া। যদি দেখেন যে অন্যদের মাঝে গিয়েও আপনি নিজের স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারছেন, এবং তাতে কেউ এতটুকু বিরক্ত হচ্ছে না বরং আপনার সঙ্গ তারা উপভোগ করছে, কেবলমাত্র তবেই ওই ট্যুরকে হ্যাঁ বলুন।

কয়জনের ট্যুর

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ট্যুরে কয়জন যাবেন সেই সংখ্যাটা নির্ধারণ করা। যদি এমন হয় যে আপনি একজন রেগুলার ট্র্যাভেলার, কয়েকদিন পরপরই বিভিন্ন ট্যুরে যান, এবং ট্যুর দেয়াই আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় প্যাশন, তাহলে আপনার উচিৎ খরচের ব্যাপারে লক্ষ্য রাখা। কারণ এই ট্যুরই তো আপনার শেষ ট্যুর না, ভবিষ্যতে আরও অনেক ট্যুর দিতে হবে! সেজন্য আপনার প্রধান চিন্তা হবে খরচ কতটা কমের মধ্যে রাখা যায়। 

যদি আপনি অনেকের সাথে মিলে ট্যুরে যান, তাহলে পার হেড খরচ অনেকটাই কমে আসবে। যেমন ধরুন কোথাও যেতে গাড়ি বা নৌকা রিজার্ভ করতে হবে। এখন চারজনে গেলে পার পারসন যে খরচ হতো, দশজন গেলে নিঃসন্দেহে তার চেয়ে অনেক কম খরচ হবে। তাছাড়া অনেকে মিলে ট্যুরে গেলে বিপদ আপদের আশংকাও অনেকাংশে কমে যায়।

কয়জন মিলে ট্যুরে যাবেন, তা আগেই নির্ধারণ করুন 

এ তো গেল অনেকে মিলে ট্যুরে যাওয়ার ভালো দিকগুলো। কিন্তু কিছু খারাপ দিকও আছে। যেমন একসাথে অনেকে মিলে ট্যুরে গেলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সদস্যরা নিজেদের মধ্যে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যায়। আর তারপর একটা সময় এসে গ্রুপিং-ও শুরু হয়। একটা ট্যুরে গিয়েছেন বলে যে আপনি পলিটিক্সের হাত থেকে দূরে থাকবেন, ব্যাপারটা এমন নয় মোটেই। বরং ট্যুর চলাকালীন এই গ্রুপিং, ও তার ফলে শুরু হওয়া পলিটিক্স অনেক সময় ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। আর পরিণতিতে আপনার পুরো ট্যুরটিই রূপ নিতে পারে একটি বিভীষিকায়। 

তাই যদি খরচের বিষয়টা আপনার প্রধান মাথাব্যথা না হয়, আর আপনি মনে করেন আপনারা অল্প কয়েকজন মিলেও সম্ভাব্য বড় ধরনের যেকোন সমস্যা সামাল দিতে সক্ষম, তাহলে বিশাল বহর নিয়ে যাওয়ার কোন দরকারই নেই। বরং একদম কাছের তিন-চারজনকে নিয়ে ট্যুরে যান। এমন কয়েকজন, যাদের সাথে আপনার অনেক ঘনিষ্ঠতা আছে; যারা প্রত্যেকে প্রত্যেককে ভালো করে জানে ও বোঝে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সবাই যেন সমমনা হয়। ট্যুরে গেলে একই মেন্টালিটির মানুষ সাথে নিয়ে যাওয়াটা অনেক বেশি জরুরি। তাহলে ডিসিশন মেকিং যেমন সহজ হয়, তেমন কোন একটা ঝামেলায় পড়লে কেউ কারও দিকে আঙ্গুল না তুলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমস্যাটা মেটানোর চেষ্টা করে, এবং কোনরকম তিক্ততা ছাড়াই ট্যুরটা সম্পন্ন হয়।

খরচ কীভাবে করবেন

ধরুন কোন প্যাকেজ ট্যুরে যাচ্ছেন, তাহলে তো শুরুতেই পুরো টাকাটা আপনাকে অর্গানাইজারদের হাতে তুলে দিতে হয়। কিন্তু বিষয়টা যদি এমন হয় যে আপনারা নিজেদের মত করে, নিজ উদ্যোগে ট্যুরে যাচ্ছেন, তাহলে টাকা পয়সা কীভাবে খরচ হবে সেটা একটা বড় ব্যাপার। একজনকে দলনেতার মতো বানিয়ে তার হাতে সব টাকা তুলে দেবেন, নাকি যখন যেখানে যা খরচ হয় তা নিজে নিজে দিয়ে দেবেন? 

প্রথমটা করলে একজনের উপর অনেক বেশি দায়িত্ব পড়ে যায়, কিন্তু বাকিরা নিশ্চিন্তে ট্যুরটা উপভোগ করতে পারে। কিন্তু ওই একজনের কথাটাও একটু ভেবে দেখুন। অন্যদের মতো সে-ও তো ট্যুরে এসেছে এনজয় করতে। তাকে কেন টাকাপয়সার চিন্তায় ফেলে দেবেন? তারচেয়ে যখন যেটা খরচ হচ্ছে, নিজের মতো করে দিয়ে দেয়াটাই শ্রেয়। তারপরও কখনো সখনো এটা সম্ভব নাও হতে পারে। তখন আপনি হয়ত অন্য কারও টাকাটা নিজের পকেট থেকে দিয়ে দিলেন। এবং সাথে সাথে মোবাইলের নোটস অ্যাপটা ওপেন করে সেখানে ওই খরচের কথাটা লিখে রাখবেন। পরে ট্যুর শেষে নিজেদের মধ্যে বসে আলাপ আলোচনা ও হিসাব করে বের করে নিলেই হবে যে কে কার কাছে কত টাকা পান।

আরেকটা বিষয় ভুলবেন না। তা হলো, ট্যুরের আগে সম্ভাব্য যে খরচের হিসাব করা হয়েছিল, শুধু ওইটুকু টাকাই নেবেন না। অন্তত হাজারখানেক বেশি টাকা সঙ্গে রাখা ভালো। বিপদ আপদ তো আর বলে কয়ে আসে না। ইমার্জেন্সির কথা চিন্তা করে একটু বেশি টাকা সঙ্গে রাখা ভালো।

শুরুর ও শেষ দিনের পরিকল্পনা আগেই করে রাখুন

মানুন আর নাই বা মানুন, এ কথায় এক বিন্দু মিথ্যে নেই যে কোন ট্যুরই শতভাগ প্ল্যানমাফিক হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আপনি আগে থেকে ভেবে রেখেছিলেন এক রকম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘটনাগুলো ঘটছে একদম অন্যরকম। এটা হবেই। এতে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। বরং এটাই ট্যুরের আসল মজা। এই ঘটনাগুলোই আপনার ট্যুরকে অনেক বেশি আনন্দময় ও স্মরণীয় করে তুলবে। কিন্তু তারপরও দুটো ব্যাপারে আগের থেকে প্ল্যান করে রাখা দরকার, এবং বাস্তবেও যতটা সম্ভব সেই প্ল্যান মোতাবেকই কাজ করা দরকার। সেই দুটো হলো ট্যুরের প্রথম দিন আর শেষ দিন।

কীভাবে, কোথা থেকে ট্যুর শুরু হবে, কোথায় এসে সবাই একসাথে মিলিত হবেন, এই বিষয়গুলো আপনাকে আগে থেকে প্ল্যান করে রাখতেই হবে। শুধু তা-ই না, সেই অনুযায়ী ঠিক ঠিক কাজও করতে হবে অবশ্যই। ট্যুরের শুরুতেই যদি এইসব খুচরো কাজে ভুল বা দেরি করে ফেলেন, তাতে কিন্তু গোটা ট্যুরের ওপরই একটা বাজে প্রভাব পড়বে। শুধু তাই না, ট্যুরটা শুরুর আগেই ভেস্তে যাবারও ঘোরতর সম্ভাবনা রয়েছে। 

একইভাবে ট্যুরের আগেই কবে ফিরে আসা হবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা দরকার। ট্যুরে গিয়ে অনেকেরই মানসিকতায় পরিবর্তন আসতে পারে। কেউ হয়ত একদিন বেশি থাকতে চাইবে। কেউ একদিন আগেই ফিরে আসতে চাইবে। কিন্তু এতে প্রভাবিত হওয়া অনেক বড় বোকামি হবে। একদিন আগেই যদি ফিরে আসতে চান, তাহলে আপনার আগে থেকে প্ল্যান করে রাখা অনেক কিছুই দেখা হয়ে উঠবে না। সেই আফসোস পরে আজীবন থেকে যাবে। আর একদিন বেশি থাকতে চাওয়াটাও ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ তাতে শুধু খরচ বেড়েই যাবে না, বরং নিঃসন্দেহে আগের কয়দিনের চেয়ে ওই একদিনে খরচ বেশি হবে। সবার পকেট তাতে সায় নাও দিতে পারে, তাই না? এজন্য কবে ট্যুর শেষ করা হবে, সে ব্যাপারে আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে, সেই সিদ্ধান্তে অটল হওয়াটাই হবে প্রকৃত বুদ্ধিমানের কাজ।

থাকার বিষয়টা আগে থেকেই জেনে রাখুন

নতুন একটা শহরে গেছেন, সেখানে গিয়ে কোথায় উঠবেন এটা একটা বড় ব্যাপার। বাস বা ট্রেন স্টেশনের কাছেই হয়ত অনেক হোটেল, মোটেল বা বোর্ডিং পাবেন। কিন্তু সেগুলো মানসম্মত হবে কিনা, আর খরচ আপনার সাধ্যের মধ্যে কিনা, এগুলো যাচাই করে দেখা সময়সাপেক্ষ কাজ। কিন্তু দেখা গেল আপনারা গিয়ে পৌঁছেছেন রাত বারোটার দিকে। সারাদিনের জার্নির পর, অত রাতে গিয়ে এগুলো করতে কি শরীর সায় দেবে? 

তারচেয়ে ভালো হয় এই বিষয়টা আগে থেকেই জেনেশুনে আসলে। আমাদের দেশে এখনও অনলাইনে আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখার মতো সুবিধা খুব কম হোটেলেই আছে। তাই ওই কথা না বলি। অন্তত বিশ্বাসযোগ্য কোন সোর্স থেকে আগেই জেনে নেবেন যে কোথায় থাকলে ভালো হয়, তাহলেই অনেক বড় একটা ফাঁড়া কেটে যাবে।

ব্যাকপ্যাকে যা অবশ্যই নেবেন

এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দরকারি যে জিনিস, তা হলো পাওয়ার ব্যাংক। এই জিনিস সাথে থাকা মানে হলো মোবাইল ফোন ব্যবহারের অবাধ স্বাধীনতা। নতুবা ঘুরতে বেরিয়ে সবসময় তটস্থ থাকতে হবে, এই বুঝি শেষ হয়ে গেল মোবাইলের চার্জ। সেই ভয়ে আপনি শান্তিমত ছবি তোলা তো দূরে থাক, ফেসবুকে ঢুকে একটা চেক-ইন দিতেও দশবার ভাববেন। ট্যুরে গিয়ে এমন মানসিক যাতনার মধ্যে থাকার কোন মানে হয় না। তারচেয়ে পকেটে বা ব্যাকপ্যাকে একটা পাওয়ার ব্যাংক রাখবেন, সব চিন্তা শেষ। 

অপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ব্যাকপ্যাক অযথা ভার করবেন না   

আরও কিছু জরুরি জিনিস হলো ওষুধপত্র, ফার্স্ট এইড কিট, নিজের টুথপেস্ট, টুথব্রাশ, সাবান, রুমাল, তোয়ালে। এছাড়া অন্তত দুই সেট জামাকাপড় তো থাকবেই। আর ঘুরতে বা ট্রেকিংয়ে যাওয়ার আগে পর্যাপ্ত পানি ও শুকনা খাবার সাথে রাখবেন। এর বাইরে কিছু যদি নিতে চান, ভালো করে ভেবে দেখুন সেটা আপনার আসলেই কোন কাজে লাগবে কিনা। না লাগলে অহেতুক ব্যাকপ্যাকের বোঝা ভারি করবেন না।

আবহাওয়া ও দর্শনীয় কী আছে জেনে নিন

ট্যুরের প্ল্যান করার শুরুতেই একটু খোঁজ নিয়ে রাখুন, যে সময় ট্যুরে যাবেন ওই সময় সাধারণত ওই এলাকায় আবহাওয়া কেমন থাকে। যদি প্রতিকূল আবহাওয়া থাকে, তাহলে তো গিয়ে সারাদিন হোটেলেই বসে থাকতে হবে। 

আরেকটা জরুরি ব্যাপার হলো, যেখানে যাচ্ছেন সেই জায়গার সব দর্শনীয় স্থানগুলোর একটা তালিকা করে ফেলা। আপনি যদি মনে করেন স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে পরে সব জেনে নেবেন, তার চেয়ে বড় বোকামি কিন্তু আর কিছুই হবে না। যেমন বাগেরহাটে গিয়ে যদি আপনি স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞেস করেন অযোধ্যার মঠ বা সিঙ্গাইর মসজিদটা কোথায়, বেশিরভাগ লোকই কিন্তু আকাশ থেকে পড়বে। তারা এগুলোর নাম আগে শোনেইনি! এমনটাই আসলে হয়। বাইরের মানুষের কাছে যেটা দর্শনীয় ও গুরুত্ববহ, স্থানীয় মানুষ হয়ত সেটার নামও জানে না। তাই ট্যুরের আগেই একটা তালিকা করে ফেলে, ট্যুরে গিয়ে সেই তালিকা ধরে ধরে ঘোরা উচিৎ হবে। নাহলে ওই যে একটু আগে বলেছিলাম, বাকি সারাজীবন আফসোস করে কাটাতে হবে! 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা