
গ্রাহকদের তথ্য চুরির অভিযোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন আস্তে আস্তে বন্ধ করা হচ্ছে টিকটক, সেই টিকটিকই বাংলাদেশে ক্রমশ পাচ্ছে তুমুল জনপ্রিয়তা। সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে মন্ত্রী-আমলা, সবাই আছেন এখানে। টিকটককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং! বাংলাদেশে টিকটকের এই জনপ্রিয়তার কারন কি?
টিকটকের জন্ম এই তো ২০১৬ সালে। জন্মের মাত্র এক বছরের মধ্যেই অ্যাপটির হয় একশো মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার আর বিলিয়ন বিলিয়ন ভিউ। চার বছর পরে এই সময়ে দাঁড়িয়ে তারা গ্রাস করে নিচ্ছে প্রায় সব। প্লেস্টোর থেকে সর্বাধিক ডাউনলোডকৃত অ্যাপের তালিকায় তারা লড়াই করছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের সাথে। রাজনৈতিক কারনে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত হয়তো চীনের উদ্ভাবিত টিকটককে ব্যান করার চেষ্টা চালাচ্ছে নিয়মিতই, কিন্তু পুরোপুরি তা সম্ভব হচ্ছে না।
চটকদার কন্টেন্ট আর সস্তা হিউমার দিয়ে ইয়ং জেনারেশনের এক বড়সড় অংশকেই কব্জা করে ফেলেছে তারা। নিত্যনতুন ফিচার আর ফিল্টার সংযোজনে ইউজারদের আটক করে তারাও বুঝিয়ে দিচ্ছে- ময়দান থেকে সরে দাঁড়াতে আসেনি তারা। এ বছরের প্রথমদিকের এক পরিসংখ্যানে জানা গেলো, সারা বিশ্বে তাদের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা আশি কোটিরও বেশি! তবু এ জয়রথের পাশাপাশিই বিতর্ক চলছে। সে বিতর্কের মাঝখান দিয়েই বাংলাদেশে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই বিতর্কিত টিকটক।
মাঝেমধ্যে যদি খেয়াল করে থাকেন, তাহলে দেখবেন, এদেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে তারকা, খেলোয়াড়, রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা পর্যন্ত টিকটক ভিডিও বানাতে বেশ পছন্দ করেন। সময়ের সাথে সাথে মানুষের বিনোদনের উৎস পরিবর্তিত হয়। সেজন্যেই হয়তো বিনোদনের সাম্প্রতিক উৎসে পরিনত হয়েছে টিকটক। জমকালো ইউজার ইন্টারফেস, অসাধারণ সব ফিচার আর খুব সহজে এডিটিং করতে পারার কারনে এখানে সবাই ক্রিয়েটর। তাছাড়া এই অ্যাপের কমিউনিটি বেশ বড়সড় হওয়ায় জনপ্রিয়তা পাওয়াও যাচ্ছে খুব সহজেই। মানুষ তাই বানের জলের মতন চলে আসছেন এখানে।
যাপিত জীবনে নানা ঝামেলায় ক্লিষ্ট মানুষ টিকটক থেকেই আজকাল খুঁজে নিচ্ছে বিনোদন, শান্তি। যেটা অবশ্যই ভালো দিক। সেটা সমস্যা না। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। টিকটকের সবচেয়ে বড় সমালোচনা- এখানে তথ্যের নিরাপত্তা থাকে না। টিকটক নিয়ে এরকম অভিযোগ মাঝেমধ্যেই এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে- ব্যবহারকারীদের তথ্য চুরি করে নিজেদের মত ব্যবহার করছে তারা। বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন নিষিদ্ধও ছিলো টিকটক। ভারত এবং আমেরিকার কথা তো বললামই। নিষিদ্ধ করার পথেই হাঁটছে তারা। ভয়টা ওখানেই। তথ্য চুরির ভয়।
তাছাড়া সাবস্ক্রাইবারদের সস্তা, চটুল এবং অশ্লীল কন্টেন্ট নিয়মিতই ছড়িয়ে পড়ছে। টিকটক কমিউনিটির মানুষজন দেদারসে শেয়ার করছে এসব। এতে করে যে সমস্যা হচ্ছে, একটি জেনারেশন তৈরী হচ্ছে, যারা স্বাভাবিক না। যারা অসুস্থ মানসিকতার। চুলে রঙ, অদ্ভুত পোশাক, উদ্ভত অঙ্গভঙ্গি আর বিচিত্র কথাবার্তার এরকম সব টিকটকার জনপ্রিয়ও হয়ে যাচ্ছেন। যাদের ফলোয়ারও অজস্র। যারা ক্রমশ সমাজকে নিয়ে যাচ্ছেন খাদের সেই কিনারে, যেখান থেকে ফেরা হবে না আর। অধঃপাতের দিকে ক্রমশ যেতে যেতে শিশুকিশোরদের পরিপূর্ণ বিকাশও আজকাল থমকে যাচ্ছে টিকটকের প্রভাবে।

অনেক বেশি অ্যাডিক্টিভ হওয়ার কারনে সময় নষ্ট হওয়া, ক্রিয়েটিভিটির বদলে 'কপি'র দিকে ক্রমশ ঝুঁকে যাওয়া... এগুলো তো আছেই। তবু বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এটি। বাংলাদেশের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও যেমন বলেছেন- টিকটক নিষিদ্ধ করা নিয়ে তাদের আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই। যেরকম যা আছে, সেটা সেরকমই চলুক।
বাংলাদেশে সম্প্রতি কিছু সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে টিকটক কমিউনিটির কর্মকান্ডকে কেন্দ্র করে। সে সাথে মানুষজনের মানবিকতার অবক্ষয় তো আছেই। মানুষ যদি এটিকে প্রেশার রিলিজ করার একটি মাধ্যম হিসেবে নেয়, তাহলে কোনো সমস্যা দেখি না। কিন্তু ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামের মতন এটি যদি আমাদের বাস্তব জীবনকেই ক্রমশ গ্রাস করে ফেলে, সেটা সামলানো প্রবল সমস্যা হবে। টিকটকের সর্বগ্রাসী ক্ষুধায় সবকিছু আস্তে আস্তে নিশ্চিহ্ন হতে শুরু করলে, আমাদের করার মত আর কিছু থাকবে কী না, সেটিও বেশ বড়সড় এক ভাবনার বিষয়।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন