মানুষের পৃথিবীতে বাঘেদের জন্য কি জায়গা নেই?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একশো বছর আগেও পৃথিবীতে বাঘের সংখ্যা ছিল এক লক্ষ, মানুষের নৃশংসতার কারনে সেই সংখ্যা এখন নেমে এসেছে তিন হাজারে! বাঘের রাজ্য সুন্দরবনেই তো এখন একটা বাঘের দেখাও মেলে না। আমেরিকায় তো বাঘ নিয়ে চলছে ঘৃণ্য এক ব্যবসা!
আপনি কি চিড়িয়াখানায় গিয়ে বাদরকে অনেকবারই কলা খাওয়ানোর বদলে কলার খোসা খাইয়ে দিয়েছেন? একটু সুযোগ পেলেই চিমটি কেটে দিয়েছেন কোনো প্রাণীর গায়ে? অবলা জীবদের নিয়ে অতিরিক্ত আহ্লাদ করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই কি এদের বেকায়দায় ফেলে দিয়েছেন? প্রাণীগুলোকে বেকায়দায় ফেলে আপনি কি মজা পেয়েছেন? আপনি তো টাকা দিয়ে টিকেট কেটে গিয়েছেন চিড়িয়াখানায়, যা খুশি তাই করার অধিকার আছে আপনার?
এই প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর যদি 'হ্যাঁ' হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে ধরে নেবো, আপনি একজন অমানুষ।
দুঃখের বিষয়, এরকম অমানুষের সংখ্যা এ পৃথিবীতে অগুনতি। যারা মনে করে, চিড়িয়াখানায় গিয়ে খাঁচার মধ্যে অর্ধমৃত পশুপাখি দেখাও এক আনন্দের কাজ, তারা আসলে ঠিক কতটুকু মানুষ, সেটাও চিন্তার বিষয়। আমি ঠিক জানিনা যারা মিরপুরের চিড়িয়াখানায় গিয়েছেন, তারা আসলে এইসব প্রানীদের দেখে কতটুকু শান্তি পেয়েছেন? খাঁচা-বেষ্টিত প্রাণীদের দুর্দশাগ্রস্ত অবয়ব দেখে কে কতটুকু তৃপ্তি পেয়েছে, তা অবশ্যই ভাবনার বিষয়।
শুধু চিড়িয়াখানায় গিয়ে প্রাণীদের বিরক্ত, বিব্রত করলেও চলতো...আমরা বর্বরতা দেখাচ্ছি সবখানেই। কোনো একটি বাঘ লোকালয়ে চলে এলেই মেরে ফেলছি। লকডাউনের মধ্যে সমুদ্রে ভেসে ওঠা কয়েকটা ডলফিনকে মেরে ফেলেছে বাংলাদেশেরই মানুষজন, কোনো কারণ ছাড়াই। আমাদের সহিংসতায়, আমাদের বর্বরতায় সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমেছে। নিয়মিত কমেছে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে বড়াই করি আমরা, আমাদের সুন্দরবনে সেই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বর্তমান সংখ্যা কত জানেন? না জেনে থাকলে সেটাই বরং আপনার জন্যে ভালো।
অবশ্য বাঘের কথা বললেই অনেক কিছু বলতে হয়। এই ভয়ঙ্কর সুন্দর প্রাণীটির দেশে যে বেহাল অবস্থা, তা আমরা জানিই। অবশ্য কোনখানেই বা তারা স্বস্তিতে আছে, সেও এক গবেষণার বিষয়। বিদেশের দিকে যদি তাকাই, এশিয়ার মোট বাঘের তুলনায় আমেরিকার বাঘের সংখ্যা বেশি। অনেকেই জানেন। কিন্তু খোদ আমেরিকাতেও এই রাজকীয় প্রাণীদের বেহাল অবস্থা চরমে। ব্যাঙের ছাতার মত সেখানে গজিয়ে উঠছে বেসরকারি সব চিড়িয়াখানা। বাঘের প্রদর্শনী চলছে সেখানে। টিকেট কেটে চিড়িয়াখানায় ঢুকে বাঘকে ধরে, জড়িয়ে, গলাগলি করে...নানাভাবে ছবি তোলা যাবে সেখানে। ক্রিয়েটিভ ব্যবসাই হচ্ছে এই প্রাণীটিকে নিয়ে!
যেকোনো বিষয় নিয়ে যখন টিপিক্যাল ব্যবসা শুরু করা হয়, তখন বিষয়টি তার স্বকীয়তা, সৌন্দর্য, শিল্পগুণ হারায়। সেটি সাহিত্যের ক্ষেত্রে যেমন সঠিক, আবার, পশুপাখির ক্ষেত্রেও সঠিক। যারা বাঘের এইসব ব্যবসার সাথে জড়িত, তারা বাঘ সংগ্রহের জন্যে যে কাজটি করেন সেখানে, সেটিও অমানবিক। জন্মের পরপরই মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় তারা ছোট ছোট বাঘশাবককে। মানুষের প্রশিক্ষণে আর কৃত্রিম দুধে এই বাঘের শিশুরা বড় হতে থাকে। এই পর্যায়ে এসে অনেক বাঘশিশুই মারা যায়। মায়ের দুধের পুষ্টি যেহেতু তারা পায় না, তাদের দৈহিক গঠনও অতটা সুগঠিত হয় না৷ তারা বড় হয় অপুষ্টিতে ভোগা একরকমের প্রাণী হয়ে। হয়তো তাদের বাইরের খোলসটিই থাকে বাঘের মতন, ভেতরটি যে কোন প্রাণী... সে বোধহয় বিধাতাও জানেন না।
রাস্তার পাশে গজিয়ে ওঠা যেসব চিড়িয়াখানার কথা বললাম, সেসব চিড়িয়াখানাতেই এই বাঘদের ধরে ধরে সরবরাহ করা হয়। চেহারায় বাঘ, স্বভাবে কেঁচোর মত হয়ে এক 'কিংকর্তব্যবিমুঢ় প্রাণী' হয়ে তারা টিকে থাকে চিড়িয়াখানাগুলোতে। মানুষজন তাদের সাথে বিভিন্ন বিচিত্র ভঙ্গিতে ছবি তোলে, আমোদ-ফূর্তি করে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের ব্যবসা হতে থাকে সে সাথে। দেদারসে। পাল্লা দিয়ে।
আমেরিকার প্রত্যেকটি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছে বাঘের এ ব্যবসা। এ ছাড়াও ইউরোপ আর আফ্রিকাতেও রয়েছে এই ব্যবসা। থাইল্যান্ডে তো বাঘের সাথে সেলফি তোলার পার্কও রয়েছে। এভাবেই বিচিত্র সব উপায়ে সারা পৃথিবীতে মিশ্র রকমের বাঘ ছড়িয়ে পড়ছে। যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আইন করে বাঘের স্বকীয়তা রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে আইন করে বাঘকে কোনোভাবেই যে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছেনা, সেটি তো পুরোপুরিই দৃশ্যমান।
এভাবে চলতে থাকলে হলুদ পিঠ, সাদা বুক আর কালো কালো রেখায় হেলতেদুলতে চলতে থাকা এই রাজকীয় প্রাণী আর ক'দিন থাকবে পৃথিবীর বুকে, সেটি এক বড় প্রশ্ন। বা, যদি থাকেও, সেটি আর কতটুকু আদি ও অকৃত্রিম বাঘ থাকবে, প্রশ্ন সেটি নিয়েও।
যে পৃথিবীতে একশো বছর আগেও বাঘ ছিলো এক লাখেরও বেশি। সেখানে বর্তমানে বাঘের সংখ্যা মাত্র তিন হাজার! এভাবে চলতে থাকলে, আমরা আর কয়দিন বাঘকে রাখতে পারবো, সেটিও দেখার বিষয়। আমরা 'বাঘ' নামক প্রাণীটিকে খুব দ্রুতই হারাতে যাচ্ছি কী না, উদ্বেগের বিষয় সেখানেও রয়েছে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন