ওদের জীবন নিয়ে যত প্রশ্ন আমাদের, সেগুলোর উত্তর...
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
প্রকৃতি তাদের সীমাবদ্ধতা দিয়েছে। তবু তারাও সংসার করেন। শারীরিকভাবে মিলিত হন। কিন্তু সন্তানের মুখ দেখতে পান না তারা। তবু ঘর পাতেন। তাদের সংসার, ঘরবাঁধা ভিন্ন রকমের..
তাদেরকে অনেক নামে ডাকা হয়। হাতে বিশেষ ধরণের তালি বাজানো, শিষ দেয়া, স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় একটু ভিন্নভাবে কথা বলা এই মানুষদের কেউ ডাকেন হিজড়া বলে, কেউ বলেন কমনজেন্ডার, কেউ কেউ বলেন হাফ লেডিস, কেউ বলেন নপুংশক, কেউ বলেন বৃহন্নলা ইত্যাদি।
এদের চোখে পড়ে সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে। সেদিন তারা পাড়া মহল্লার বিভিন্ন দোকান থেকে চাঁদা নিয়ে থাকেন। কখনো কখনো কেউ টাকা দিতে অগ্রাহ্য করলে তারা উদ্ভট আচরণ করে দোকানীদের বিব্রত করে থাকেন। কোনো বাড়িতে নতুন শিশু জন্ম নিলে এরা সেখানে যায়, নাচে, এর বিনিময়ে অর্থ দাবি করে। বিয়েবাড়ির আশেপাশেও এদের দেখা যায়। হিজড়া কিংবা এই বিশেষ শ্রেণীর মানুষের আচরণ নিয়ে সবার মনেই কৌতূহল রয়েছে।
অনেকেই তাদের উপর বিরক্ত, অনেকেই তাদের ব্যাপারে আগ্রহী। সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন এই মানুষগুলোর পেছনের গল্প কি? তাদেরও কি আমাদের মতো মৃত্যুর পর কবর দেয়া হয়? তারা কেন স্বাভাবিক জীবন পেলেন না? প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার চেষ্টা থাকবে এই লেখাটিতে। তার আগে একটি গল্প শুনাবো।
*** আঞ্জুমান (ছদ্মনাম), বয়স চব্বিশ, গত ১০ বছর ধরে পুরাণ ঢাকার একটি হিজড়া কমিউনিটিতে থাকেন। ছোটবেলায় তার জন্মের সময় পুরো পরিবার বেশ খুশিই হয়েছিলো। কারণ, তিন কন্যার পর পুত্রসন্তান হিসেবে আঞ্জুমানের জন্ম হয় পরিবারটিতে। তবে এই আনন্দের রেশ বেশিদিন থাকেনি। আঞ্জুমান অন্য সব ছেলেদের মতো ছিলেন না।
তার মেয়েদের মতো শাড়ি পড়তে ইচ্ছে হতো, ঠোঁটে লিপস্টিক দিতে মনে চাইতো। ইচ্ছে হতো খুব সাঁজতে। এটা দোষের মধ্যে পড়ে না। তবু একটা পর্যায়ে আঞ্জুমান খেয়াল করলেন, তাকে সবাই হাফ লেডিস বলে ক্ষ্যাপাচ্ছে। তাকে নিয়ে ভীষণ রকমের ঠাট্টা শুরু করে দিয়েছে সবাই। একদিন রাতে তার বাবা তার মাকে মারলেন। পাশের রুম থেকে আঞ্জুমান শুনতে পেলো, ‘মাগি তুই একটা অপয়া, তিন মাইয়া জন্ম দিয়া আমারে ডুবাইসস, এখন আবার জন্ম দিসস হিজড়া। পাড়ায় আর মুখ দেখাইতে পারি না।’
আঞ্জুমান বুঝতে পারলেন না, কেন তার বাবা পাড়ায় মুখ দেখাতে পারেন না। এতে তার কি দোষ, কি দোষ তার মায়ের। তবে এইটুকু বুঝলেন, এই সমাজ তাকে চায় না। এখানে তার মতো মানুষদের অধিকার নেই। একদিন বাজার রোডে, কয়েকজনকে দেখলেন হাতে তালি দিয়ে চাঁদা তুলছে। আঞ্জুমান তাদের একজনের সাথে কথা বললেন। কথা বলে তার ভীষণ ভালো লাগলো। মনে হলো, এই প্রথম বুঝি কেউ তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তার কথা শুনছে। অনেকদিনের যন্ত্রণাবোধ ও সমাজের মূলস্রোতে মানিয়ে নিতে না পারার গ্লানি মুছতে আঞ্জুমান তাদের সাথে মিশতে শুরু করলো।
একসময়, বিষয়টি জানাজানি হলো। তার বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। এভাবেই হিজড়া কমিউনিটিতে আঞ্জুমানের জায়গা হয়। তাকে প্রশ্ন করা হলো,”আপনারা মানুষের উপর জোরপূর্বক চাঁদাবাজি করেন কেন?” আঞ্জুমান বললেন, “মানুষ যখন আমাদের অধিকার দেয় না, আমাদের সন্তান বলে স্বীকৃতি দেয় না, আমাদের নিয়ে হাসি মশকরা করে, আমাদের থাকতে দেয় না কোথাও, আমাদের সাথে কথা বলতে চায় না, আমাদের পড়ার সুযোগ দেয় না, আমাদের চাকরির সুযোগ দেয় না তখন আমাদের করার আর কিছু থাকে না। আমাদেরও তো বাঁচতে মনে চায়। এভাবে চেয়ে খাওয়া ছাড়া আর কি করবো বলেন?”
হিজড়ার জন্ম ও মিথ
মূলত, হিজড়া শব্দটি এসেছে আরবী হিজরত/ হিজরী শব্দ থেকে। এটির আভিধানিক অর্থ পরিবর্তন/ Migrate/ transfer। হিজড়া শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে “Hermaphrodite”। যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে “উভয়লিঙ্গ”। গ্রিক পৌরানিক কাহিনীতে Hermaphrodite শব্দটির উৎপত্তিগত অর্থ রয়েছে। গ্রিক পুরাণের দুটি চরিত্র হার্মেস এবং আফ্রেদিতি থেকে এসেছে Hermaphrodite শব্দটি।
পুরাণে পাওয়া গেছে, হার্মেস ও আফ্রোদিতি দম্পতির সুদর্শন পুত্র হার্মাফ্রোদিতাসের প্রেমে পড়ে ঝরণার উপদেবী। উপদেবী দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করেন, চিরতরে যেন তিনি হার্মাফ্রোদিতাসের সাথে মিলিত হতে পারেন। দেবতারা তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। এর ফলে তাদের দুইজনের সংমিশ্রনে তৈরি হয় একজন অর্ধপুরুষ ও অর্ধনারী বিশিষ্ট মানুষ!
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা
মানুষের জীবকোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে। এর মধ্যে ২২ জোড়াকে অটোজোম এবং বাকি এক জোড়াকে সেক্স ক্রোমোজোম বলা হয়। এই এক জোড়া ক্রোমোজোমই আসলে নির্ধারণ করে মানুষের লিঙ্গ। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে অনেকেই জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে পৃথিবীতে আসেন। মূলত, যাদের জন্মের পর লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়, তারাই হিজড়া। ভ্রুনের বিকাশকালে নিষিক্তকরন ও বিভাজনের ফলে বেশকিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সৃষ্টি হয়। যেমন এক্স এক্স ওয়াই অথবা এক্স ওয়াই ওয়াই। এর ফলে বিভিন্ন গঠনের হিজড়া শিশুর জন্ম হয়।
তাদের শারীরিক গঠন
শারীরিক ও মানসিক গঠনের উপর নির্ভর করে তাদেরকে ৬ ভাগে ভাগ করা যায়। শারীরিক ভাবে পুরুষ কিন্তু মানসিক ভাবে নারী এর অধিকারী হিজড়াদের বলা হয় অকুয়া। অন্য হিজড়াদের বলা হয় জেনানা। আর মানুষের হাতে সৃষ্ট বা ক্যাসট্রেড পুরুষদের বলা হয় চিন্নি। হিজড়াদের শারীরিক গঠন মূলত ৩ প্রকার- -- নারীদের সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেও নারী জননাঙ্গ থাকে না। -- পুরুষের সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেও পুরুষ জননাঙ্গ থাকে না। -- উভয় বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান থাকে।
হিজড়ারা কীভাবে নিজেদের দল ভারী করে?
দুইভাবে এটি করে থাকে তারা। যদি তারা জেনে থাকে যে, কোথাও কোনো হিজড়া শিশুর জন্ম হয়েছে তারা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। বাচ্চাকে নেয়ার জন্য দেনদরবার করে। অনেক সময় তারা দলবদ্ধভাবে তাদের বিশেষ হাততালি দেয় বাচ্চার সামনে। এই হাততালিতে নাকি সম্মোহনী শক্তি থাকে যা বাচ্চাকে আকর্ষণ করে প্রবলভাবে, যদিও এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। আরেকটি উপায় হচ্ছে, খোঁজা পুরুষ বানিয়ে দল ভারী করা। ভারতের বেশ কিছু জায়গায় কয়েকদশক ধরে খোঁজা বানিয়ে দল ভারী করার চেষ্টা করেছে হিজড়ারা।
খোঁজা বানায় কীভাবে?
কয়েক দশক আগেও ভারতের কিছু ক্লিনিক ছিল। যারা টাকার বিনিময়ে পুরুষদের “খোঁজা পুরুষ” বা ক্যাসট্রেড হিজড়ায় পরিনত করত। বেঁচে থাকার তাগিদ থেকে অথবা রোজগার কামাইয়ের আশায় অনেক দরিদ্র পুরুষেরা ইচ্ছাকৃতভাবে ক্যাসট্রেড হিজড়ায় পরিণত হতো। এছাড়া ভারতে কিছু হিজড়া দল ছিল যারা শিশু অপহরণ করত। তারপর শিশুটিকে ১০ দিন গোপন কোনো জায়গায় আটকে রেখে দিতো। ১১ তম দিনে লাল শাড়ি পরিয়ে ক্যাসট্রেশন করে হিজড়াদের দলে যুক্ত করতো।
চমক জাগানিয়া তথ্য হচ্ছে, খোদ বাংলাদেশেও হিজড়া বানানোর ক্লিনিক আছে। যেখানে অনেককেই জোর করে ক্যাসট্রেড বানানো হচ্ছে। কেউ কেউ নিজের ইচ্ছাতেও হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দালালের মাধ্যমে পুরুষদের হিজড়া বানানোর জন্য এসব ক্লিনিকে নিয়ে আসা হয়। অপারেশনের মাধ্যমে পুরুষাঙ্গ কেটে মেয়ে যৌনাঙ্গে রুপান্তরিত করে দেওয়ার অভিযোগ আছে। এতে খরচ বাবদ ক্লিনিক পায় ১৫/২০ হাজার। দালালরা নেয় ৩/৫ হাজার টাকা।
হিজড়াদের বিয়ে যেভাবে হয়
প্রকৃতি তাদের সীমাবদ্ধতা দিয়েছে। তবু তারাও সংসার করেন। শারীরিকভাবে মিলিত হন। কিন্তু সন্তানের মুখ দেখতে পান না তারা। তবু ঘর পাতেন। তাদের সংসার, ঘরবাঁধা ভিন্ন রকমের। প্রত্যেক হিজড়াই একজন পুরুষ সঙ্গী খোঁজেন। পুরুষ সঙ্গীরা তাদের বন্ধু হিসেবেপরিচিত। হিজড়াদের কাছে এই বন্ধু “পারিক” নামে পরিচিত। হিজড়াদের বিয়ের আরেকটি প্রচলিত নিয়ম আছ দক্ষিণ এশিয়ার হিজড়া কমিউনিটিগুলোতে। সেটার প্রক্রিয়া কিছুটা ভিন্ন।
এশিয়ার হিজড়াদের অধিকাংশই মুসলিম। তবে, তারা হিন্দুদের একটি পূজা করে। যার মাধ্যমে তারা ভগবানের সাথে নিজের বিয়ে দেয়। এরপর সারাদিন তারা সংসার সংসার খেলে। সন্ধ্যা এলে তারা বিধবার সাজ নেয় সাদা শাড়ি পড়ে। পুরো বিধবা বেশ গ্রহণ করে তারা স্বামীর মৃত্যু শোক করে। অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। তাদের সে কান্নায় আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়। তাদের এই কান্নার দুঃখগাথা বুঝবার শক্তি স্বাভাবিক মানুষের নেই।
রাখিবন্ধন
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর হিজড়ারা কি করেন? তারা যে কমিউনিটিতে যোগ দেন সেখানে তাদের প্রত্যেকের দলে থাকেন একজন গুরু। এই গুরুকেই তারা অভিভাবক হিসেবে মেনে নেন। তারা যখন দলে যোগ দেন তখন গুরু তাদের আগের পোশাক খুলে শাড়ি পড়িয়ে দেয়। তাদের কপালে আশীর্বাদ স্বরুপ আচঁল ছুয়ে দেয়। এছাড়া মন্ত্র পড়ে ফুঁ দেয়। এটাকেই তারা “রাখি বন্ধন” বলে থাকেন। রাখিবন্ধনের পর তারা গুরুর কথামতো কাজ শুরু করেন।
মৃত্যুর পর হিজড়াদের সমাহিত করা হয় কীভাবে?
হিজড়াদের অধিকাংশ মুসলিম হলেও কেউ কেউ হিন্দু রীতিতে বিশ্বাস করেন। তাই তাদেরকে কবর দেয়া হলেও তাদের অনেকেই মনে করেন তাদের আবার পুনঃজন্ম হবে। যে বিছানায় হিজড়ারা থাকে তার নিচেই প্রত্যেক হিজড়াকে কবর দেয়া হয়। এটাই তাদের প্রচলিত রীতি (যদিও বর্তমানে স্থান সংকুলানের জন্য তাদেরকে অন্য জায়গাতেও কবর দেয়া হয়)।
তাদের কবর দেয়ার নিয়মটি কিছুটা অদ্ভুত। কবরের মধ্যে প্রথমে লবন ঢালা হয়। তারপর লাশ রাখা হয়। তারপর দেয়া হয় ফুল এবং তারপরে আবারও দেয়া হয় লবন। এটার মূল কারন হচ্ছে, তারা বিশ্বাস করেন, এই প্রক্রিয়ায় কবর দিলে তাদের আগের সকল পাপ ধুয়ে মুছে যাবে এবং পরবর্তী জনমে তারা পূর্ণ নারী কিংবা পুরুষ হিসেবে জন্মগ্রহন করতে পারবেন!