হয় যে কাজকে ভালবাসো সেই কাজ করো, নইলে যা করছো তাকে ভালবাসো। এই সহজ লাইনটা আমার না, শাহরুখ খানের। আমি যেটা বলতে পারি, কাজকে তুমি ভালবাসলে কাজও তোমাকে ভালবাসবে।
এক ভদ্রমহিলা কথায় কথায় এক দিন বললেন, 'আমার ছেলেটা পড়ে না, পড়লে খুব ভাল করতো। আপনি কি জানেন কী করলে সে পড়বে?' এই প্রশ্ন আমাকে করার কারণ খুঁজে পাইনি, হয়তো তিনি অনেকের কাছেই এর উত্তর খুঁজে বেড়ান। কথা শুনে উদাস হয়ে গেলাম, এই অভিযোগ স্কুল ছাত্রদের সবার মায়েরই থাকে। আমার আম্মারও ছিল। এবং আমিও নিয়মিত লেখাপড়া করতাম না। প্রচুর অবহেলা আর গাফিলতি হয়েছে। হতে পারে সিস্টেম ভাল না, নেতিবাচক দুনিয়া ছিল, উৎসাহ উদ্দীপনাও কম ছিল, কিন্তু সব কিছু অন্যের ঘাড়ে না ঠেলে নিজের দিকে নেওয়ার মতো অনেক কিছু আছে।
আমি ফাঁকিবাজ ছিলাম। নাহলে আরেকটু ভালো কিছু আমার আব্বা আম্মাকে দেওয়া যেত। এ কথা অনায়াসে বলা যায় আমাকে নিয়ে তাদের প্রত্যাশা যা ছিল, তা পূরণ হয়নি। আমি ভাবতে লাগলাম ছাত্রাবস্থায় আমার বাধাগুলো কী কী ছিল? ঠিক কী কারণে পড়তে বসলে নানাবিধ চিন্তায় হারিয়ে যেতাম এবং বেশিরভাগ সময়েই পড়ার মনোযোগ থাকত না?
একটা তো ছিল খেলাধুলা, বিশেষ করে ক্রিকেট। তখন বাংলাদেশ মাত্র আন্তর্জাতিক এক্সপোজার পাচ্ছে , ব্যাটিং করতে নামলে ৭০ রাতে ৭ উইকেট পরার পর খালেদ মাসুদ পাইলট সেটাকে ঠেলে ঠুলে ১৫০+ করতো, সেটাই বল বাই বল দেখে যেতাম। রাত জেগে ফুটবল দেখতাম। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা যেদিন শুরু, তার আগের রাত ৩ টার সময় জুভেন্টাস আর এসি মিলানের চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনাল দেখায় ব্যস্ত আমি। তো পড়তে বসলেও পড়ার নাম করে খেলার চিন্তা মাথায় থাকত। এরপর যেটা বলব সেটা নিয়ে আলোচনা করামাত্র খারাপ মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হব।
গ্রোন আপ এজে ছেলেদের বড় সমস্যা, পর্ন। তখন চটি বইয়ের প্রচলন ছিল। যেহেতু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছি এবং আমি যেহেতু মনে করি সমস্যা সমাধান করতে গেলে সমস্যার মূলে যেতে হয়, কাজেই এই সমস্যা ইগ্নোর তো করা যাবেই না। বরং এটাই প্রধান সমস্যা। এরপর হচ্ছে বন্ধু-বান্ধবের মেয়েবন্ধু প্রাপ্তি, আমার অপ্রাপ্তি। পড়তে বসলেই চিন্তা আসতো- আহা! এরকম কেউ আমার জীবনে নেই কেন? কবে আসবে? কীভাবে আসবে? বাসার পরিবেশ একটা ব্যাপার। বাসায় যদি প্রচুর পরিমাণে মেহমান আসা যাওয়া থাকে তাহলে খুব সিনসিয়ার ছেলেপেলে বাদে বেশিরভাগেরই সমস্যা হবে। আপনার বাসা সামাজিক যে হবে না তাই না, কিন্তু কিছু কিছু বাসা থাকে পুরা মহল্লার বা গ্রামের বাড়ির সব সমস্যা নিজেদের সমস্যা বানিয়ে ফেলে। সেই সমস্যা সমাধানের জন্য বাসাভর্তি মানুষের আগমন ঘটতেই থাকে। এক তো নাচুনে বুড়ি, তার উপর ঢাকের বাড়ি। তো এরকম আরও কিছু বাধা বিপত্তির ব্যাপার আছে।
এখন আমি নিজে যেই দোষে দুষ্ট, সেটার সমাধান কীভাবে দিব? তবে সমাধান চাইলে হয়ত পাওয়া যেতে পারে, অল্প বয়সে বুঝি নাই, এখন বুঝি। সমাধান আসলে সেই বেসিক সমাধানই, সব সমস্যার মূলে যাওয়া। আমার এখন পড়তে বসতে হবে কিন্তু পড়ার সময়ে আমার বাইরের সব চিন্তা আসে, এইসব চিন্তাকে দূরে সরে পড়ার চিন্তা কীভাবে হবে? এখন আমি বাইরের যে চিন্তা করছি সেগুলার আউটকাম কী?
ক্রিকেট খেলা দেখব, ক্রিকেটভক্ত হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ খেলা দেখতেই হবে/ কিন্তু কোন বিশেষ মুহূর্তে এই চিন্তাটা করতে হবে এর ফলাফল কী? আমি যদি পড়ি, এখন সব চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ার চিন্তা করি তাহলে তার ভবিষ্যৎ কী, আর ক্রিকেট খেলাটা এখন দেখার ভবিষ্যৎ কী? এই চিন্তা যে শুধু স্কুলের ছাত্রদের জন্য তা না, সবার জন্য। যেকোনো মুহূর্তে আপনি যা করছেন, তা কেন করছেন? আপনি এখন শুয়ে আছেন কিন্তু কিছু করছেন না। এই শুয়ে থাকার সময়টাতে আপনার আসলে কী করা উচিত, ঠিক কী করলে আপনি এগিয়ে যেতে পারবেন?
এই যে আজকে যেই টিনএজ ছেলেটা গার্লফ্রেন্ড নাই বলে হা-হুতাশ করছে, তার জীবন কি এখানেই শেষ? তার জীবনেও কেউ না কেউ চলেই আসবে। সবার জীবনেই আসে। তাহলে যে কোন মুহূর্তে যেকোনো কিছু করার আগে পরিণতি ভাবার একটা বিষয় থাকে। যেই টিনএজ ছেলেটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোন মেয়েকে বিরক্ত করার চিন্তা করছে, সে কি কখনো ভাবে যে এর পরিণতিগুলো কী কী? সিনেমায় নায়কেরা এভাবে গার্লফ্রেন্ড পেয়ে যায়, কিন্তু বাস্তবে তো মেয়েরা বিরক্ত হয়! আমার সুন্দর শার্ট, সুন্দর জিন্সের প্রতি মেয়েদের মোহ (যদি আসার কোনো সম্ভাবনা থাকে) কাটতে এক মিনিটও লাগবে না, যদি মেয়েটা বুঝে আমি সেন্সিবল না।
এই যে প্রতি মুহূর্তে সেন্সিবল আচরণ করা, এটাই আসলে বাবা মায়ের বাচ্চাদের শিখানো উচিত। এক জীবনে আমিও বহু শুনেছি , আমি পড়লেই পারি, কিন্তু সেটা আমাকে কখনোই মোটিভেট করে নাই। কিন্তু একটা বাক্যই আমাকে মোটিভেট করে, যখন কেউ বলে আমি সেন্সিবল, আমার দায়িত্বজ্ঞান ভাল। তখন আমার কাছে মনে হয়, এটা আমাকে বজায় রাখতে হবে, এটা একটা সম্মান।
এই সম্মানের সাথে ছোটবেলা থেকেই সবাইকে পরিচিত করা উচিত। পর্ন দেখা এখন অনেক সহজ, মোবাইল বা ল্যাপটপে দুই চার বাটন টিপ দিলেই হয় কিন্তু সেন্সিবল কেউ এই কাজ চাইলেই করবে না। যে কোন বাজে আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে ইচ্ছাশক্তি। ইচ্ছাশক্তি অনেক অনেক বড় একটা ব্যাপার।
মাগুড়া থেকে খেলতে এসে বিশ্বের সেরা খেলোয়ার হয়েছে সাকিব আল হাসান, কারণ তার ইচ্ছাশক্তি। সাকিবের বাবা একজন ফুটবলার ছিলেন। আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ যেদিন জিতে তারপরের দিনই সাকিবের বাবার ঠেলে দেওয়া ফুটবলে লাথি মেরে সাকিব বলে আমি ক্রিকেটার হব, ক্রিকেট খেললে বিশ্বকাপ জিততে পারব। এই যে ক্রিকেটার হওয়ার ব্যাপারটা, সাকিবের ভিতর থেকেই এসেছে। অনেকে হয়তো সাকিবের ২-১ টা ভুল আচরণের উদাহরণও আনবে- কিন্তু নিজেকে শুধরানোর , নিজেকে উন্নত করার ইচ্ছা তার সব সময়ই আছে।
এখন আমাকে বুঝতে হবে আমি কি সাকিব হতে চাই কি না। আমি যদি ক্রিকেটার হতে চাই তাহলে খুব শুরু থেকেই আমাকে শুরু করতে হবে। কিন্তু আমার ক্রিকেটার হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই, ক্রিকেট বিষয়ক কোন কিছুতে ক্যারিয়ার গড়ার সম্ভাবনা নেই, তাহলে আমাকে লেখাপড়ার সময় লেখাপড়াই করতে হবে। হয় যে কাজকে ভালবাসো সে কাজ করো, নাহলে যা করছো তাকে ভালবাসো। এই সহজ লাইনটা আমার না, শাহরুখ খানের। আমি যেটা বলতে পারি, কাজকে তুমি ভালবাসলে কাজও তোমাকে ভালবাসবে।
এখন আমার কাছে এটাই মনে হয়, যত তাড়াতাড়ি কাউকে বাস্তবের সাথে সম্পর্ক করে দেওয়া। স্বপ্ন বড় দেখতেই হবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে স্বপ্নের কথা বলতেই হবে। সেই স্বপ্ন সত্যি করার জন্য চিন্তাভাবনা আর আচরণ বাস্তবসম্মতই হতে হবে। প্রতিটা কাজের একটা পরিণতি থাকে, যে কেউ কাজটা করার আগে যদি একবার শুধু পরিণতি ভাবে, তার জন্য মাইন্ডসেট করা তুলনামূলক ভাবে সহজ।
ভালো কথা, ছাত্রাবস্থার আরও কিছু সমস্যা আমি বলিনি, ড্রাগস, ইয়াবা হাবিজাবি। এগুলা থেকে আমি সবসময়েই দূরে ছিলাম, বা এগুলা আমার ধারে কাছে কখনো ঘেষতে পারে নাই। আর এগুলা বেসিক সমস্যা না, অনেক এক্সট্রিম লেভেলের সমস্যা। তবে প্রচুর বই পড়তাম। এই নেশাটা খারাপ না।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন