দ্য আন্ডারটেকার: ওয়ার্ল্ড রেসলিংয়ের সবচেয়ে বড় পোস্টারবয়!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ছেলেটির হওয়ার কথা ছিলো বাস্কেটবল প্লেয়ার। সেখান থেকে চলে আসা রেসলিং এর রিং এ। 'মৃত্যু' ছিলো তার সিগনেচার স্টাইল। যাকে ভয় পেতো রিং এর ভেতরে-বাইরে সবাই। ত্রিশ বছরের ক্যারিয়ার শেষে সেই আন্ডারটেকারের বিদায় জানিয়েছেন প্রফেশনাল রেসলিংকে...
নব্বইয়ের দশকে আমরা যখন ক্রমশ বড় হয়ে উঠছি, বাসায় বিটিভির জায়গায় এসেছে ডিশলাইনের ক্যাবল, সে সময়টাতে রেসলিং ছিলো আমাদের কাছে এক অপার্থিব রহস্যের উৎস। পেশিসর্বস্ব মানুষগুলো কেন ক্রোধে ফেটে পড়ছে চতুষ্কোণ রিং এর ভেতরে, সেটা আমাদের অনেকেরই ঠিক বোধগম্য ছিলো না। তবু আমরা দেখতাম। মারামারি, ভাংচুর, সংঘর্ষ... মানুষকে বরাবরই আকর্ষণ করে। সেটারই প্রতিফল হিসেবে আমরা সেঁটে থাকতাম টিভিসেটের সামনে। যখন বড় হয়েছি, যখন আস্তে আস্তে বুঝতে শিখেছি- আলিফ লায়লার ভূতগুলো আসলে মেকআপের ভূত, বাস্তবের না; যখন বুঝতে শিখেছি- সুয়োরাণী আর দুয়োরাণী বলে কিছু নেই, ছিলো না কোথাও, তখনও অতটা ধাক্কা খাইনি। সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছি সম্ভবত নষ্টালজিয়ার এই রেসলিং এর কাছ থেকেই; যখন জানতে পেরেছি- রেসলিং পুরোটাই অভিনয়; কোনো কিছু সত্যি নয়৷ সত্যি বলছি, এরকম ধোঁকা আর কেউ দেয়নি জীবদ্দশায়৷
তবু তাই বলে শৈশবের সেই সময়গুলোকে মিথ্যে বলা যায় না। বলা সম্ভবও না। জন সিনা, র্যান্ডি অরটন, রে মিস্টেরিও, ব্রোক লেসনার, কেইন, বিগ শো, মার্ক হেনরি অথবা দ্য আন্ডার-টেকার এর রাজত্বকেও অস্বীকার করা যাবেনা সে সাথে। শেষের মানুষটিকে সারাজীবনই ভুল করে 'আন্ডার-টাইগার' ডেকেছি। যিনি ছিলেন রেসলিং-জগতে আমার সবচেয়ে প্রিয়দের মধ্যেও অন্যতম। সেই আন্ডারটেকার ওরফে মার্ক উইলিয়াম ক্যালওয়ের গল্প বলবো আজ। যিনি ত্রিশ বছর রেসলিং করার পরে গত পরশু দিলেন বিদায়ের ঘোষণা। ঠিক সেই দিনটিতে, ত্রিশ বছর আগে যে দিনটিতেই অভিষেক হয়েছিলো তার!
রেসলার তো অনেক রকমই আছেন, তবে এরমধ্যেও আন্ডারটেকার ছিলেন অনেকটা রহস্য-জাগানিয়া রকমের। বেশ ভীতিসঞ্চার হতো যখন তার এন্টারেস্ট মিউজিক; যা ছিলো চপিনের ফিউনারেল মার্চেরই অন্য ভার্সন, বাজতো কিংবা 'ঢং' করে গির্জার ঘন্টির একটি শব্দের পরই সব অন্ধকার- আলো এলে দেখা যেতো- মঞ্চের মাঝখানেই তিনি। দাঁড়িয়ে আছেন চোখজোড়া সাদা করে। কৈশোরে এসব দেখে অদ্ভুত কলজে কাঁপানো অনুভূতি হতো। কখনো কবর থেকে হাত বের করে দিচ্ছেন। কখনো কফিন থেকে বেরোচ্ছেন জীবন্ত হয়ে। তিনি ছিলেন অদ্ভুত এক ফ্যান্টাসিও৷ যাবতীয় সব রেসলারের ভীড়ে তাকে অপার্থিব সত্ত্বা বলে ভ্রম হতো আমাদের। প্রতিপক্ষকে মাঝেমধ্যে ঝুলিয়ে দিতেন দড়িতে, ঢোকাতেন জীবন্ত কফিনে, আগুনের মধ্যে ফেলে দিতেন। নিজেও জীবন্ত কবরে গিয়েছেন বেশ ক'বার। ত্রিশ বছরের রেসলিং জীবনে ইন্টারেস্টিং সব স্টান্টবাজির কারণেই হয়তো তিনি ছিলেন আমাদের এত প্রিয়।
টেক্সাসের হাউস্টনে জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা তার।৷ ছোটবেলা থেকেই পেশাদার রেসলার হওয়ার একটা ইচ্ছে ছিলো, স্থানীয় বিভিন্ন রেসলিং কম্পিটিশনে সুযোগ পেলেই ঢুঁ মারতেন। কিন্তু বয়স একটু বাড়ার পরে ইচ্ছে টা রূপান্তরিত হয় বাস্কেটবলে। বেশ কিছু ইউরোপিয়ান ক্লাব তাকে বাস্কেটবলে টীমে নেয়ার জন্যে প্রস্তুতও ছিলো। কিন্তু সেই সময়েই হাজির হয় এক বন্ধু, রেসলিং ক্যাম্পে আন্ডারটেকারকে নিয়ে যায় জোর করে। এবং সেটিই হয়ে দাঁড়ায় টার্নিং পয়েন্ট। তিনি বুঝতে পারেন, রেসলিং এর জন্যেই জন্ম তাঁর। ঢুকে পড়েন রেসলিং এর জগতে। সেখান থেকে আসেন ডব্লিউ-সি-ডব্লিউ'তে, এরপর ডব্লিউ-ডব্লিউ-এফ এ, তারপর শেষমেশ যুক্ত হন ডব্লিউ-ডব্লিউ-ই এর সাথে। রেসলিং ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন 'টেক্সাস রেড' নাম দিয়ে। এরপর আস্তে আস্তে মিন মার্ক, পানিশার, কেইন দ্য আন্ডারটেকার এবং শেষে 'কেইন' শব্দটিকে বাদ দিয়ে হয়ে যান শুধুই আন্ডারটেকার; 'দ্য আন্ডারটেকার।' এরপরেই রিং এ রাজত্ব করার শুরু। মানুষজন দেখতে শুরু করে এক রাইজিং স্টার'কে, যিনি 'মৃত্যু'কে করেছেন তার সিগনেচার স্টাইল!
'রেসলিং' নামের কনসেপ্টেরও শুরুর সময় তখন। আশির দশকে অনেকটা যাত্রাপালার মতই ছিলো রেসলিং এর কর্মকাণ্ড। সার্কাসের রঙিন স্টেজের মতন ভাসমান রিং বসিয়ে রেসলিং হতো সেখানে। খুব বেশি বাজেটও থাকতো না এসবের পেছনে। রক্তক্ষয়ী মল্লযুদ্ধ, সামান্য পারিশ্রমিক...রেসলারদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ছিলো অনেকটা এরকমই। আস্তে আস্তে সেই রেসলিং-ই হয়ে যায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মহাযজ্ঞ। শুরুর দিকের রেসলিং এর খারাপ সময়ের পোস্টারবয় ছিলেন আন্ডারটেকার, দ্য রক এর মতন মানুষেরা। রেসলিং এর প্রথম যৌবনের সেই দৈন্যদশা অনেকটাই দেখেছেন আন্ডারটেকার। দেখেছেন সাফল্যের বর্তমান চেহারাটাও। সে হিসেবে 'রেসলিং' নামক বইয়ের এক বড়সড় অধ্যায়ের নামও হয়তো 'দ্য আন্ডারটেকার।'
রেসলিং এর মহোৎসব বলা হয় 'রেসলম্যানিয়া'কে। যেটার ৩৬ তম পর্ব হয়ে গেলো এবার। এই রেসলম্যানিয়ার ৩৬টা পর্বের মধ্যে ২৭টিতেই পারফর্ম করেছেন তিনি। এরমধ্যে ২১টিতেই ছিলেন অপরাজিত, টানা বাইশ বছর ধরে। সেই রেসলম্যানিয়াতেই তিনি আর থাকবেন না, এটা নিয়েও নির্ঘাত আক্ষেপ হবে রেসলিং-ভক্তদের। আন্ডারটেকার ছাড়া রেসলম্যানিয়া আর কতটুকু উত্তেজনা ছড়াবে, আর কতটুকু উত্তাপ দেবে মানুষের হৃদয়ে, সেটি অবশ্যই ভাবনার বিষয়।
তবে ক্যারিয়ার এখন না ছেড়েও উপায় ছিলো না। বেশ কয়েক বছর ধরেই ক্যামিও কিছু পারফরম্যান্সে আসা হচ্ছিলো তার, পুরোদস্তুর ম্যাচ খেলতেও পারছিলেন না। ২০১৭ সালে একবার তো অবসর দিয়েই দিয়েছিলেন। রেসলম্যানিয়া'তে রোমান রেইনের সাথে ছিলো সেই ম্যাচটি। শেষ ম্যাচ বিবেচনায় গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলো তার স্ত্রী, বন্ধুবান্ধব ও ৭৫০০০ দর্শক। ম্যাচ শেষে রিং এ রেখে এসেছিলেন হ্যাট, কোট এবং গ্লাভস। দিয়েছিলেন বিদায়েরও ঘোষণা। কিন্তু পরদিনই তিনি সরে আসেন তার সিদ্ধান্ত থেকে। কারণ- তিনি চাচ্ছিলেন না, তাঁর বিদায় এরকম হোক। ম্যাচের রেকর্ডেড ভিডিও থেকে তিনি দেখছিলেন- তিনি ঠিকভাবে হাঁটতে পারছেন না। নড়তে পারছেন না। কেমন যেন জড়ভরত হয়ে আছেন। শরীরের অতিরিক্ত ওজনে গতিবিধিও হয়ে গিয়েছে শ্লথ। এত বছর ধরে রাজত্ব করে আসা আন্ডারটেকারের বিদায় এরকম হতে পারে! মোটেও না। তিনি তাই বাতিল করলেন তার বিদায়ের ঘোষণা।
পরদিনই সার্জারি করালেন শরীরের কিছু স্থানে। অতিরিক্ত ওজন কমালেন। এই বয়সে এসেও অনেকটা সময় কাটালেন নিজের ক্ষিপ্রতা বাড়ানোর জন্যে। এরপর ২০২০ সাল এলো, দ্য লাস্ট রাইড এলো, বাইশে নভেম্বর এলো। এলো বিদায়ও। সবকিছু ঠিক থাকলে আর ফেরা হবেনা। ফিরলে সেটি আর ভালোও দেখাবেনা। সেই ভয়াল ইন্ট্রো, নীলচে রঙ আর ধোঁয়ার মধ্য থেকে কালো হ্যাট- কালো কোট-কালো গ্লাভস, ছয় ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা দেহ, ক্ষণে ক্ষণে চমক...আর নেই। বিদায়!
আন্ডারটেকার হয়তো রেসলিং এর রিং এ থাকতে পারতেন আরো কিছু বছর। হয়তো দর্শকদেরও ভালোই লাগতো। কিন্তু সেটি আর সম্ভব হতো না। কারণ- রিফ্লেক্স কমে যাচ্ছিলো তার। রেসলিং এর পুরোটাই তো অঙ্কের মতন। এক চুল ভুল হলেও এখানে নেমে আসতে পারে মারাত্মক ফলাফল। তাছাড়া তিনি রিং এ যেসব স্টান্টবাজি করতেন, সেগুলোর জন্যেও বয়সটা বড্ড বেশি। শরীরের নানা জায়গায় প্রচুর কাটাকাটির দাগ, প্রচুর অস্ত্রোপচারের সেলাই, প্রচুর ক্ষত। হাড়গোড়ও ক্রমশ হয়ে যাচ্ছে দূর্বল। যবনিকাপতনের হয়তো এটিই ছিলো তাই ঠিকঠাক সময়।
লেখা শুরু করেছিলাম, রেসলিং এর ধোঁকাবাজির গল্প দিয়ে। শেষে এসে এই প্রসঙ্গে আরো কিছু কথা না বললে, লেখাটা থেকে যাবে অসম্পূর্ণ। রেসলিং আপাদমস্তক পুরোটাই নাটক। সন্দেহ নেই। সবকিছুই স্ক্রিপ্টেড এখানে। দ্বিমত নেই। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছি আমরা, যতই নাটক হোক না কেন, রিং এর কয়েক ফুট দড়ির উপর দিয়ে একজন মানুষ আরেক মানুষের উপর লাফিয়ে পড়লে ব্যথা কিন্তু লাগেই। চেয়ার, টেবিল, মই সবকিছু দিয়ে আঘাত করলেই ব্যথা লাগে। রেসলাররা ব্যথাকে সহ্য করার ট্রেনিং নেন। তাই হয়তো ব্যথায় অতটা কুঁকড়ে যান না, তবে ব্যথা তারাও পান। প্রত্যেকটা ম্যাচের আগে অ্যাম্বুলেন্স, ডাক্তার, নার্স, অপারেশন থিয়েটার রেডি হয়ে থাকে। স্ক্রিপ্টের বাইরে বেকায়দায় একটুখানি হাত-পা পড়লেই মৃত্যু এখানে অবধারিত। একটু নথিপত্র ঘেঁটে দেখবেন, কত রেসলার এভাবে মারা গিয়েছে। অর্থাৎ বিষয়টি এটাই, আমরা যেটিকে সাজানো-গোছানো নাটক বলছি, বিষয়টি ঠিক সেরকম না মোটেও। এখানের রিস্ক অন্য অনেক ইন্ডাস্ট্রির চেয়ে অনেকগুণে বেশি। সে কারণেই হয়তো মানুষ মজে যায় সামারস্লাম, র, স্ম্যাক ডাউন অথবা রেসলমেনিয়াতে। এভাবেই ঝুঁকি, মৃত্যুভয় আর নানারকম স্টান্টবাজিতে রেসলিং চলছে। সামনেও চলবে। রেসলিং বন্ধ হবারও কোনো সম্ভাবনাও দেখি না। কিন্তু সেই রেসলিং এর সবচেয়ে বড় পোস্টারবয়ের বিদায়ে 'রেসলিং' একটু হলেও রঙ হারাবে, এটা পুরোপুরি নিশ্চিত।
বিদায় 'দ্য আন্ডারটেকার', অথবা মার্ক উইলিয়াম ক্যালওয়ে অথবা আমাদের আন্ডার-টাইগার। রিং এর বাইরের জীবনে ভীতি না, নিখাদ প্রীতি আর ভালোবাসা থাকুক, এটাই কামনা।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন