সংবাদপত্রের এই আকালের যুগে, এই ২০২১ সালে বসে যদি আপনি শোনেন যে এখনও বিশ্বের কোনো প্রান্তে হাতে লেখা সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে, তাহলে ভিরমি খাওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়?

সংবাদপত্র নামক বস্তুটার উদ্ভব যখন হয়েছিল, তখন সেটা সাদা কগজের ওপরে হাতে লিখে বিলি করা হতো। এই বঙ্গে যখন প্রথম সংবাদপত্র সমাচার দর্পন প্রকাশিত হয়, সেটাও ছিল হাতে লেখা খবরের কাগজ, কারণ ছাপার প্রেস জিনিসটা তখনও আবিস্কার হয়নি। এরপর কতশত বছর পেরিয়ে গেল, প্রযুক্তি কত এগিয়ে গেছে এই সময়টায়! অত্যাধুনিক প্রেসে এখন ছাপা হচ্ছে ঝকঝকে সব সংবাদপত্র, তবুও কাগুজে পত্রিকার দিন ফুরিয়ে আসছে বলেই মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা, কারণটা অবশ্যই ইলেক্ট্রনিক এবং অনলাইন মিডিয়া। হাতের নাগালে ইন্টারনেট থাকায় লোকে এখন পত্রিকা কেনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। একটা সময় হয়তো একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে কাগজে ছাপা সংবাদপত্র।

কিন্ত সংবাদপত্রের এই আকালের যুগে, এই ২০২১ সালে বসে যদি আপনি শোনেন যে এখনও বিশ্বের কোনো প্রান্তে হাতে লেখা সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে, তাহলে ভিরমি খাওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়?  অদ্ভুত হলেও কথাটা সত্য। ভারতের চেন্নাই থেকে গত একানব্বই বছর ধরে একটানা প্রকাশিত হয়ে আসছে উর্দু দৈনিক 'দ্য মুসলমান'। এটি বিশ্বের একমাত্র হাতে লেখা সংবাদপত্র। ১৯২৭ সালে প্রথম প্রকাশের সময় যেমনটা ছিল অবিকল সেভাবেই এখনও নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে এই পত্রিকাটি। এই একানব্বই বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে, পত্রিকাটির সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোও একে একে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কিন্ত 'দ্য মুসলিম' বদলায়নি, সরে আসেনি তার প্রাচীন অবস্থান থেকে।

১৯২৭ সাল, ভারতবর্ষ তখনও ইংরেজদের অধীনে। স্বাধীনতার সূর্য উঠি উঠি করছে সবে। সাইয়্যেদ আজাতুল্লাহ নামের এক মুসলমান বাস করতেন দক্ষিণ ভারতের চেন্নাইতে। সংবাদপত্র তখনও খুব বেশি সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি, মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমে উঁকি দেয়া শুরু করেনি গরম গরম খবরের কাগজ। আজাতুল্লাহ ছিলেন শিক্ষিত ব্যক্তি, হিন্দি, উর্দু আর ফারসী ভাষায় দারুণ দক্ষতা ছিল তার। তিনিই প্রথম অনুভব করলেন, মুসলমানদের জন্যে স্বতন্ত্র একটা পত্রিকা থাকা খুব দরকার, যেখানে মুসলমানদের দাবী-দাওয়াগুলো উঠে আসবে, তাদের বঞ্চনার কথা লেখা হবে, যেখানে ধর্ম আর ধর্মীয় বিষয়াদি সম্পর্কে লিখবেন পণ্ডিত ব্যক্তিরা। সেই ভাবনা থেকেই হাতে লেখা সংবাদপত্র হিসেবে সেবছর যাত্রা শুরু হলো 'দ্য মুসলমান'- এর।  গত একানব্বই বছর ধরে একই ধারা বজায় রেখেছে পত্রিকাটি। বংশানুক্রমে এই পত্রিকার সমাপদের দায়িত্ব পালন করেছেন সাইয়্যেদ বংশের উত্তরসূরীরাই। সাইয়্যেদ আজাতুল্লহার মৃত্যুর পরে সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তার ছেলে সাইয়্যেদ ফাজলুল্লাহ। ২০০৮ সালে ফাজালুল্লাহ'র মৃত্যু হলে তার একমাত্র সন্তান এবং সাইয়্যেদ আজাতুল্লাহ'র নাতি সাইয়্যেদ আরিফুল্লাহ পান সম্পাদকের দায়িত্ব। গত বারো বছর ধরেই এই দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। 

বর্তমান সম্পাদক সাইয়্যেদ আরিফুল্লাহ

‘দ্য মুসলমান’ পত্রিকাটির মূল আকর্ষণ এর অসাধারণ ক্যালিগ্রাফি। খবর সাজানোর পাশাপাশি রঙ, তুলির বৈচিত্র্যে নানা ক্যালিগ্রাফি ফুটিয়ে তোলার কাজ করেন তিনজন ‘কাতিব’। সম্পাদকের মতে- 

‘দ্য মুসলমানের অন্যতম আকর্ষণই হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি। বলা যায়, ক্যালিগ্রাফি এ পত্রিকাটির প্রাণ। আর প্রাণকে শেষ করে ফেললে এ পত্রিকাটির আর কিছু থাকবে না।’ 

রং আর বিভিন্ন কলম ও তুলি দিয়ে লেখা হয় শিরোনাম ও ছবির ক্যাপশন। তবে এখানে কোনো খবরেরই বাইলাইন নেই।  চার পাতার কাগজের প্রথম পাতায় থাকে দেশ ও বিদেশের খবর। দ্বিতীয় পাতায় শুধুই সম্পাদকীয়। পরের পাতা দু’টিতে স্থানীয় খবর ও বিজ্ঞাপন। সম্পাদক সাইয়্যেদ আরিফুল্লাহ জানিয়েছেন, ব্রেকিং নিউজ সাধারণত এই দৈনিকে প্রকাশিত হয় না। কারণ সবিস্তার খবর ফের লিখতে গেলে অনেক সময়, পরিশ্রম ও লোকবলের প্রয়োজন। মূলত সমাজের নানা বিষয়ের উপরই জোর দেওয়া হয় এই সংবাদপত্রে। ইসলাম ভিত্তিক খবর প্রথম পছন্দ হলেও সবরকম পাঠকের জন্যই খবর বেছে প্রস্তুত করা হয় এখানে।

কলকাতার জনপ্রিয় পত্রিকা আনন্দবাজারের সূত্রে জানা যায়, চেন্নাইয়ের ট্রিপলিকেন হাই রোডে দু’কামরার ছোট্ট দু’টি ঘরে প্রথম কাজ শুরু হয় এই 'দ্য মুসলমান'- এর। চার পাতার কাগজটির সব খবর সাজিয়ে দেন আরিফুল্লাহ। এর পর রঙ, তুলি দিয়ে ক্যালিগ্রাফির কাজ শুরু করেন মুখ্য ‘কাতিব’ রহমান হোসেইনি। ১৯৮০ সালে তিনি এই পত্রিকায় যোগ দেন, এখনো নিরলসভাবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর মাসিক বেতন ২,৫০০ টাকা। খবর লেখার দায়িত্বে রয়েছেন শাবানা ও খুরশিদ বেগম। প্রতিটি পাতা সাজানোর জন্য দিনে ৬০ টাকা করে বেতন পান তাঁরা।  দৈনিকের কাজ শুরু হয় সকাল ১০টা থেকে। দু’জন অনুবাদক খবরগুলো উর্দু ভাষায় লিখে দেন। ঘণ্টা দু’য়েক ধরে অনুবাদের কাজ চলে। তারপর ক্যালিগ্রাফি ও লেখার কাজ শুরু করেন তিন ‘কাতিব’। তারপর যুক্ত করা হয় বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান যদি ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের ফাইল প্রদান করে তাহলে সেগুলোও ক্যালিগ্রাফাররা হাতে এঁকে পত্রিকায় সংযুক্ত করে দেন। মূল কপি তৈরি হয়ে গেলে দুপুর ১টা নাগাদ প্রিন্টের মাধ্যমে বাকি কপিগুলি তৈরি হয়। সন্ধের মধ্যে খবরের কাগজ পৌঁছে যায় প্রায় ২২ হাজার পাঠকের হাতে। চেন্নাই ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন স্থানে আছে এই পত্রিকার গ্রাহক। অনেকে শুধুমাত্র ঐতিহ্যগত কারণেই পত্রিকাটির গ্রাহক হয়ে আছেন। দূরের পাঠকদের ডাকের মাধ্যমে পত্রিকা পৌঁছে দেয়া হয়। 

দ্য মুসলমান 

চার পৃষ্ঠার এই  সংবাদপত্রটির দাম মাত্র ৭৫ পয়সা, বাংলাদেশী টাকায় যেটা এক টাকার সমান। 'দ্য মুসলিম' কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হয় না, সাইয়্যেদ পরিবারের আয়ের মূল উৎস হচ্ছে প্রেসের ব্যবসা। এছাড়া পত্রিকায় আসা বিজ্ঞাপন থেকেও কিছু আয় হয়।  মুসলমানদের একটা স্বতন্ত্র সংবাদপত্রের রয়োজনীয়তা থেকে দাদা সাইয়্যেদ আজাতুল্লাহ যে কার্যক্রম শুরু করেছিলেন, বংশ পরম্পরায় সেটা টিকিয়ে রেখেছেন উত্তরসূরীরা। ঐতিহ্যের সাথে তারা ব্যবসাকে মেলাতে চান না।  বর্তমান সম্পাদক সাইয়্যেদ আরিফুল্লাহ বলছিলেন- 

‘‘দ্য মুসলমান কথনওই থেমে থাকবে না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই কাগজের ঐতিহ্য একই রকম থাকবে। দেশের সবস্তরের পাঠকের কাছে খবর পৌঁছে দেওয়াই এই দৈনিকের একমাত্র উদ্দেশ্য।’’ 

সবার কাছে খবর পৌঁছে দেয়ার ব্রতকে সামনে রেখেই এগিয়ে চলছে দ্য মুসলমান, একানব্বই বছরেই থামেনি যে যাত্রা। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে যেখানে প্রিন্ট মিডিয়াই বিলুপ্ত হতে বসেছে, সেখানে দুই কামরার ঘুপচি একটা অফিসে হাতে লেখা একটা সংবাদপত্র টিকে আছে গত একানব্বই বছর ধরে, এটা ভাবতেই তো অবাক লাগে!

তথ্যসূত্র- দ্য হিন্দু, দৈনিক আনন্দবাজার


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা