দ্য হ্যাপেনিং- করোনার এক যুগ আগেই যে সিনেমাটা আমাদের সতর্ক করেছিল!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

কী মনে হয়, কিছুদিন পর পর প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো কি অযথাই হয়? শুধু গজব বলে চালিয়ে দিলে হবে? সেই গজবের কারণ খুঁজে বের করতে হবে না?
কোভিড-১৯ নামের করোনাভাইরাস, যা আতঙ্ক ছড়িয়েছে বিশ্বব্যাপী। ভাইরাসটার সাথে আতঙ্ক ছুঁয়েছে আমাদেরও। গৃহবন্দী থাকাটাই যেখানে প্রতিকার, তাই অবসরে সিনেমা দেখে বাঁচাটাও মুভি অ্যাডিক্টেডদের অধিকার। জনসমাগমে না গিয়ে ঘরে বসে সিনেমা দেখাটাই নিরাপদ আপাতত। প্রসঙ্গগতই প্যান্ডেমিক এপিডেমিক অর্থাৎ, বিশ্বব্যাপী মহামারির বিষয়বস্তু নিয়ে নির্মিত সিনেমা দেখার হিড়িক পড়েছে আমাদের মাঝে। হয়তো অনেকেই সিনেমা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি পরিস্থিতির ভয়াবহতা। তবে জীবন কিন্তু সিনেমার থেকেও ট্র্যাজিক। তাই আজকের আলাপটা থাকবে এসব নিয়েই।
ভাইরাস মহামারি নিয়ে নির্মিত সিনেমার তালিকায় এগিয়ে রয়েছে কন্টাজিওন। করোনাভাইরাসের প্রেক্ষাপটের সাথে কাকতালীয়ভাবে মিল থাকা এ সিনেমা উপযোগ সৃষ্টি হয়েছে নতুন করে। কিছুদিন আগেও হয়তো এ ধরণের সিনেমায় আগ্রহ ছিলো না অনেকের। পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। দ্য লাস্ট শিপ কিংবা দ্য স্ট্রেইন এর মতো টিভি সিরিজ অথবা আউটব্রেক, দ্য এন্ড্রোমেডা স্ট্রেইন, দ্য হট জোন, টুয়েলভ মাঙ্কিজ, ওয়ার্ল্ড ওয়ার জি, দ্য ওমেগা ম্যান, প্যান্ডেমিক, দ্য ফ্লু, বার্ড বক্স, দ্য হট জোন, ট্রেন টু বুসান, টুইয়েন্টি এইট ডেইজ লেটার এর মতো সিনেমাগুলোর নাম উঠে এসেছে এই লিস্টে। অথচ যে সিনেমাটা সবচাইতে প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে সেটা নিয়েই কোনো আলোচনা দেখছি না।
দ্য হ্যাপেনিং। হ্যাঁ, ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাটাই আমার কাছে সবচাইতে প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে। মেটাক্রিটিকে ৩৪% স্কোর, রটেন টোমাটোজে ফ্রেশনেস মাত্র ১৮%, আইএমডিবিতে ১০ এ ৫ রেটিং পাওয়া সিনেমাটাই কেন সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক মনে হলো? এটার ব্যাখাই করার চেষ্টা করবো এখন।

মাস্টার অফ টুইস্টেড থ্রিলার্স খ্যাত এম নাইট শ্যামালান পরিচালিত সাই-ফাই ফ্যান্টাসি ড্রামা ‘দ্য হ্যাপেনিং’। প্রোটাগনিস্ট হিসেবে আছেন পরিচিত মুখ মার্ক ওয়ালবার্গ। দ্য হ্যাপেনিং সিনেমায় দেখানো হয়েছে- আমেরিকার বাতাসে এক ধরণের টক্সিনের উপস্থিতি অনুভূত হয় যার ফলে মানুষ আত্মহত্যা করতে শুরু করে। খুব উদ্ভট ধরণের প্লট মনে হতে পারে। তেমন কিছু মনে করার আগে একটু ভাবুন, কেন এমন হবে? কেন এমন ভাইরাসের আগমন এবং আক্রমণ ঘটবে যার কারণে মানব সম্প্রদায়ের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে? এমনটা কি সিনেমাতেই ঘটছে শুধু? বাস্তবে হচ্ছে না?
আসুন সিনেজগত থেকে বাস্তবতার দিকে নজর ফেরানো যাক। ১৭২০ সালের প্লেগ, ১৮২০ সালের কলেরা, ১৯২০ সালের স্প্যানিশ ফ্লু, ২০২০ সালের করোনাভাইরাস... এভাবে প্রতি ১০০ বছরেই কেন বিশ্বব্যাপী মহামারি দেখা দেয়? ফ্রান্সভিত্তিক ওয়েবপোর্টাল মেজুওল ডট কম একটা ইন্টারেস্টিং আর্টিকেল প্রকাশ করেছে সম্প্রতি। সেখানে তারা বলছে, প্রতি ১০০ বছরে একটা করে বৈশ্বিক মহামারি ছড়িয়ে পড়ছে। অন্তত গত ৪০০ বছরের ইতিহাস সে সাক্ষী দেয়। এছাড়া ইবোলা, সোয়াইন ফ্লু, ডেঙ্গুর মতো ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব তো রয়েছেই।
এগুলো কি শুধুই কাকতালীয়? নাকি প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে? ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে যেখানেই মানুষের আনাগোনা কমেছে, পরিবেশ দূষণও কমতে শুরু করেছে। প্রকৃতি কি তাহলে তার ওপর আরোপিত অযাচিত দূষণ কমাতে নিজের পথ তৈরি করে নিয়েছে? কখনো টেকনিকাল সাহায্যের জন্য কোনো হেল্পলাইনে কল দিয়েছেন? তারা কি বলে জানেন? প্রথমেই জিজ্ঞেস করে আপনার ডিভাইসটা রিস্টার্ট দিয়ে দেখেছেন তো? এটা নিয়ে অনেক হাস্যরসও হয়ে থাকে। কেন রিস্টার্টের কথা বল হয় সাধারণত? কেন রিস্টার্ট জরুরী? সহজ ভাষায়- যখন আপনি কোনো ডিভাইস রিস্টার্ট করবেন সেটা ডিভাইসের সকল অপ্রয়োজনীয় ডেটা ক্লিন করে ডিফল্ট মোডে নিয়ে আসবে। আর আপনার ডিভাইসটা ঐ উত্তপ্ত বা ‘হ্যাং’ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে।
আমাদের পৃথিবী নামক ডিভাইসটাও উত্তপ্ত হয়ে আছে। সে তার স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। এই উত্তাপ ছড়াচ্ছি আমরাই। মানবসম্প্রদায় পরিবেশ দূষণ এর মাধ্যমে জলবায়ুর যে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে তাতে পৃথিবী শুধু উত্তপ্তই হচ্ছে দিনকে দিন। আচ্ছা এই ভাইরাসগুলো আসছে কোথা থেকে? জলবায়ুর পরিবর্তনে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে, গলছে বরফ- উন্মুক্ত হচ্ছে ভাইরাস। অ্যান্টার্কটিকার গ্লেসিয়ারগুলোকে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর ‘প্রাকৃতিক ফ্রিজার’, যেখানে কয়েক হাজার বছরের পুরোনো মৃতদেহগুলো অনেকটা অক্ষত অবস্থায় বরফের নিচে চাপা রয়েছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে গ্লেসিয়ারগুলো গলতে শুরু করায় উন্মুক্ত হতে শুরু করেছে সেই মৃতদেহগুলো। জমাটবদ্ধ বরফে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াগুলো এত বছর যাবত সুপ্ত অবস্থায় থাকলেও বরফ গলার সাথে সাথে সেগুলো পুনরায় জীবন্ত হতে শুরু করেছে।
বিজ্ঞানীরা এই অণুজীবগুলোর নাম দিয়েছেন ‘টাইম ট্রাভেলিং ভাইরাস’, ২০১৫ সালে তিব্বতের গলিত গ্লেসিয়ারের ওপর গবেষণা চালান সালে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের একটি দল। ১৫৪ ফুট গভীর গর্ত করে তারা ১৫ হাজার বছরের পুরোনো নমুনা সংগ্রহ করেন। ল্যাব পরীক্ষার পর সেই নমুনা থেকে ৩৩ ধরণের ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যার মধ্যে ২৮টি ভাইরাস বিজ্ঞানীদের কাছে একদমই নতুন। ২০১৬ সালে সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চলে ১২ বছরের এক বালকের মৃত্যু ঘটে এবং একইসাথে আরও কিছু মানুষ অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন, যারা মূলত ‘বরফে জমাটবদ্ধ থাকা অ্যানথ্রাক্স ভাইরাস’ এ আক্রান্ত হয়েছিলেন। বিবিসির রিপোর্টে এ তথ্যগুলোর সত্যতা মিলেছে।
কালের বিবর্তনে উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে গলতে থাকবে অ্যান্টার্কটিকার আরও অনেক গ্লেশিয়ার এবং সমুদ্রের পানিতে মিশতে থাকবে নাম না জানা আরও কিছু ভাইরাস, যেখানে এক ‘করোনাভাইরাস’ নিয়ন্ত্রণেই বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সর্বশক্তিও হিমশিম খাচ্ছে।
প্রাণঘাতী এই করোনাভাইরাস বারবার নিজের জিন বদলে উত্তোরত্তর ভয়াবহ হয়ে উঠছে। এরই মধ্যে সে টিকে থাকার স্বার্থে ৩৮০ বার নিজের জিন বদলে ফেলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কোভিড-১৯ এর এই জিন মিউটেশনই ভয়ের আসল কারণ। এই শক্তিশালী জেনেটিক মিউটেশন কাদের হয় জানা আছে নিশ্চয়ই? কমিকবুক মুভি দেখে থাকলে তো অবশ্যই জানবার কথা। একবার ভাবুন তো, এই ভাইরাসটা যদি মানবদেহে মিউটেশন ঘটাতে সফল হয় তবে কী অবস্থা হবে? হতে পারে আপনি এক্স-মেন হয়ে গেছেন বা ওয়াকিং ডেডের কোনো জম্বি কিংবা দ্যা হ্যাপেনিং এ আত্মহত্যা করা কেউ।
আমি মেডিকেল সায়েন্সের কোনো রিসার্চার না। বরং সায়েন্স ফিকশন এর স্টুডেন্ট বলা যায়। এখন আমাকে উন্মাদ ভাবার পাশাপাশি আরো কিছু ভাবুন প্লিজ। ভাবার প্র্যাকটিস করুন। প্রাসঙ্গিকভাবে আবারো ঐ একই প্রশ্ন রেখে যাই, এই ভাইরাসগুলো কি শুধুই কাকতালীয়? নাকি প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে? আরেকটা বিষয় তুলে ধরি তাহলে। গত কিছুদিন ধরে করোনার মহামারিতে ইতালি লকডাউন করে দেয়া হয়েছে। এই লকডাউনের ফলাফল কি জানেন? ভেনিসের নালার পানিগুলো পরিস্কার হতে শুরু করেছে। সেখানে মাছের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। হাঁস সাঁতার কাটছে। কোস্টাল এরিয়াগুলোতে ডলফিনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ, ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে যেখানে মানুষের আনাগোনা কমেছে, পরিবেশ দূষণও কমতে শুরু করেছে। প্রকৃতি তার স্বাভাবিক রুপে ফিরতে শুরু করেছে। তাহলে কি এভাবে মাদার নেচার তার ওপর আরোপিত অযাচিত দূষণ কমাতে নিজের পথ তৈরি করে নিয়েছে?
আমার লেখায় বিশ্বাস না হলে, করোনায় আক্রান্ত হবার আগে ও পরের- পৃথিবীর পরিবেশ দূষণের স্যাটেলাইট থার্মাল ইমেজ গুগল করে চেক করে দেখুন প্লিজ। দেখলে মনে হবে, পৃথিবী নিজেই নিজেকে শান্ত করার মরণপণ চেষ্টা করছে। নিজেকে শান্ত করার এই চেষ্টায় একদিন হয়তো পৃথিবী নিজেকেই ধ্বংস করে ফেলবে। কী মনে হয়, কিছুদিন পর পর প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো কি অযথাই হয়? শুধু গজব বলে চালিয়ে দিলে হবে? সেই গজবের কারণ খুঁজে বের করতে হবে না?