অশ্রু টলোমলো চোখ আর ভাঙা মন নিয়েই তাপসী দৃঢ় গলায় বলছেন- 'একটা থাপ্পড়ই হয়তো, কিন্ত সেটা মারার অধিকার ওর নেই!' এটাই সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, থাপ্পড়টা নয়।

এই থাপ্পড়টার বড্ড দরকার ছিল। পুরুষশাসিত সমাজের মুখে, প্রচলিত কিছু ভ্রান্ত আর অর্থহীন ধ্যান-ধারণার মুখে জোরালো একটা চপেটাঘাতের প্রয়োজন ছিল খুব। ডমেস্টিক ভায়োলেন্স ব্যাপারটাকে যারা খুবই স্বাভাবিক বিষয় মনে করেন, নিত্যদিনের সংসারে চড়-থাপ্পড়ের মতো বিষয়টা যাদের চোখে একদমই সামান্য কিছু- তাদের গালে চড়ের দাগটা বসিয়ে দেয়ার জন্যে অনুভব সিনহাকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ তাপসী পান্নুকেও, দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে পুরো সিনেমাটাকে টেনে নেয়ার জন্যে। যে গল্পের ওপর সিনেমাটা, তাতে পারফরম্যান্সে উনিশ-বিশ হলে বিপদ ঘটতে পারতো, তাপসী সেটা হতে দেননি।

সামান্য একটা থাপ্পড়ের জন্যে ডিভোর্স? প্রশ্নটা ট্রেলার রিলিজের পরেও উঠেছিল, সিনেমা দেখার পরেও অনেকে তুলবেন জানি। তারা আসলে গল্পের মূল মেসেজটাই ধরতে পারেননি। থাপ্পড়টা এখানে প্রতীকি, থাপ্পড়ের আড়ালে বলা হয়েছে মেনে নেয়ার নামে চাপিয়ে দেয়া অসঙ্গতির কথা। বিষয়টা শুধু একটা থাপ্পড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়েছে আত্মসম্মান আর বিবেকবোধ অবদি। সেটুকু মাথায় না ঢুকলে এই অবান্তর প্রশ্নটা যে কেউই করবে। 

স্বামী পাভেল গুলাটিকে নিয়ে তাপসী পান্নুর সুখের সংসার, মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাট একটা জীবন। ভালোবাসা, স্বপ্ন, আহ্লাদ- সবকিছুই আছে সেখানে। সাজানো জীবনটা হঠাৎই ওলট-পালট হয়ে গেল এক সন্ধ্যায়, আলো ঝলমলে এক ঘরোয়া পার্টিতে একগাদা মানুষের সামনে তাপসীর গায়ে হাত তুললেন তার পতিদেবতাটি। ওই একটা থাপ্পড় আসলে সিনেমার প্রাণ নয়, তবে অনুঘটক তো অবশ্যই। 

থাপ্পড়টা এখানে প্রতীকি বিষয়

সেই থাপ্পড়টার পরেই হঠাৎ করে তাপসীর চোখে নিজেদের সম্পর্কের অনেকগুলো ফাঁকা স্থান নজরে পড়লো, যেগুলো এতকাল হয়তো মানিয়ে নেয়ার নাম করে ওভারলুক করে গিয়েছিল সে। দাম্পত্যের শুরু থেকে নিজেকে শুধু উজাড় করে দিয়েছে সে, নাচ ছেড়েছে, ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে লক্ষ্মী ঘরণী হবার মিশনে নেমেছে, দিনশেষে প্রাপ্তির খাতায় জমা পড়েছে শূন্য, না না, একটা থাপ্পড়ও আছে। 

নারীর গায়ে হাত তোলার বিষয়টাকে যে কত ছোট করে দেখা হয় আমাদের সমাজে, সেটাই অনুভব সিনহা দেখিয়েছেন খুব কাছ থেকে। স্বামীর কাছ থেকে আলাদা হবার জন্যে যখন লড়াই শুরু করলেন তাপসী, তাকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে এগিয়ে এলেন না তেমন কেউই, এমনকি তার বাড়ির লোকেরাও নন! তাপসীর উকিল পর্যন্ত চোখ কপালে জিজ্ঞেস করছেন- একটা থাপ্পড়ের জন্যে ডিভোর্স? যেন স্বামীর হাতের থাপ্পড়টা রোজকার ডালভাতের মতোই ব্যাপার- আসলেও হয়তো তাই। কিন্ত অশ্রু টলোমলো চোখ আর ভাঙা মন নিয়েই তাপসী দৃঢ় গলায় বলছেন- 'একটা থাপ্পড়ই হয়তো, কিন্ত সেটা মারার অধিকার ওর নেই!' এটাই সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, থাপ্পড়টা নয়। 

লোকে বলে জীবনটা আপোষের, মানিয়ে নেয়ার, মানিয়ে চলার। আসলেই কি? মানিয়ে নিতে হলে সেটার সীমা কতটুকু? সারা মাস খেটেখুটে অল্প ক'টা টাকা আয় করে স্বামীর মার খেয়ে তার হাতে মদ গেলার টাকা তুলে দেয়ার নাম কি মানিয়ে নেয়া? সর্বগুণান্বিতা নারী হয়েও স্বামীর আভিজাত্যের ঠুনকো অহংকারের সামনে প্রতিদিন মাথা নত করার নাম মানিয়ে নেয়া? নাকি সবকিছু বিসর্জন দিয়ে সংসারটাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাওয়া নারীর মুখে কষে চড় লাগানোর পরেও সেই সংসারে টিকে থাকার নাম মানিয়ে নেয়া? 

তাপসী পান্নু ও পাভেল গুলাটি

মূল গল্পটার পাশাপাশি অনেকগুলো ছোট ছোট গল্প সমান্তরালে চলেছে, আবার একটা সময়ে সবগুলো এসে একীভূত হয়ে গেছে আদি ও অকৃত্রিম জায়গাটাতে- পুরো ব্যাপারটাই অসম্ভব কনভিন্সিং ছিল, জোর করে চাপিয়ে দেয়া মনে হয়নি কোনটাকেই। পার্শ্বচরিত্রগুলো গল্পের প্রয়োজনে এসেছে, পাভেল গুলাটি, দিয়া মির্জা, কুমুদ মিশ্র, রত্না পাঠক শাহ, বা মাত্র চারটা সিকোয়েন্সের জন্যে হাজির হওয়া রাম কাপুর- প্রত্যেকেই যার যার জায়গায় দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। সিনেমাটার পূর্ণতা পাওয়ার পেছনে এটা একটা বড় কারণ। ফ্ল-লেস পারফরম্যান্স ছিল প্রত্যেকেরই। 

দুটো দৃশ্য চোখে লেগে আছে এখনও। থাপ্পড়ের সেই রাতটা কেটে গেছে, গালের দাগটাও মিলিয়ে গেছে, কিন্ত মনের আঘাতটা তো কাটেনি। সকাল হবার আগেই তাপসী পান্নু উঠে আসবাব পত্র গুছিয়ে রাখছেন, রাতের পার্টির ছাপটা দূর করতে চাইছেন বাড়ি থেকে। একা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না, ভারী সোফার সাথে মেঝের ঘর্ষণে আওয়াজ হচ্ছে। সোফা তো নিজের জায়গায় ফেরত আসবে, সম্পর্কটা কি ফিরবে? ঘর নাহয় গোছানো যাবে, ভেঙে যাওয়া মনটা গুছিয়ে দেবে কে? 

কোর্টে আরেকটা সিকোয়েন্স- তাপসীর বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আনছেন তার স্বামীর উকিল, তার চরিত্র নিয়ে কুৎসা রটানো হচ্ছে। তাপসী শুনছেন, আবার শুনছেন না হয়তো। তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন স্বামীর দিকে, যার সঙ্গে এতগুলো দিন কাটিয়েছেন, সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন বন্ধুর মতো। চোখে অবিশ্বাস নিয়েই হয়তো তার জিজ্ঞাসা ছিল- কীভাবে পারলে তুমি? দুটো দৃশ্যের কোথাও তাপসীর মুখে সংলাপ নেই, শুধু অভিব্যক্তি দিয়েই বাজীমাত করে দেয়া এমন পারফরম্যান্সের দেখা রোজ রোজ মেলে না।

থাপ্পড় একটা জিনিস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে- ডমেস্টিক ভায়োলেন্স ব্যাপারটা শুধু নিম্নবিত্তের জীবনের অংশ নয়। মধ্যবিত্ত থেকে সমাজের উঁচু তলা, সব জায়গাতেই এটা বিদ্যমান। দিনের পর দিন ঘটে আসছে এই পাশবিক আচরণটা, আমরা সেটাকে মানিয়ে নেয়ার মোড়কে মুড়িয়ে দিয়েছি, 'দুটো পাতিল একসঙ্গে থাকলেও তো ঠোকাঠুকি হবেই' টাইপের জঘন্য উপমা দিয়ে হালকা করেছি। পুরুষশাসিত এই সমাজে ডমেস্টিভ ভায়োলেন্সটা হয়তো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। দেরীতে হলেও অনুভব সিনহার মতো কেউ আওয়াজ তুলেছেন এর বিপক্ষে, এটাই সাধুবাদ জানানোর মতো। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা