পানুসায়া: মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে রাজপরিবারের বিপক্ষে যে তরুণী নেতৃত্ব দিচ্ছেন থাই বসন্তের!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

থাইল্যান্ডে রাজপরিবারের অন্যায়, জুলুমের বিপক্ষে কথা বলা যায় না। রাজপরিবারের সমালোচনা করলেও শাস্তির বিধান আছে, হতে পারে মৃত্যুও। কিন্তু সেই দেশেই মানুষ আজ প্রতিবাদে নেমেছে রাজপরিবারের বিরুদ্ধে, আর সেই প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ২১ বছরের এক তরুণী!
থাইল্যান্ড অথবা মুক্তভূমি, যারা কোনোদিন ছিলো না অন্য কোনো রাষ্ট্রের অধীনে, সেই থাইল্যান্ড বেশ কিছুদিন ধরেই উত্তাল। রাজতন্ত্রের বেশ কিছু বিতর্কিত নিয়মকানুন নিয়ে ফিসফাস, চাপান-উতোর বেশ অনেকদিন থেকেই ছিলো। সে ভস্মে যেন ঘি পড়েছে সম্প্রতি। যে বিক্ষোভ হচ্ছে থাইল্যান্ডে, এমনটা আর হয়নি কখনো আগে। রাজপরিবারের দিকে আঙ্গুল তুললে যেখানে আগে গর্দান খুইয়ে ফেলবার ভয় থাকতো, সেখানে মানুষ সরব হচ্ছে রাজপরিবারের বিতর্কিত নিয়মকানুনের বিপক্ষে। প্রতিবাদ জানাচ্ছে। হাওয়াবদল হচ্ছে। কিন্তু এ আন্দোলনের শুরুটা কীভাবে? কেনই বা এ আন্দোলন? এ আন্দোলনে বারবার কেন উঠে আসছে একটি নাম- পানুসায়া সিথিজিরাওয়াত্তানাকুল? সবই জানার চেষ্টা করবো আমরা আজ।
আপনি যদি পৃথিবীর আঁকিবুঁকি মানচিত্রে একবার একটু তাকান, দেখবেন- পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে, যে দেশে রাজপরিবারকে অসম্মান না করার জন্যে আইন আছে। তবে এরকম আশ্চর্যজনক আইন আছে থাইল্যান্ডে। যে আইন অনুযায়ী, রাজা, রানি, রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বা রাজ দায়িত্ব পালনকারী কারো সমালোচনা করার শাস্তি ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। ধরা যাক, একটা রাস্তা দিয়ে থাই রাজপরিবারের গাড়িবহর যাবে। সেই রাস্তার দুই পাশের প্রত্যেক বাড়ির মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সেই গাড়িবহরকে সম্মান করতে হবে। কেউ যদি অসুস্থও হয়ে থাকে, মাফ নেই। আসতেই হবে। তাছাড়া সরকারের ও রাজতন্ত্রের প্রকাশ্য সমালোচনা করা যাবেই না। তাহলেই খুইয়ে ফেলতে হবে নিজের প্রাণ।
সম্প্রতি এভাবেই প্রশাসনের সমালোচনা করে নিখোঁজ হয়েছিলেন কিছু মানুষ। পরে তাদের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে৷ থাইল্যান্ডে গনতন্ত্রকামী কোনো দল, কোনো মুক্তবুদ্ধির সংগঠন দাঁড়াতে পারে না। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ও রাজপরিবারের মদদে সেসব দল ও সংগঠনকে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় খুব ছোটবেলাতেই।
এখানেই শেষ নয়। থাই রাজপরিবারের বিলাস-ব্যসনে খরচ হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারের সিংহভাগ। দেশের উন্নয়ন পরে, রাজপরিবারের রাজকীয়তা আগে... এভাবেই চলছে মুক্তভূমি 'থাইল্যান্ড।' এ রাজপরিবারের বিভিন্ন সদস্যেরও রয়েছে স্বেচ্ছাচারিতার, অত্যাচারি কার্যকলাপের নানারকম আখ্যান। কিন্তু কথা বলা যাবেনা, উচ্চারণ করা যাবেনা একটি ঋণাত্মক শব্দও। সবমিলিয়ে ক্ষোভ ক্রমশই দানা বাঁধছিলো। যে দানা বারুদ হয়ে জ্বলে উঠেছে সম্প্রতি।
এবার প্রেক্ষাপটে আসবে পানুসায়া সিথিজিরাওয়াত্তানাকুল এর কথা৷ খুব ছোটবেলা থেকেই সে দেখে আসছে থাই রাজপরিবারের স্বেচ্ছাচারিতা। খুব ছোটবেলা থেকেই তাই তার বিদ্বেষ জন্মেছে এই রাজ-পরিবারের উপর। অল্পবয়স থেকে সে পড়াশোনা শুরু করেছিলো রাজনীতি নিয়ে। বাবার কাছ থেকেও পাচ্ছিলো রাজনীতির নানা পাঠ। তবে মুখচোরা স্বভাবের হওয়ায় মুখ ফুটে অনেক কিছুই বলা সম্ভব হচ্ছিলো না তার পক্ষে। চুপ করে সহ্য করাই ছিলো নিয়তি। এরই মাঝে একবার পাঁচ মাসের জন্যে আমেরিকা যান একটা কোর্স করতে। সেখানে গিয়ে এক বিরাট পরিবর্তন হয় তার। যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে আর ভয়-ডর পেতেন না পানুসায়া। জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যায় পাঁচ মাসের এ কোর্স!
দেশে ফিরে তিনি ভর্তি হন থাম্মাসাত ইউনিভার্সিটিতে। রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা, সক্রিয়তা আরো বাড়ে তার। তিনি "ডোম রেভল্যুশন" নামে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনৈতিক দলেও যোগ দেন পরবর্তীতে। এভাবেই চলছিলো পানুসায়ার জীবন। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটে এক ঘটনা, যে ঘটনা তার জীবনকে পালটে দেয় পুরোপুরি। আগেই বলেছি, গনতন্ত্রকামী জনপ্রিয় কোনো দলের উত্থান সহ্য করতে পারেন না থাই সরকার ও রাজপরিবার। তারই ধারাবাহিকতায় ফেব্রুয়ারিতে 'ফিউচার ফরোয়ার্ড' নামের এক রাজনৈতিক দলকে ভেঙ্গে দেয় তারা, যে দলটি ছিলো তরুন ভোটারদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এই দলকে অন্যায়ভাবে ভাঙ্গার পরপরেই বিক্ষোভ হয় সারা দেশে। যে বিক্ষোভে নেতৃত্বের সারিতে ছিলেন পানুসায়াও৷

এ আন্দোলন যখন বেশ ভালো একটা গতিশীলতা পেলো, পানুসায়া সহ বাকিরা বুঝতে পারলেন, মানুষ এখন আর রাজপরিবার, রাজতন্ত্রের দিকে আঙ্গুল তুলতে ভয় পায় না। ফলে এ আন্দোলন, এ বিক্ষোভ তাই আর থামেনি। ক্রমশই জোরদার হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে এ বছরের আগস্ট মাসে হয় এক সম্মেলন। যে সম্মেলনে প্রথমবারের মত মঞ্চে উঠে এসে সরাসরি থাই রাজপরিবারের দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে আঙ্গুল তোলেন পানুসায়া। তিনি রাজপরিবারের সংস্কারের জন্যে দশটি দফা দাবীও পেশ করেন, যেগুলো এখন সে দেশের বিখ্যাত দশ-দফা ম্যানিফেস্টো'তে রূপান্তরিত হয়েছে।

যদিও সবাই বেশ অবাক হয়েছে এতে। একুশ বছরের এক মেয়ে যে এভাবে বারুদের টুকরো হয়ে দাবানল ছড়িয়ে দেবে, সরাসরি প্রশ্ন তুলবে রাজপরিবারের কর্মকাণ্ড নিয়ে... সেটা হয়তো মানুষ দূরতম কল্পনাতেও ভাবেনি। কিন্তু সেটিই হয়েছে। যদিও এ ঘটনার পরে পানুসায়ার জীবন একটু জটিল হয়েছে। সাদা পোশাকের পুলিশ তাকে সবসময়েই নজরদারিতে রাখছে। সরকারপন্থী পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো তাকে কটাক্ষ করছে। অনেকেই বলছে পানুসায়া বিরোধীদলের সাথে জড়িত। থাই প্রশাসন থেকে জানানো হচ্ছে, দেশের প্রতি ঘৃণা থাকা একটি রোগ। তারা আন্দোলনকারীদের 'মানসিক রোগী' হিসেবেও চিহ্নিত করছেন। পানুসায়ার ভবিষ্যৎ কী হবে, জানা নেই কারো। হয়তো তাকে গ্রেফতার করাও হতে পারে। হয়তো মেরেও ফেলা হতে পারে তাকে। তাকে নিয়ে করা হতে পারে অনেক কিছুই।
তবে এসব নিয়ে খুব একটা গা করছেন না তিনি। 'সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কী ভয়' ধরণের মানসিকতা তার। নিজেই বলেছেন-
আমি জানতাম, এভাবে প্রকাশ্যে কথাগুলো বলার পরে আমার জীবন আর আগের মতন থাকবে না। পালটে যাবে সব। আমি এটা মেনে নিয়েই কথাগুলো বলেছি। আমার মনে হয়েছিলো, এ কথাগুলো বলা দরকার। কাউকে না কাউকে সামনে এগিয়ে এসে বলা দরকার। রক্তচক্ষুকে ভয় আর কত!
পানুসায়ার সেই বক্তৃতা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে। তবে প্রশাসনের ব্যবহারে অস্বস্তিতে আছেন পানুসায়া। তার সব গতিবিধিই সাদা পোশাকের পুলিশ অনুসরণ করছে। বাড়িতেও সবাই আতঙ্কিত। পানুসায়ার প্রকাশ্য প্রতিবাদ চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে বাড়ির সবার কপালেই। সব মিলিয়ে বেশ টালমাটাল এক সময় যাচ্ছে তার। তবে পানুসায়ার স্বস্তি এটাই, দেয়ালে পিঠ ঠেকলে ঘুরে দাঁড়ানোর যে কাজ, সে কাজটা নাহয় শুরু হলো তার মাধ্যমেই। এও বা কম কী!
সেই প্রতিবাদ এখনো চলছে টানা। রাজপরিবারের সংস্কারের পাশাপাশি থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুথ চান-ওচা'র পদত্যাগের দাবীও জানাচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা। কারণ, অন্যায় পদ্ধতিতে ক্ষমতা দখল করেছিলেন থাই প্রধানমন্ত্রী। অভিনব কায়দায় বিক্ষোভ চলছে। জনপ্রিয় হচ্ছে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তিন আঙ্গুলের স্যালুটও। সরকার জরুরি অবস্থাও জারি করেছিলো এই আন্দোলন ভাঙ্গার জন্যে। কিন্তু কোনো কাজ হয় নি। বিক্ষোভকারীরা থোড়াই কেয়ার করেছে এই জরুরি অবস্থাকে। তুমুল আলোড়নে বহাল তবিয়তেই চলছে 'থাই বসন্ত।'
থাই রাজতন্ত্রের ইতিহাস প্রায় আড়াই শ বছরের পুরোনো। গত নব্বই বছর ধরে থাই রাজার কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। কিন্তু সেই মানুষটিই রাষ্ট্রের প্রধান। তিনি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান। তিনি ধর্মেরও প্রধান। এতটাই পবিত্র তিনি ও তার পরিবার, যাদের নিয়ে একটা বাজে কথাও বলা যাবে না। সেটা যতই সত্যি হোক না কেন। বললেই করতে হবে কারাভোগ। মৃত্যুর ভয় নিয়ে 'কেঁচো' হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। থাইল্যান্ডের আগের প্রজন্ম এই 'মগজ-ধোলাই' মেনে নিলেও বর্তমান প্রজন্ম যে এগুলো মানে না মোটেও, তার উদাহরণ পানুসায়া, তিন মাস ধরে চলতে থাকা এ আন্দোলন এবং সরকারের ভীতসন্ত্রস্ত অবয়ব।
এই আন্দোলন সফলতা পাবে, এটাই প্রত্যাশা আমাদের৷
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন