যেভাবে বিনা পয়সায় চা খেয়ে চায়ের অভ্যাস হলো আমাদের!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
“পড়ন্ত বিকেল ক্যাফেটেরিয়া, উঁকি দিয়ে দেখি, এক কাপ চা, গরম তৃষ্ণায় অজস্র এলোমেলো শব্দের ভীড়ে.. তোমার শীতল চোখ, ভিজিয়ে যায় আমায়...”
শিরোনামহীনের ক্যাফেটেরিয়া গানের এই লাইনগুলোতে ফুটে উঠে ক্যাম্পাস জীবনের রোজকার গল্প, যেখানে চা সবচেয়ে অপরিহার্য অনুসঙ্গ। চায়ের কাপে ঝড় না শুধু, তুফান তুলতে তুলতে জীবন এগিয়ে চলে এখানে। শুধু ক্যাম্পাস না, আমাদের বাঙ্গালি জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ চা।
মন খারাপ? চা খেতে যেতে চাই, মন ভাল থাকলেও একই ব্যাপার। কাজ করতে করতে ক্লান্তি চলে এসেছে, এক কাপ চা-ই যেন ক্লান্তি কমানোর মহাঔষধ! মেট্রোপলিটন কিংবা মফস্বল- সবখানেই চায়ের বিকল্প কিছু নেই। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও কি এমন সম্ভব- টং দোকানে বসে আপন ভঙ্গিতে অপরিচিত মানুষের সাথে গল্প করা?
চায়ের প্রতি আমাদের যে ভালবাসা, উন্মাদনা সেটা এতটা বাড়লো কী করে? কখনো ভেবে দেখেছেন? চা দোকানেই সেদিন শুনলাম, একজন ঠাট্টা করে বলছেন, 'মিয়া এককালে মাগনা দিলেও কেউ চা খাইতো না, অহন এল্লাইগা চায়ের পিছে বাঙ্গালি সব ট্যাকা খরচ করে, অভ্যাস হইলে এমুনি হয়।'
এই অভ্যাসটা করলো কে? কারা এত বোকা যে বাঙ্গালিদের ফ্রি চা খাওয়াতো? কথাটা শুনেই তো চিন্তায় আর আফসোসে পড়ে গেলাম। যেই আমলে ফ্রি চা খাওয়ার সুযোগ ছিল, সে আমলে কেন আমার জন্ম হলো না!
চায়ের জনপ্রিয়তার পেছনের ইতিহাস জানতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে জানা গেল, ব্রিটিশরাই এই উপমহাদেশে চা পানকে জনপ্রিয় করেছে৷ এছাড়া চা নিয়ে বিভিন্ন কাহিনীর চল আছে, এমনকি পৌরাণিক ঘটনাও আছে। এসবের বাইরে মূল কথা যদি বলি, তাহলে চায়ের জন্ম বা মূল উৎস ভূমি হলো চীন।
যদিও শুরুতে চা আসলে এক প্রকার ঔষধ মনে করে খাওয়া হতো, তবে এটি পানীয় হিসেবে পরিচিত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কথা হলো, ব্রিটিশরা কীভাবে খোঁজ পেয়েছে চায়ের?
চীন ফেরত একদল ধর্মযাজকদের কাছ থেকে পর্তুগিজরা চায়ের সন্ধ্যান পায়। তারা এই পানীয়টিকে বেশ পছন্দ করে। ১৬৬০ সালে ব্রিটিশ রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সাথে বিয়ে হলো পর্তুগিজ রাজকন্যার। রাজকন্যার দেশে প্রথম চা পান করে রাজা দ্বিতীয় চার্লস বিমোহিত হন, তিনি এই চায়ের অভ্যাস টেনে নিয়ে আসেন ব্রিটিশ রাজপরিবারে। ফলে কিছুদিন পর ব্রিটিশদের মধ্যে চা সম্পর্কে বেশ ভালরকমের কৌতূহল তৈরি হয়।
চায়ের চাহিদা তৈরি হওয়ায় ব্রিটিশরা একটি ব্যবসায়িক সম্ভাবনা দেখতে পায় চায়ের মধ্যে। চা বাণিজ্যে এতোটাই আগ্রহ যে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চীনের ক্যানটন বাণিজ্যিক বন্দর থেকে রুপার বিনিময়ে চা আমদানি করতে শুরু করে। সেই থেকে শুরু।
বেশ ভাল লাভবান হতে শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি৷ কিন্তু আফিম যুদ্ধের সময় চীনের সাথে ব্রিটিশদের বাণিজ্য সম্পর্কের মাঝে ফাটল দেখা দেয়। তখন ব্রিটিশরা চিন্তা করে চীন থেকে আমদানি না করে উপমহাদেশেই তারা চায়ের চাষ শুরু করবে। কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করেও সেটা হয়নি। চীনের চায়ের বীজ এইদেশে আনলে তাকে বাঁচিয়ে রাখা যেত না। অতঃপর বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা ও বিভিন্ন অঞ্চলে চেষ্টার পর ১৮৫৩ সাল থেকে বাণিজ্যিকভিত্তিতে বাগান করে চা উৎপাদন শুরু হয়।
কিন্তু ব্রিটিশদের এই কর্মজজ্ঞ সাধারণ মানুষদের মধ্যে বিশেষ কোনো চাঞ্চল্য তৈরি করতে পারেনি তখন৷ এমনকি ১৯ শতকের শেষেও সাধারণ মানুষকে চায়ের প্রতি আগ্রহী করা যায়নি। কোনো কোনো শিক্ষিত ও অভিজাত সম্পদশালী ব্যক্তি শুধু শখের বশেই চা পান করত। রোজকার অভ্যাস হিসেবে তখনো চা জনপ্রিয়তা পায়নি।
কিন্তু, ব্রিটিশরা একটা ব্যবসা শুরু করেছে, সফল না করে কি তারা সেটা ছেড়ে দেবে? তা তো নয়। বিপুল পরিমাণে চা উৎপাদিত হচ্ছিলো বটে, কিন্তু সেটাকে ছড়িয়ে দেয়া যাচ্ছিলো না। বাজার সম্প্রসারণের জন্য কমিটি গঠিত হলো, যে কমিটির প্রধান কাজ- জনগণের মধ্যে চা পানের সুফল প্রচার করা।
ভারতীয় উপমহাদেশে তখন বড় বড় শহরে চায়ের দোকান হতে থাকলো দেদারসে। মানুষকে আকর্ষণ করতে বিভিন্ন আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা, গান, ঘরোয়া খেলা কী না ছিল! টি চেজ কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সারা ভারতে ৭০০ গ্রামোফোন, ২০০ হারমোনিয়াম, ৮০০০ গানের রেকর্ড, খেলার টেবিল ব্যবহার করা হয়েছে শুধু এই চা দোকানগুলোকে জমজমাট করার জন্য।
খনি শ্রমিক, কলকারখানার শ্রমিক, সেনাবাহিনীর লোকদের চা পাঠানো হতো পর্যাপ্ত পরিমাণে চায়ের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য। রেলস্টেশনেও চায়ের দোকান হতে থাকে। দেয়ালে দেয়ালে ঝুলে থাকতো চায়ের বিজ্ঞাপন। রেলের ক্যান্টিনে বিনামূল্যে চা পান এবং চা প্রস্তুত প্রণালীর নির্দেশিকা দেওয়া থাকত। চায়ের বিজ্ঞাপনে ভাষা হতো বেশ চটকদার, অঞ্চলভেদে এই বিজ্ঞাপনগুলো বিভিন্ন রকমের হতো। বড় শহরের মোড়ে মোড়ে দোকান স্থাপন করে মানুষকে ফ্রি চা খাওয়ানো হতো।
শুধু তাই নয়, বাড়িতে নিয়ে যেয়ে যেন খেতে পারে, সেজন্যে ছোট ছোট মোড়কে বিনা পয়সায় চা পাতা বিলি করা হতো সেই সময়। মানুষকে চা খাওয়াতে খাওয়াতে ব্রিটিশরা চিন্তা করলো কীভাবে চা বিক্রি করা যায়। তারা ইনভেলাপের মতো কাগজের প্যাকেট তৈরি করেন, যেখানে ৬ কাপ চা বানানোর মতো চা পাতা দেয়া যেত। কেউ চা কিনতে আসলে দোকানদার তার টিনের বাক্সে সুরক্ষিত চা বের করে ইনভেলাপে ভরে চা বিক্রি করত। ইনভেলাপের উপর নির্দেশনাও লিখা থাকত- 'ছয় কাপ চায়ের জন্য প্যাকেটের মধ্যে থাকা চা ফুটন্ত পানিতে ঢালুন। স্বাদের জন্য দুধ ও চিনি যোগ করুন।'
এভাবেই ব্রিটিশরা ধীরে ধীরে উপমহাদেশে চায়ের জনপ্রিয়তা তৈরির কাজ করে। সেই কৌশলটার বীজ থেকে আজকের দিনের এই চায়ের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বিনা পয়সার চা খেয়ে খেয়ে যে অভ্যাস, সে অভ্যাসের জন্য এখন চা জীবনের অংশই হয়ে গেল!
ছবি কৃতজ্ঞতা- তাসলিমা বাবলী
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
আরও পড়ুন-