কত সুযোগ ছিল জন হপকিন্স ইনস্টিটিউটের ফ্যাকাল্টি, কিংবা বিশ্বব্যাংক বা সেভ দ্য চিলড্রেনে থিতু হওয়ার। অথচ মানুষটা চলে এসেছিলেন সব ফেলে, দেশের জন্য। অথচ...
তৌফিক জোয়ার্দার : আমি আর নিতে পারছি না। প্রতিদিন দুই তিনজন রিপোর্টার ফোন দেন; আমি স্ক্রিনে তাদের নাম দেখলে ফোন ধরি না গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে। আমি জানি তারা কী বলতে চান, কী শুনতে চান। গত তিন মাস ধরে একজন জনস্বাস্থ্য গবেষক হিসেবে, একজন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমার পড়াশুনার জায়গা থেকে যা জানতাম তা অনবরত বলেছি। টিভি টক শোতে বলেছি; রিপোর্টাররা বাসায় এসেছে, তাদেরকে বলেছি; প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদেরকে টেলিফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা বুঝিয়ে বলেছি, নিজে বিভিন্ন পত্রিকায় লিখেছি।
বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে যে ওয়েবিনার হয়েছে, বাছবিচার না করে সেগুলোতে অংশগ্রহণ করেছি, নিজের পেশাগত ও ব্যক্তিগত অত্যন্ত জরুরী কাজকর্মগুলোকে অবহেলা করে। দিনের কাজ আর রাতের ঘুম নষ্ট করে নিজের দেহ-মনকে জীর্ণ হতে দিয়েছি দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস। এসব করেছি শুধু একটা আশা থেকে: নীতি নির্ধারনী জায়গায় যারা আছেন, তাদের কানে যদি একটা আইডিয়া ঢুকে; তাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে যদি কিছু মানুষের জীবন বাঁচানো যায়।
আমি Johns Hopkins Bloomberg School of Public Health এ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে ডক্টরেট করেছি। এই প্রতিষ্ঠানের মটো বা আপ্তবাক্য ছিল, 'Saving lives, millions at a time'। আমার সফল ডক্টরাল ডিফেন্সের পরদিন সকালে ডিপার্টমেন্ট চেয়ার, বিশ্ববিখ্যাত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ ডেভিড পিটারস তাঁর রুমে ডেকে ক্যারিয়ার পরিকল্পনা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, প্রচ্ছন্ন প্রস্তাব দিয়েছিলেন পোস্ট-ডক্টরেট করার, যার সাথে ভবিষ্যতে ফ্যাকাল্টি পজিশন প্রাপ্তির সম্ভাবনাও জড়িত ছিল।
আরেকজন শ্রদ্ধেয় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অধ্যাপক জানতে চেয়েছিলেন আর সবার মতো আমেরিকায় থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে কিনা। এর বাইরে সুবর্ণ সুযোগ ছিল ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কে ঢুকে পড়ার; তখন সেখানে হেলথ নিউট্রিশন পপুলেশনের প্রধান, সিনিয়র ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন টিম ইভানস, যিনি ছিলেন আমার পিএইচডির রেফারি এবং মেন্টর। তাঁর সাথে আমার আন্তরিক সম্পর্কের কারণে অনেকে ঠাট্টা করে ‘টিমের ছেলে’ বলেও অভিহিত করতো।
শ্রদ্ধেয় রাশেদ ভাই তখন Save the Children US এর সিনিয়র এ্যাডভাইজার। তিনিও অভয় দিয়ে বলতেন, 'আরে ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা কী; আমি থাকতে আর কোথাও না হোক সেইভের হেড অফিসে তো একটা চাকরি জুটিয়ে দিতে পারবো।'
তাঁদের সবাইকে বিনীতভাবে জবাব দিয়েছিলাম, ”এই দেশে (আমেরিকায়) তো আপনাদের মতো প্রথিতযশা মানুষজন আছেনই জনস্বাস্থ্যখাতে অবদান রাখার জন্য। আমি আমার পোড়া দেশেই ব্যাক করবো, যেখানে আমার প্রয়োজনটা অনেক বেশি; দেশে গিয়ে ছাত্র পড়াবো- এতেই আমার আনন্দ”।
নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে কাজ করে গিয়েছি, কোনদিন রিগ্রেট করিনি, কারণ জেনেশুনেই তো দেশে ফিরেছি। শরৎচন্দ্রের উক্তিটি মনে করে ম্লান হেসে বারবার মনকে প্রবোধ দিয়েছি, “স্বেচ্ছায় নেওয়া দুঃখকে ঐশ্বর্যের মতোই ভোগ করা যায়”।
কোভিড-১৯ মহামারী যখন এলো, তখন ভাবলাম, এই তো সময়, সমস্ত অপূর্ণতার পরিতৃপ্তি হবে অবদানের ঐশ্বর্যে। যে উদ্দেশ্যে ত্যাগ করেছিলাম পার্থিব সব আয়েশ আর গৌরবের হাতছানি, সেই বিশাল শূণ্যতা এবার কানায় কানায় পূর্ণ হবে কর্ম আর অবদানের পরিতৃপ্তিতে। কিন্তু আজ, কোভিড-১৯ মহামারী দেশের লাখো মানুষকে আক্রান্ত করার পর, নিজেকে বড় ক্লান্ত, ব্যথিত আর পরাজিত মনে হচ্ছে। অর্থহীন মনে হচ্ছে নিজের ত্যাগ আর দেশকে নিয়ে স্বপ্নের জাল-বোনা।
স্ত্রী- পরিবার, একমাত্র সন্তানের সাফল্য গৌরব প্রত্যাশী চাতক পাখির মতো ঘাড় উঁচু করে চেয়ে থাকা বৃদ্ধ বাবা-মা, আমেরিকায় জন্ম নিয়ে সেখানকার শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার আইনগত দাবিদার পুত্র সন্তানের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে, তাদেরকে তাদের ন্যায্য ও যৌক্তিক প্রত্যাশাগুলো থেকে বঞ্চিত করার অপরাধে।
জনস্বাস্থ্য নিয়ে পড়াশুনা আমাকে (এবং আমার মতো হাজারো জনস্বাস্থ্য পেশাজীবিকে) এই মহামারীর গতিপ্রকৃতি বোঝার ক্ষমতা দিয়েছে, কিন্তু আফসোস, নানা মিডিয়াতে এত কথা বলার পরও সেসব কথা যেন দেশের দণ্ডমুন্ডের কর্তারা কিছুতেই বিশ্বাস করলেন না; সেই অনুযায়ী কিছুই তাঁরা করলেন না, যখন যা করার প্রয়োজন ছিল। নিজেকে আজকে মনে হচ্ছে গ্রীক মিথোলজির ক্যাসান্ড্রার মতো, দেবতা এ্যাপোলো যাকে ভবিষ্যৎদৃষ্টির ক্ষমতা দিয়েছিলেন; কিন্তু সেই সাথে এই অভিশাপও দিয়েছিলেন- তাঁর কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।
লেখক- তৌফিক জোয়ার্দার, সহকারী অধ্যাপক; জন্স হপকিনস ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথ