তারামন আচানক এক বুদ্ধি বের করলেন। তিনি জামাকাপড় পালটে পড়ে নিলেন নোংরা ময়লা জীর্ণবসন। গায়ে মাখলেন পায়খানা। পুরোপুরি পাগলের বেশ ধরলেন। এভাবেই শত্রুর ক্যাম্পে ঢুকে পড়তেন...

চৈত্র দিনের কথা। সময়টা কেমন যেনো, একটা গুমোট ভাব চারদিকে। ভ্যাপসা গরম। ঠিক যেনো রাজনীতির মতো। রাজনৈতিক আবহাওয়াও উত্তাল। মানুষ প্রায়ই গুজব ছড়াচ্ছে, বাতাসে কত রকমের গুঞ্জন। প্রতিদিন দেশের দৃশ্যপট একটু একটু করে পাল্টাচ্ছে। সময়টা যে একাত্তর! একাত্তর এমনই এক সময়, যেনো মানুষের বেঁচে থাকার উপরই অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কেউ। যেনো এদেশে কারো বেঁচে থাকাটাই বড় অপরাধ। জীবন বাঁচাতে মানুষ শুধু ছুটছে, শহর থেকে শহরে, গ্রাম থেকে গ্রামে। তবুও রেহাই নেই। রেহাই পাওয়ার যেনো কোনো নিয়ম নেই। 

তারামন বিবি এসবের কিছু জানতেন না। বুঝতেন না। যুদ্ধের বারুদের উত্তাপ তখনো তার গ্রামকে ছুঁয়ে যায়নি। ছুঁয়ে যায়নি তারামন বিবিকেও। নির্ভার ছিলেন। বয়স মাত্র চৌদ্দ। এই বয়সী মেয়েরা যেমন হয়,স্বপ্ন দেখার ব্যামো। তারামন বিবিরও তা-ই হয়েছিলো। আর কিছুদিন বাদে তার বিয়ে হবে, স্বামী সংসার হবে। বাচ্চা কাচ্চা হবে। তারা হাসবে, কাঁদবে -এসব দেখে বারবার তিনি মুগ্ধ হবেন। জীবন কেটে যাবে নিস্তরঙ্গ আনন্দে। বেঁচে থাকা হবে অসাধারণ আনন্দময় ব্যাপার। 

কিন্তু সময়টা যে একাত্তর! একাত্তর মানেই বেঁচে থাকার উপর অলিখিত অবরোধ। তারামন বিবিরা থাকতেন কুড়িগ্রাম এ। কুড়িগ্রামের রাজীবপুরের শংকর মাধবপুর ইউনিয়ন। এখানে নিজ বাড়ি। সুপারি গাছ, পেয়ারা গাছ, নিজের আপন করে নেয়া আলো বাতাস। নিজের পরিচিত কিছু শ্বাস প্রশ্বাস। কিন্তু থাকতে পারলেন না এখানে। শান্ত স্নিগ্ধা গ্রামেও তোলপাড় শুরু হলো। মুক্তি সংগ্রামের আচঁ লাগতে শুরু হলো গ্রামে। সেই প্রথম বুঝলেন তারামন বিবি, দেশটা আগের মতো নেই। সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কার যেনো ভয়, কি যে ভয়! ওরা কারা? 

তারামন বিবি তাদের দেখেননি, কিন্তু অবচেতন মনে কিছু ভয় তারও জমা হয়েছে। তারামন বিবিরা নৌকায় করে রাজীবপুরের আরেক ইউনিয়নে গেলেন। কোদালকাঠিতে। নতুন জায়গা কিন্তু তারামন বিবির মায়ের মনে হাজার বছরের পুরানো ভয়। বাপ মরা এই সাত সন্তানকে নিয়ে তিনি কোথায় যাবেন আর! কতদিন লুকিয়ে রাখতে পারবেন! তিনি শুনেছেন মিলিটারি পাকিস্থানি হায়েনারা নাকি অল্প বয়সী মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়। ভয়ের শীতলা স্রোত ভয়ে যায় তারামন বিবির মায়ের মনে। 

এদিকে মানুষ বাড়ছে কোদালকাঠিতে। পেট বাড়ছে অথচ খাবার নেই, কাজ নেই কোথাও। তারামন বিবি কাজ খোঁজেন। মানুষের বাড়ির ঘরোয়া কাজ। কাজ পেলে কিছু খেতে পারেন। নাহলে না। সময়টা তাদের পক্ষে নেই, কারো পক্ষেই নেই অবশ্য। কিন্তু একদিন বিশেষ দিন। তারামন বিবি কচুরমুখী তুলছিলেন। ভর দুপুরের কথা। বয়স্ক এক লোক তারামন বিবির দিকে এগিয়ে আসছেন। তারামন জানে সময় ভালো না। সে চলে যেতে নিলো কিন্তু তার আগেই লোকটা তাকে বললো, এই মেয়ে শুনো। ভয়ে ভয়ে তারামন তার সামনে দাঁড়ালো। 

তারামন বিবি

-নাম কি মা তোমার? 
-তারামন। আমার নাম তারামন বিবি। 
-শুনেছি তুমি বাড়িতে বাড়িতে কাজ করো? 
-জি। 
-আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে কাজ করবে? 
-কি কাজ? 
-আমাদের জন্য ভাত রাইন্ধা দিবা, আমাদের সাথে কাজ করবা। কি পারবা না মা? 

লোকটার নাম মুহিফ হালদার। মুক্তিযোদ্ধা। তার কন্ঠে মা ডাক শুনে তারামন বিবির মায়া লাগতে লাগলো। তাছাড়া সেই দু:সময়ে যেনো নতুন করে শক্তি পেলেন তারামন। এমনিতেও তার মাথার উপর ছায়া নাই যার ভরসায় বেঁচে থাকা যাবে। আর মরতে তো হবেই। সবাই মরবে। এমনি শুধু শুধু মরার চেয়ে যুদ্ধের মরণ বেশি ভালো মনে হলো তারামন বিবির কাছে। কিন্তু আগে মায়ের অনুমতি নিতে হবে। সেদিন সন্ধ্যায় আজিজ মাস্টার আর মুহিফ হালদার গেলেন তারামন বিবির বাড়ি। মাস্টার সাহেবের কথায় কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন মা। ক্যাম্পে নিলে এই মেয়ের ভবিষ্যতে আর বিয়া দেয়া যাবে না। মানুষ নানান কথা বলবে। মইরা গেলে তো যন্ত্রণা শেষ কিন্তু বাঁচলে যন্ত্রণার ইতি হবে না। তবুও মা বললেন, “দেশ স্বাধীন হইবো তো?” 

তারামন বিবির নতুন জীবন শুরু হলো। আজিজ মাস্টার তাকে ধর্ম মেয়ে করে নেন। মুহিফ হালদার তাকে কিছু জামা কাপড় কিনে দেন। যুদ্ধ দিনে বেঁচে থাকার নতুন যুদ্ধ তারামন বিবির। ক্যাম্পে তার কাজ রান্নাবান্না করা, ডেকচি ধোয়া। ক্যাম্পে গিয়েই প্রথম অস্ত্রের সাথে পরিচয় তারামন বিবির। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো তিনি পরিষ্কার করে রাখতেন আর অবাক হয়ে ভাবতেন অস্ত্রগুলো এত ভারী কেনো! কি যে ওজন মনে হতো প্রথম প্রথম। ক্যাম্পে তার কাজের পরিধি ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। 

একদিন একটা কঠিন দায়িত্ব তাকে দেয়া হলো। আজিজ মাস্টার এসে তাকে বললেন, নদ পার হয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পের খবর আনতে হবে। কোনো পুরুষকে পাঠানো যাবে না। যেতে হবে তারামনকেই। তাও, অন্ধকারময় রাত্রিতে, নদী পার হতে হবে সাঁতরে। ধরা পড়লে হয়ত আর ফিরে আসা হবে না। তারামন বিবির কইলজার মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো। কিন্তু কলিজা যার একটি মানচিত্রের স্বপ্নে বিভোর সে কি আর এইটুকুতে দমে যাবে! তারামন বিবি রাজি হলেন। 

ব্রহ্মপুত্র নদের আরেক পাড়। খাড়বাজ ঘাট। তথ্য আনতে তারামনকে সেখানেই যেতে হবে। যা হবার হবে। তারামন বিবি রওনা দিয়ে দিলেন। রাতের অন্ধকারে নদের জলে নেমে পড়লেন। অনিশ্চিত সে যাত্রা। বুকের নিচে একটা কলাগাছকে আশ্রয় করে প্রাণপণ সাঁতার কাটছেন তারামন। সারারাত সাঁতরে গেলেন চৌদ্দ বছরের কিশোরী। কি অসম্ভব প্রাণশক্তি ভর করেছিলো তার উপর ভাবা যায়! কিন্তু শত্রুর ঢেরায় ঢুকবেন কিভাবে! এত সহজ না। আবেগ দিয়ে না হয় জীবন গচ্ছা দিলেন কিন্তু জীবন গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর দেবেন কি করে? 

তারামন আচানক এক বুদ্ধি বের করলেন। অসাধারণ এক বুদ্ধি। তিনি জামাকাপড় পালটে পড়ে নিলেন নোংরা ময়লা জীর্ণবসন। গায়ে মাখলেন পায়খানা। পুরোপুরি পাগলের বেশ ধরলেন। কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারলো না। শত্রুর ক্যাম্পে ঢুকে পড়তেন। পাকিস্থানিরা তাকে বোঝার চেষ্টা করতো। কিন্তু তারামন দূর্বোধ্য। পাগলামির মাত্রা বাড়িয়ে দিতেন। আর গোপনে নিয়ে নিতেন দরকারি তথ্য। এলএমজি, রাইফেল, সৈন্যদল এর খবর। ওসব মিলিটারি ক্যাম্পে তার বয়সী মেয়েদের চিৎকার ভেসে আসতো। তারামন এর গালি দিতে মনে চাইতো। কিন্তু দেশের কথা ভেবে বুকে কষ্ট চেপে রাখতেন। একদিন ওরা মুক্তি পাবে এই আশা তার মনে তখন। 

ক্যাম্পের কাছে তারামনের খালার বাড়ি। একদিন দেখা করতে গেলেন ও বাড়িতে। রাত বেড়ে যাওয়ায় খালা যেতে দিলেন না। থাকতে বললেন। সকালবেলা খালু কোরান তিলওয়াত করছিলেন। এমন সময় পাকিস্থানি বাহিনী ওই বাড়িতে আসলো। তারা কিভাবে খবর পেয়েছে কে জানে। তখন গ্রামে গ্রামে রাজাকার। ওরাই সব খবর দেয়। তারামন পালিয়ে গেলেন। রেহাই পেলো না তার খালু। ওরা কোরানের উপর লাত্থি মারলো। তারপর খালুর বুকের উপর পা দিয়ে দলাই মলাই করে গুলি করলো। খালু নিশ্চুপ হয়ে থাকলেন অনন্তকালের জন্য। খালাটা যে সেদিনের পর কোথায় পালিয়ে গেছেন, কেউ জানে না। আর পাওয়া যায় নি তাকে। 

পেন্সিলে আঁকা তারামন বিবির প্রতিকৃতি

শ্রাবণ ভাদ্র দিনের কথা। মুহিফ হালদারের সাথে তারামন এলেন দশগরিয়াতে। এখানে আবার অন্য জীবন তার। এই প্রথম অস্ত্র চালানো শিখলেন। স্টেনগান কি করে চালাতে হয় বুঝলেন। একদিন খুব বৃস্টি হচ্ছে। আজকাল প্রায়ই হয় এমন ঝুম বৃস্টি। দুপুরের দিকে সবাই ভাত খাচ্ছে এমন বর্ষণমুখর মধ্যাহ্নে। আজিজ মাস্টার কোত্থেকে এসে বললেন তারামন গাছে উঠ। তারামন সুপারি গাছে ভালো চড়তে পারতেন। এই চিকণ গাছটি বৃস্টির কারণে এমনিতে পিচ্ছিল হয়ে আছে। তবুও তারামন উঠলেন। কি সর্বনাশ! মিলিটারিরা নদীতে গানবোট নামিয়ে দিয়েছে। তার মানে তারা আক্রমণ করতে চায়। 

তারামনের বুদ্ধিমত্তায় দূরবীন দিয়ে তাদের দেখতে পাওয়ার খবরে মুক্তিযোদ্ধারা ভাত খাওয়া বন্ধ করে পজিশন নিলো। সতর্ক অবস্থা। শুরু হলো গোলাগুলি। তুমুল গোলাগুলি। সন্ধ্যা পর্যন্ত চললো। তারামনের সেদিন কি হয়েছে সে জানে না। ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় কখন যে সে হাতে অস্ত্র তুলে নিলো টেরই পেলো না। হঠাৎ সে বুঝতে পারলো তার গুলি শত্রুর পাষাণ বুকে বিদ্ধ হয়েছে। তার মনে হলো এতদিন এমন সময়েরই অপেক্ষায় ছিলো তার অবচেতন মন। সেসময়ের অনুভূতির সাথে আর কোনো অনুভূতির জোড়া হয় না। এই দেশ, মা, মাটি সব যেনো তার,একান্ত তার। এরপর কতবার স্টেনগান চালিয়েছেন, কতবার তার কনুই ছিলে রক্ত বেরিয়েছে, পায়ের পাতায় ঘা হয়েছে সে হিসাব নেই। ব্যাথাগুলো তাকে ব্যাথা দেয়নি। যত ব্যাথা ততই বুঝেছেন স্বাধীনতা নিকটে। ততই স্বপ্ন প্রগাঢ় হয়েছে তার, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন একটা স্বাধীন ভূমি। 

তারামনের স্বপ্ন সত্যি হয়েছিলো। যুদ্ধ শেষ হয়। দেশটা স্বাধীন হয়। কিন্তু অনেকদিন পর তারামনের খোজ মেলে না। যেনো হাওয়া হয়ে গিয়েছেন এক প্রকার! তিনি ছিলেন প্রচন্ড কষ্টেসৃষ্টে। তাদের বোনদের বিয়ে হচ্ছিলো না। মানুষ বলে ক্যাম্পে থাকা মাইয়া, ভালা না”। তার ওপর নাই থাকার জায়গা, নাই খাবার দাবার। আবদুল মজিদ নামে এক সহজ সরল মানুষ তাকে বিয়ে করেন। রাজীবপুরের এক চরে তাদের জীবন শুরু হয়। কি এক জীবন, চরের মতোই ভাংগা জীবন। চর ভাঙে, তাদের ঘর ভাঙে। নতুন করে আবার ঘর বাধতে হয়। আবার ভাঙে চর,আবার ভাঙে ঘর। এভাবে চব্বিশ বছর কেটে গেলো। 

১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের এক গবেষক তাকে খুঁজে পান। সেবছর তাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বীরত্বের পুরস্কার দেয়া হয়। বাংলাদেশে দুইজন মাত্র খেতাবধারী নারী মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তারামন বিবি একমাত্র নারী যিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন। সম্মুখ যুদ্ধে সবার মতো অংশ নিয়েছিলেন। এজন্যে তারামন বিবিকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। তবে তারামনদের কেউ মনে রাখেনি। নারী বলেই কি না কে জানে, অবহেলায় অবহেলায় এতো বেলা পার করে দিলেন তারামন। তবুও তারামন নামের এক পাগলি, স্বপ্নালু, চঞ্চল, সাহসী মেয়ের গল্প আমাদের মনে থাকবে। ধন্যবাদ তারামন বুবু, তুমি সত্য, তুমি সুন্দর, তুমি আমার সাহস!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা