“আমরা এই দেশটা স্বাধীন করসি। অনেক কষ্ট করসি। দেশটা হেসেখেলে আসে নাই। নয় মাসে দেশটা ভাইসা আসে নাই।”

"আইজ যদি আমরা দেশ স্বাধীন না করতাম তাইলে আইজও অমানুষিক নির্যাতনে থাকতে হইত, অমানুষের পাশে থাকতে হইত।" 

কথাগুলো বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি। ২০১৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে 'মুক্তি-সংগ্রাম নাট্যোৎসব' হয়েছিল ২৫শে মার্চে। সেখানে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি নেই দুই বছর হয়ে গেল, এই মহান নারী, বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন। একে একে হয়ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সব নায়করাই চলে যাবেন, কিন্তু তাদের যে ত্যাগের বিনিময়ে আমরা দেশটা পেয়েছি সে দেশটার ইতিহাসগুলো তো আমাদের স্মরণ করতে হবে। স্মরণে রাখতে হবে তারামন বিবির মতো সকল মুক্তিযোদ্ধাদের, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে। কারণ, এই দেশটার জন্ম খুব যে সহজ ছিল না। তারামন বিবির সেই বক্তব্যের কিছু অংশ তার ভাষায় বিবৃত করে বলছি- 

"আমার ইতিহাস কেউ কেউ জানেন বা জানেন না। আমি অসুস্থ। বেশি কথা বলতে পারি না। ১৯৭১ সালে সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, নীলফামারি ওদিক দিয়া যখন লোকজন আসে, আমার বাড়ির পাশ দিয়াই আসে। চিলমারি পার হইয়া। আমার বাড়িতে কলাগাছের বাগান ছিল। সে বাগানে আইসা তারা বসত, ঝিরাইত। তারা কানত, বুকে থাবড়াইত। গড়াগড়ি করত। তাদের কাছে বসতাম। জিগাইতাম, আপনে কান্দেন কেন। তারা বলত, আমাদের ঘর বাড়ি জ্বালাইয়া দিসে৷ আমার সন্তানরে নিয়া গাছের সাথে ঝুলাইয়া মাইরা দিসে। কেউ বলে, আমার স্বামীরে ধরে নিয়া মাইরা দিসে। কেউ বলসে, আমাদেরকে নির্যাতন করসে। 

আমার আব্বা একাত্তরের অনেক আগে মারা গেসে। আমরা সাতটা ভাইবোন ছিলাম। আমরা খুব অভাবী ঘরের ছেলেমেয়ে ছিলাম। যখন পাকসেনারা আরো কাছাকাছি আসে তখন লোকজন আরো বেশি কইরা আসে। তখন আমার আম্মা বলে, আমার তো বড় ছেলেও নাই, স্বামীও নাই, তাইলে আমার তো আরো আগে পার হইয়া যাওয়ার দরকার।"

বীর মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি

পরিবার সমেত নিজ বাড়ি শঙ্কর মাধবপুর থেকে তারামন বিবিরা চলে আসেন খালার বাড়িতে৷ তারপর আবার যান দাদীর বাড়িতে। এসে দেখেন মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প করছে। সেই ক্যাম্প থেকে এক মুক্তিযোদ্ধা আসলেন তার কাছে, নাম মুহিফ হালদার। লোকটা তাকে বললো, এই মেয়ে শুনো। ভয়ে ভয়ে তারামন তার সামনে দাঁড়ালো। 

-নাম কি মা তোমার? 
-তারামন। আমার নাম তারামন বিবি। 
-শুনেছি তুমি বাড়িতে বাড়িতে কাজ করো? 
-জি। 
-আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে কাজ করবে? 
-কি কাজ? 
-আমাদের জন্য ভাত রাইন্ধা দিবা, আমাদের সাথে কাজ করবা। কি পারবা না মা? 

তারামন বিবি বললেন, আমার মা আছে। উনার কাছে বলতে হবে। সেদিন সন্ধ্যায় আজিজ মাস্টার আর মুহিফ হালদার গেলেন তারামন বিবির বাড়ি। মাস্টার সাহেবের কথায় কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন মা। ক্যাম্পে নিলে এই মেয়ের ভবিষ্যতে আর বিয়া দেয়া যাবে না। মানুষ নানান কথা বলবে। মইরা গেলে তো যন্ত্রণা শেষ কিন্তু বাঁচলে যন্ত্রণার ইতি হবে না। তারামন বিবিকে ধর্মের মেয়ে বানিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে গেলেন মুহিফ হালদার। তারামন বিবি বলেন, 

"প্রথমে আমি রান্নাবাড়ি করি। তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র মুইছা দেই, লুকায়ে রাখি, আবার তাদের হাতে তুইলা দেই। তারপর আমার সেই বাবা (মুহিফ হালদার) বলতেসে আমারে যে তোমার তো অনেক সাহস হইসে, অনেক কিছু বোঝো, তাউলে তুমি আরো কিছু কাজ করো। তখন আমি কইলাম, আমি কাজ করব, যেই কাজ দিবেন সেই কাজই করব।" 

মুহিফ হালদার এরপর তারামন বিবিকে রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ দেন। রাইফেল বেশ ভারী, তাই পরে তারামন স্টেনগান চালানো শেখেন। যাইহোক, একদিন একটা কঠিন দায়িত্ব তাকে দেয়া হলো। আজিজ মাস্টার এসে তাকে বললেন, নদ পার হয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পের খবর আনতে হবে। কোনো পুরুষকে পাঠানো যাবে না। যেতে হবে তারামনকেই। তাও, অন্ধকারময় রাত্রিতে, নদী পার হতে হবে সাঁতরে। ধরা পড়লে হয়ত আর ফিরে আসা হবে না। তারামন বিবির কইলজার মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো। কিন্তু কলিজা যার একটি মানচিত্রের স্বপ্নে বিভোর সে কি আর এইটুকুতে দমে যাবে! 

তারামন বিবি রাজি হলেন। রাতের অন্ধকারে নদের জলে নেমে পড়লেন। অনিশ্চিত সে যাত্রা। বুকের নিচে একটা কলাগাছকে আশ্রয় করে প্রাণপণ সাঁতার কাটছেন তারামন। সারারাত সাঁতরে গেলেন চৌদ্দ বছরের কিশোরী। কি অসম্ভব প্রাণশক্তি ভর করেছিলো তার উপর ভাবা যায়! কিন্তু শত্রুর ঢেরায় ঢুকবেন কিভাবে! তারামন আচানক এক বুদ্ধি বের করলেন। অসাধারণ এক বুদ্ধি। তিনি জামাকাপড় পালটে পড়ে নিলেন নোংরা ময়লা জীর্ণবসন। গায়ে মাখলেন কালি, গোবর। পুরোপুরি পাগলের বেশ ধরলেন। কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারলো না। শত্রুর ক্যাম্পে ঢুকে পড়তেন। 

বীর মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি

পাকিস্তানিরা তাকে বোঝার চেষ্টা করতো। কিন্তু তারামন দূর্বোধ্য। পাগলামির মাত্রা বাড়িয়ে দিতেন। আর গোপনে নিয়ে নিতেন দরকারি তথ্য। তারামন বলতে থাকলেন, 

"একদিন দুপুর বেলা। সবাই খাইতে বসছি। সেইসময় আমাকে বলতেসে তারামন সবাই খাইতে বসছি, কেউ তো খেয়াল করলাম না। তুমি এক কাজ করো। দূরবীনটা নিয়া গাছে উঠো। গাছে উঠলাম আমি। উইঠা দেহি পাক সেনারা গানবোট দিয়া আসতেসে। গাছ থেকে আমি চিৎকার দিসি। কইলাম, আব্বু সর্বনাশ। ওরা গানবোট তুইলা দিসে।"

তারামন মুক্তিযোদ্ধাদের সব ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে খবর দিলেন। যুদ্ধ চললো, সন্ধ্যা পর্যন্ত। তারামন নিজেও অংশ নিয়েছিলেন সেদিন সম্মুখ যুদ্ধে। তিনি বলেন, 

"আমরা এই দেশটা স্বাধীন করসি। অনেক কষ্ট করসি। দেশটা হেসেখেলে আসে নাই। নয় মাসে দেশটা ভাইসা আসে নাই।" 

তারামন বিবি সেদিন বলেছিলেন, দেশটা এগিয়ে যাচ্ছে, আরো এগিয়ে যাক। কিন্তু, স্বাধীন হওয়ার পর তার জীবনের পথ সহজ ছিল না। অনেক অপমান,গ্লানি, অভিমান জমা হয়েছিল তারও। অসুস্থ ছিলেন অনেকদিন। যে দেশটা এত কষ্ট করে স্বাধীন করতে নিজেকে উজাড় করে দিলেন, সেই দেশকে নিয়ে স্বপ্ন অনেক বড় নিশ্চয়ই। কিন্তু স্বপ্ন কতখানি পূর্ণ হলো! আজকের দিনে দেশ স্বাধীন, এই ব্যাপারটাকে অনেকে টেকেন ফর গ্রান্টেড হিসেবে ধরে নেয়। কিন্তু, আসলেই কি তাই! তারামন বিবির ভাষায় বলতে হয়, দেশ তো আসলেই ভাইসা আসে নাই! 

তারামন বিবি আজ নেই, কিন্তু রেখে গেছেন বাংলাদেশ। একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই হয়ত থাকবেন না৷ কিন্তু, তারা যে আশা নিয়ে, ভালবাসা নিয়ে জীবন উতস্বর্গ করেছেন দেশের তরে, সেই ভালবাসা আমাদের মধ্যে সঞ্চার হলেই তাদের ত্যাগ স্বার্থক। বিজয় দিবসে এই অঙ্গীকার হোক আমাদের, ব্যাক্তিগত স্বার্থের বাইরে উঠে দেশের জন্য কিছু করি...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা