ট্যাংক ম্যান: অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক অনন্য নজির!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

এক সারি গোলাভর্তি ট্যাংক, তার সামনে দাঁড়িয়ে নিরস্ত্র একজন সাধারণ মানুষ। রাষ্ট্রক্ষমতা, রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংযোগ না থাকা একটা লোক আচমকা দ্রোহের অজানা এক অনলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে উঠলেন, জ্বালিয়ে ছারখার করে দিতে চাইলেন ক্ষমতাশালীর মসনদকে...
তিয়েনআনমেন স্কোয়ার, ১৯৮৯।
চীনজুড়ে তখন স্টুডেন্ট মুভমেন্ট চলছে, বিক্ষোভ দমনে চীন সরকার মাঠে নামিয়েছে সেনাবাহিনীকে, শুরু হয়েছে ধরপাকড়, চলছে নির্যাতন। বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করতে যেসব বিদেশী সাংবাদিকেরা এসেছিলেন, তাদেরকে হোটেলবন্দী করে রাখা হয়েছে। মার্কিন ফটো জার্নালিস্ট চার্লি কোলও তাদের একজন, নিউজউইক সাপ্তাহিকের হয়ে কাজ করেন তিনি তখন। বাইরে কি ঘটছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, রাস্তাঘাট ফাঁকা, কারফিউ চলছে, কিছুক্ষণ পরপর শুধু ট্যাংক আসা-যাওয়ার ঘড়ঘড় শব্দ শোনা যায়। বারান্দায় বসে সন্তর্পণে নজর রাখেন চার্লি, টেলিস্কোপ লেন্স লাগানো ক্যামেরাটাও প্রস্তুত থাকে, যদি বলার মতো কিছু ঘটে যায় আচমকা, এই আশায়।
৫ই জুন, ১৯৮৯। বারান্দায় বসা অবস্থাতেই চার্লি দেখতে পেলেন, বাজারের থলি হাতে এক লোক আচমকাই ফুটপাথ ছেড়ে নেমে এলো রাস্তায়, বিপরীত পাশ থেকে তখন ট্যাংকের একটা বহর আসছে। লোকটা রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালো, পরনে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট। আহামরি কিছু নেই গেট-আপে, আর দশজন ছাপোষা মধ্যবিত্ত যেমন হয়, ঠিক সেরকম দেখতে। লোকটা দাঁড়ালেন ঠিক সেই জায়গায়, যেখান দিয়ে ট্যাংকগুলো যাওয়ার কথা ছিল। চার্লি কোল ভাবলেন, এই লোককে পিষে ফেলেই বুঝি চলে যাবে ট্যাংক, হয়ে উঠবে ঘাতক দানব।
না, ট্যাংকের ভেতরে থাকা সেনাদের সেই সাহস হলো না। গোল চাকতিটা সরিয়ে একদম সামনে থাকা ট্যাংক থেকে মাথা তুললো এক সেনা, আঙুল উঁচিয়ে সরে যাওয়ার হুমকি দিলো লোকটাকে। ভদ্রলোক অনড়, কিছু একটা বললেন, এত দূর থেকে শুনতে পাবার কথা নয় চার্লি কোলের। ট্যাংক খানিকটা পিছিয়ে গেল, দিকবদল করে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলো লোকটাকে। সেই ভদ্রলোকও নাছোড়বান্দা, পাশে সরে গিয়ে আবার দাঁড়ালেন ট্যাংকের নতুন যাত্রাপথের সামনে।

চার্লি কোল তখন চোখের সামনে ইতিহাসের জন্ম হতে দেখছেন, এক সারি গোলাভর্তি ট্যাংক, তার সামনে দাঁড়িয়ে নিরস্ত্র একজন সাধারণ মানুষ, যে লোকটা নয়টা পাঁচটার পাঁচালী লেখে রোজ, অফিসে বসের ঝাড়ি খায়, বাজার থেকে কিছু একটা আনতে ভুলে গিয়ে স্ত্রীর গালমন্দ হজম করে, ছেলে-মেয়েকে ভ্যাকেশনে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেয়- রাষ্ট্রক্ষমতা, রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংযোগ না থাকা একটা মানুষ আচমকা দ্রোহের অজানা এক অনলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে উঠলেন, জ্বালিয়ে ছারখার করে দিতে চাইলেন ক্ষমতাশালীর মসনদকে। অভ্যস্ত হাতে ততক্ষণে ক্যামেরার শাটার টিপতে শুরু করেছেন চার্লি কোল, এই ইতিহাসকে ধরে রাখতেই হবে যে কোন মূল্যে।
মিনিট দুয়েক ধরে চললো এই নাটক। ট্যাংক বাঁয়ে যেতে চাইলে লোকটা বামে গিয়ে দাঁড়ান, ট্যাংকের মুখ ডানে ঘুরলে তিনিও চলে আসেন ডানে। কয়েকবার তার গায়ের ওপর উঠে যাচ্ছিল ট্যাংক, চার্লি কোলের অন্তত সেরকমটাই মনে হয়েছে। কিন্ত শেষ মুহূর্তে সাহস করে উঠতে পারেনি ট্যাংকের চালক। আর এই ভদ্রলোকও যেন মজার কোন খেলায় মেতেছেন, এমন ভঙ্গিতে বারবার বদলাচ্ছিলেন নিজের অবস্থান, কোনোভাবেই যেতে দিচ্ছিলেন না ট্যাংকের বহরটাকে।
মিনিট দুয়েক পরে রাস্তার পাশ থেকে দুজন লোক এসে খানিকটা জোর করেই সরিয়ে নিয়ে গেলেন তাকে। সাঙ্গ হলো নাটকের। চার্লি কোল ভবিষ্যত দেখতে পেতেন না, তবে আন্দাজ করেছিলেন, তার রুমে রেড আর্মির সেনারা হানা দিতে পারে, তাই পলিথিনের একটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে ফিল্মের রোলটা তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন বাথরুমের ফ্ল্যাশের ভেতর। সত্যিই সেনারা হানা দিয়েছিল, তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল রুমের আনাচে কানাচে, পায়নি কিছু। তিনদিন পর যখন বেইজিং বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে চার্লি কোলসহ আরও অনেক সাংবাদিককে বহনকারী বিমানটা ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশ্যে উড়াল দিয়েছে, তখন তার পায়ের মোজায় গুঁজে রাখা ছিল সেই ফিল্ম নেগেটিভগুলো।

ট্যাংকের সামনে দাঁড়ানো সেই ভদ্রলোকের নাম বা পরিচয় উদ্ধার করা যায়নি, তার পরিণতি কী হয়েছিল সেটাও কেউ জানেনা। ইতিহাস তার নাম দিয়েছে ট্যাংক ম্যান। গত তিন দশক ধরে কমবেশি সব আন্দোলন, সব সংগ্রাম, সব প্রতিবাদে তিনি অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন। নাম না জানা এই ভদ্রলোক গোটা পৃথিবীর আট বিলিয়ন মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য বুকভর্তি সাহসটাই যথেষ্ট। আর কিছু নয়।
নাম না জানা এই ট্যাংক ম্যান দুনিয়ার কোটি তরুণকে উদ্দীপিত করেছেন, প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ হতে সাহস যুগিয়েছেন। মৃত্যুকে সবাই ভয় পায়, অজানা কোন পরিণতির আশঙ্কায় কমবেশি সকলেই আতঙ্কিত হয়, কিন্ত তারচেয়ে বেশি আতঙ্কের কি জানেন? আমি করি মাথা নিচু করে বেঁচে থাকাটা। অন্যায় সয়ে চুপচাপ একটা জীবন অতিবাহিত করাটা। আমি বিশ্বাস করি, লক্ষ-কোটির বিপরীতে একটা, দুইটা, দশটা আওয়াজ হয়তো অতি ক্ষুদ্র, নগণ্য, হয়তো কিছুই না, কিন্ত পরিবর্তন আনার জন্যে ওই এক-দুইজনের কণ্ঠস্বরই যথেষ্ট। কারন মৃদু স্বরের ওই নিচু গলার আওয়াজকেই ওরা ভয় পায়, এটুকুতেই ওদের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।
ক্ষুদ্র মস্তিস্কে এটুকু শুধু বুঝি, আমাদেরকে কথা বলতে হবে। কথা বলতে হবে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে, ক্ষমতাবানদের ফ্যাসিবাদী আচরণের বিরুদ্ধে। আমাদেরকে চিৎকার করতে হবে সব রকমের নিপীড়ন আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে, অনাচারের বিরুদ্ধে, আমাদের কলম ধরতে হবে শক্ত হাতে, আওয়াজ তুলতে হবে জোর গলায়। কয়জন পাশে এসে দাঁড়াবে, কতগুলো মাথা সমর্থন জানাবে, সেটার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রতিবাদটা জারি রাখতে হবে, অসততার বিরুদ্ধে, অনাচারের বিরুদ্ধে।
সব যুদ্ধ জয়ের জন্য লড়া হয় না, কিছু যুদ্ধ হয় শুধু প্রতিপক্ষকে এই বার্তাটা দেয়ার জন্য যে- অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্যে ন্যায়ের পক্ষে কেউ অন্তত টিকে আছে, থাকবে চিরদিন...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন