যে মানুষ গর্ভবতী হাতির মৃত্যুর কারণ হয়, সেই মানুষই আবার পাখির বাচ্চা ফোটার জন্য পুরো একটা গ্রামের বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখে, অন্ধকার আর ভ্যাপসা গরম সয়ে নেয় নির্বিবাদে- মানুষ আসলেই বড় অদ্ভুত প্রাণী!

সত্যজিৎ রায় "রয়েল বেঙ্গল টাইগার রহস্য" গল্পে ফেলুদার মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন, "একজন সাদাসিধে মানুষের মনও একটা হিংস্র বাঘের চেয়ে বিশগুনে বেশি জটিল।" কথাটি সর্বৈব সত্য। মানুষ "প্রাণী" হিসেবে আজব কিসিমের। কয়দিন আগে কক্সবাজারের কয়টা ডলফিনকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে মেরে ফেললো মানুষজন। বন থেকে একটা বাঘ অথবা একটা হাতি চলে এলেই হলো, পিটিয়ে মেরে ফেলাই যেন রীতি। এই তো সেদিনও কেরালায় বিস্ফোরক ভরা আনারস খেয়ে এক গর্ভবতী হাতির করুণ মৃত্যু সম্পর্কে আমরা জেনেছিলাম। হাহুতাশও করেছিলাম। যে মানুষ গোলাবারুদ দাগিয়ে, অস্ত্রের ঝনঝনানিতে পৃথিবীকে প্রত্যেকদিনই বানাচ্ছে একটু একটু করে বাসের অযোগ্য, মানুষ হয়ে মানুষকে করছে কচুকাটা, সেখানে বনের প্রানীর জন্যে মায়া হবে, এটা ভাবাই বোকামি। তবুও ঐ যে বললাম, মানুষ অদ্ভুত। তারই একটি নজির লক্ষ্য করি আমরা সম্প্রতি। 

তামিলনাড়ুর শিবগঙ্গা জেলার একটি গ্রামের নাম পোথুকুড়ি। সেই গ্রামের কমিউনিটি সুইচবোর্ডে গ্রামের ৩৫টি স্ট্রিটল্যাম্পের সুইচ একসাথে থাকে। সন্ধ্যাবেলায় সেই সুইচবোর্ড দিয়ে আলোকিত করতে হয় পুরো গ্রামকে। কিছুদিন আগে লকডাউনের মধ্যে সন্ধ্যাবেলা সুইচবোর্ড থেকে লাইট জ্বালাতে গিয়ে কয়েকজন দেখলেন- সুইচবোর্ডের মধ্যে খড়, গাছের পাতা এবং কাগজপত্র নিয়ে বাসা বানিয়ে বসেছে একটি বুলবুলি পাখি। সে সাথে পেড়েছে ডিমও। পাখি যেকোনো জায়গাতেই বাসা বানাতে চায়। ডিমও পাড়ে।  এগুলো অদ্ভুত কোনো বিষয় না। কিন্তু এই বুলবুলি পাখিটি যে জায়গায় আস্তানা গেড়েছে, সে জায়গাটার পেছনেই গ্রামের ৩৫টি স্ট্রিটলাইটের সুইচ। কিন্তু পাখিটিকে সরাতেও মন চাইছে না এলাকাবাসীর। কী করা যায়? পাখিটিকে না সরালে থাকতে হবে অন্ধকারে। আবার পাখিটিকে সরিয়ে দেয়াও সম্ভব না, ডিমগুলো সহ। নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

এলাকার কিছু মানুষ মিলে একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুললেন। চাইলেন এলাকাবাসীর পরামর্শ। অধিকাংশ মানুষজনই রাজি হলেন এই সিদ্ধান্তে যে, যতদিন না ডিম ফুটে বাচ্চা বের হচ্ছে, তারা এই পাখিটিকে এই জায়গা থেকে সরাবেনা। এতে করে যদি তাদের অন্ধকারেও থাকতে হয়,  তাতেও তারা রাজি।

কিন্তু গ্রামে ১০০ টি ঘর। অনেকেই বলেন, এটা বোকামি। একটা পাখির জন্যে এতদিন অন্ধকারে থাকার কোনো মানে হয়না। তারা বেশ মারমুখীও হয়ে গেলেন অন্ধকারে থাকার এই সিদ্ধান্তে। কিন্তু বাকিদের সম্মিলিত কথাবার্তায় তাদেরও মন গললো। এরপর প্রত্যেকদিনই রাতের অন্ধকারে তারা পথ চলতেন মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট, টর্চ ব্যবহার করে।

এভাবে কেটে গেলো ৩৫ দিন। ৩৫দিন পরে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলো। ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার পরেই পাখিটিকে তাড়িয়ে দেয়া হয়নি। রীতিমতো রাখা হচ্ছে ভিআইপি নিরাপত্তায়।  গ্রামবাসীরা পালা করে এখনও পাহারাও দিচ্ছে বুলবুলির এই বাসাটিকে৷ সদ্যফোটা বাচ্চাটির কোনো অযত্ন হচ্ছে কী না, পাখির বাসায় কেউ হামলা করছে কী না, সেটাও তারা লক্ষ্য রাখছে নিয়মিত।

যে পৃথিবীতে এক মানুষ আরেক মানুষকে মেরে ফেলছে তুচ্ছ থেকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে, ছাড় পাচ্ছেনা অন্যান্য প্রানীও। সেখানে একটা ছোট্ট পাখি ও তার বাচ্চার জন্যে ৩৫ দিন অন্ধকারে থাকছে গ্রামবাসী! সত্যিই, মানুষ বড্ড অদ্ভুত!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা