জইনুল আহসানের কাছে মাঝে মাঝে সবকিছুকেই তামাশা লাগে। বাবুল নামের সহজ সরল ছেলেটাকে বাবু বানিয়ে তামাশ করা হয়েছে। বাবুল ছেলেটার আজকে একটা চাকরি থাকতে পারত, সহজ একটা জীবন হতে পারত। গ্রামের একটা সুন্দরী মেয়ে তার স্ত্রী হতে পারত। দ্রুত উপরে উঠিয়ে নিচে ফেলা দেয়া নামের যে সব শো, এসব তামাশা ছাড়া আর কিছু না। মাথায় বাস্তবতা জ্ঞান ঢুকানোর আগেই চোখে চাকচিক্য ঢুকিয়ে বেঁচে থাকাকে ওলট পালট করাকে কী জীবন বলে?

রূপনগর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের জনতার গর্বের অন্ত নেই, কারণ বাংলাদেশের হাজার হাজার ওয়ার্ডের মধ্যে একমাত্র তাদের মেম্বারকেই সারা দেশের মানুষ এক নামে চেনে। কলকাতার চ্যানেল কাঁপানো গায়ক তাদেরই ইউনিয়নের মেম্বার, এই সত্য নির্বাচনের দুই বছর পরেও তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়।

দেশের মানুষের কাছে কলকাতা কাঁপানো অতীতপ্রায় গায়ক কিংবা রূপনগর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের বর্তমান সদস্যের নাম জইনুল আহসান বাবু। বাবু যে স্কুলে পড়ালেখা করেছেন সেখানকার রেকর্ডপত্র অবশ্য এই নাম বেশ শক্তভাবে অস্বীকার করে। তার আদি নাম জইনুল আহমদ বাবুল। বড় ভাই মইনুলের সাথে নাম মিলিয়ে জইনুল।

বাবুল ডাকনামের এই তরুণ গানের অডিশন দিয়ে যখন কলকাতায় গেলেন, সেখানকারই এক চতুর গ্রোমারের বুদ্ধিতে নামের এই বিচ্যুতি। বাবুল নামটা কোনো জনপ্রিয় গায়কের নামের অংশ হতে পারে না- বুদ্ধিমান গ্রোমার তাই অনেকটা জোর করে বাবুলের "ল" সার্জারি করে কেটে ফেললেন। আহমদকে খানিকটা বদলে করে ফেললেন আহসান। নামের সেই বিচ্যুতি পরবর্তীতে যে পুরো জীবনের বিচ্যুতি হয়ে দাঁড়াবে এটা বাবুল কিংবা বাবু নামের এই তরুণ ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি।

মিঃ হাইজিন জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

বাবুল পড়ালেখায় ছিলেন ভালো খারাপের মাঝামাঝি। মেট্রিকে "এ মাইনাস" এবং ইন্টারে "বি" গ্রেড পেয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকার শনির আখড়ার এক প্রাইভেট ভার্সিটিতে। গান বাজনা করতেন স্কুল জীবন থেকেই। ভার্সিটিতে গিয়ে যখন দেখলেন পড়ালেখা ঠিক ধাঁতে সইছে না, তখন ঝুঁকে গেলেন গান বাজনার দিকে। টিউশনির বেতনে কিনলেন গিটার, কয়েকদিনের চেষ্টায় যন্ত্রকে মোটামুটি আয়ত্বে নিয়ে আসেন।

বন্ধুদের আড্ডা কিংবা নিজের ভার্সিটির ছোটো খাটো ফাংশানগুলোতে জেমস-বাচ্চুর গান গেয়ে গাওয়ার মধ্যে বাবুলের শখ সীমাবদ্ধ ছিল। কোনোদিন ভাবেনওনি শখের সীমা আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে, দেখতে হবে জীবনের সব রকম রং। কাছের এক বন্ধুর কাছে জইনুল আহমদ বাবুল খবর পেলেন, কলকাতার "জেড বাংলা" চ্যানেলের মোটামুটি বিখ্যাত শো "গাও বাঙালি গাও" এর ঢাকা অডিশন শুরু হচ্ছে।

অডিশন উৎরে যাবেন, এমন আত্মবিশ্বাস না থাকলেও বন্ধুদের চাপাচাপির কারণে অডিশন দিতে রাজি হোন বাবুল। বন্ধুরাও ভেবেছিল তিনি অডিশনের গণ্ডি পেরুতে পারবেন না। বাবুলের সাফল্য নয় বরং তার ভবিষ্যৎ ব্যর্থতাকে নিয়ে যেন ট্রল টিপ্পনী দেয়া যায় সেটা কামনা করেই তারা বাবুলকে ঠেলে নিয়ে গেল অডিশনে।

কীভাবে কী হলো কেউ জানে না, বাবুল ইয়েস কার্ড পেয়ে গেলেন! কলকাতার জেড বাংলার অধীনে শুরু হলো বাবুলের গ্রোমিং। বাবুল ততদিনে গ্রোমারের বুদ্ধিতে বাবু হয়ে গেছেন। বাবুসহ প্রায় অর্ধশতাধিক শিল্পীকে প্রোমিং করার জন্য ছিলেম অর্ধ ডজন গ্রোমার গ্রোমিং এ কী ছিল না?

সকালে কখন ঘুম থেকে উঠতে হবে, কোন ব্র‍্যান্ডের পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজতে হবে, নাস্তায় কী খেতে হবে; সবই ধরা বাধা ছিল। বাবু ভেবেছিলেন "গাও বাঙালি গাও" নামের প্রোগ্রামে বোধহয় গান গাওয়াই একমাত্র কাজ। পরে দেখা গেল এখানে গান মাত্র চার আনা, বাকি ১২ আনাই অভিনয়।

গানের ফাঁকে ফাঁকে কেমন অঙ্গভঙ্গী করতে হবে সেটা ঠিক করে দিতেন গ্রোমাররা। বাবু কোনোকালে টুপি পরেননি, কিন্তু শরীরের সাথে মানানসই হবে বলে গ্রোমার তাকে চে'মার্কা একটা টুপি ধরিয়ে দিলেন। সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার, উপস্থাপকের সাথে হাসি-তামাশার যে অংশটা; সেটাও ছিল স্ক্রিপ্টেড। কয়েকবার অনুশীলনের পর এমন জিনিস দাঁড়িয়ে যেত, দর্শক ভুলেও ভাববে না এসব কথাবার্তা ঠাণ্ডা মাথায় করা পরিকল্পনার অংশ।

রিয়্যালিটি শোতে কেবল ভালো পারফর্ম করলেই হয় না, ভাগ্যটাও থাকতে হয় সাথে। কোনো দাতব্য কার্যক্রম না এসব শো, সুতরাং নিজেদের ব্যবসা তথা টিআরপির পাঠ ভালোভাবে পড়ে নেন ডিরেক্টর-প্রোডিউসাররা। সোজা হিসেব, যা করলে প্রোগ্রামের টিআরপি বাড়বে, সেটাই করা হবে। এপার-ওপার বাংলার "ব্যালেন্সিং" ধরে রাখতে হয় কঠোরভাবে। গানের পাশাপাশি বাবু এসব হিসাবও বুঝে গেলেন অতি দ্রুত। বাংলাদেশ থেকে একজন সেরা তিনে থাকবে, এটা জানতে বেশি দেরি হয়নি। সেই একজনটা কে, এটা জানতে যা একটু দেরি হয়েছে।

ত্রিমুখী ভাগ্য খুলেছিল বাবুর। প্রথমত সেবার রক ধারার শিল্পী ছিল কম, বাংলাদেশ থেকে খুব ভালো মানের শিল্পী গিয়েছিল আর একজনই। মোহন নামের সেই ছেলেটা কোনো এক গ্রোমারের সাথে বেয়াদবি করে ফেলে, ফলস্বরূপ বাদ পড়ে যায় ঠিক পরের রাউন্ডে। সেকেন্ড রাউন্ডে বাবুর গাওয়া "বাংলাদেশ" গানটা অপ্রত্যাশিত সাড়া ফেলে দেয়, তখুনি ঠিক হয়ে যায় বাবুর ভাগ্য। ভেতরে ভেতরে বাবু জেনেই গিয়েছিলেম, ফাইনালের আগে আর তিনি বাদ পড়ছেন না।

দুই মাস পরে গ্রান্ড ফিনালে শেষ হলো। সেকেন্ড রানার আপ হয়ে ৪ লক্ষ টাকার চেক ও অনেকগুলো খুচরো পুরষ্কার নিয়ে বীরের বেশে দেশে ফিরলেন জইনুল আহসান বাবু। মেস ছেড়ে ততদিনে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়া হয়ে গেছে। সেই ফ্ল্যাটে সকাল বিকেল ভীড় দেখা গেল সাংবাদিকদের। পৃথিবীর সেরা মধু আহরণকারী হচ্ছে সংবাদ মিডিয়া। যেখানে মধু জমে, সেখানে ছুটে গিয়ে ভাগ নিয়ে আসতে তাদের এক মুহুর্ত দেরি হয় না।

দেখা গেল সকাল নয়টায় "দৈনিক শব্দ বোমা"র সাংবাদিক ফরিদ উদ্দিন এসেছেন, এক্সক্লোসিভ সাক্ষাৎকার নেয়া হবে। বিকেল তিনটায় ঘুম থেকে ওঠে বাবু রুম থেকে বের হয়ে জানালেন, তিনি টায়ার্ড। কথা বলা সম্ভব না। দৈনিক শব্দ বোমা'র বাঘা সাংবাদিককে তারপরও বিরক্ত হতে দেখা যেত না। ততদিনে বাবু একজন জ্বলন্ত ক্রেজ। তাকে নিয়ে কিছু একটা লিখতে পারা মানেই পত্রিকার কাটতি।

কোনো কথা না বলেই বাবুর এক দুইটা ছবি নিয়ে হাসিমুখে বিকেল চারটায় নিজের অফিসে ফিরে আসতেন শব্দ বোমা সাংবাদিক। তার পরের দিন বিনোদন পাতার ৭৫% অংশ জুটে শোভা পেত " গাও বাঙালি গাও" এর সুপারস্টার জইনুল আহসান বাবুর সচিত্র সাক্ষাৎকারে। বাবু সকালে কী খান, দুপুরে কী পরেন, বিকেলে কিসে ঘুরেন, কুর্তা নাকি পাঞ্জাবী কোনটা পছন্দ, বিয়ে করবেন কবে, হানিমুন দেশে নাকি বিদেশে... অসংখ্য প্রশ্ন। বাবুকে জবাব দিতে হতো না, শব্দ বোমার সাংবাদিক নিজেই এসব উত্তর লিখে নিতেন। বহু বছর ধরে স্বরচিত সাক্ষাৎকার লিখে এমনিই এরা অভ্যস্ত থাকেন।

জেড বাংলায় সেকেন্ড রানার আপ হয়ে আসার পরের এক বছর কাটল স্বপ্নের মতো। দেশে ঠিক কতটা স্বনামের- অনামের সংগঠন আছে, কার কত রকম ধান্ধা আছে এবং কত রকমের যে কন্সার্ট হয় সে হিসেব পেয়ে গেলেন জইনুল আহসান বাবু। সকালে ঢাকায় কনসার্ট তো বিকেলে রওনা দিতে হয় খুলনা। খুলনা থেকে আবার ঢাকা, তারপর প্লেনে করে চট্টগ্রাম। এরই মধ্যে আসতে শুরু করল বিদেশী শিডিউল। আরব আমিরাত, কাতার এমনকি খোঁদ আমেরিকা থেকেও চলে আসল একটা অফার।

জইনুল আহসান বাবু বাছাই করা ৭-৮ গান করেন সবখানে। যে গানের আবহ পাবার জন্য একটা গীতিকারকে হয়তো জীবনের গভীরতম দুঃখ পেতে হয়েছে, ধাক্কা খেতে হয়েছে, যে গানের শব্দ লেখার জন্য হয়তো অসংখ্য রাত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন ছটফট করে; যে গানের সুরকার হয়তো এক জীবন অপেক্ষা করেছেন এই একটি মাত্র গানের সুর করার জন্য; যে গানের মূল গায়ক হয়তো এমন গানের জন্যই ঘর ছেড়েছেন, ত্যাজ্য হয়েছেন পিতার...

এমন গানগুলো অবলীলায় মাত্র ৫ মিনিটে হেলে দুলে আনন্দ-উচ্ছ্বাস নিয়ে গেয়ে ফেয়ার পথে কয়েক লাখ টাকার চেক পকেটে পেয়ে যেতেন জইনুল আহসান বাবু। একটা দু মাসের গানের অনুষ্ঠান, আর ছোটোবেলায় মুখস্ত করা মাত্র ৭-৮ টা গান; বাবুর জীবনে যেন টাকা আমদানির মেশিন হয়ে গেল। ফাইভ স্টারের রুমে শুয়ে সুন্দরী এসকর্ট জরিয়ে ধরে বিদেশী পানীয়তে চুমুক দিতে দিতে জইনুল আহসান বাবু প্রায়ই ভাবতেন, জীবন সত্যিই পুষ্পশয্যা, সাফল্যের সিঁড়ি কতই না মসৃণ, অর্থ কতই না সহজলভ্য এবং খ্যাতি কতই না সহজ ও অনুকূল!

হ্যাঁ অল্প দিনে, পরিশ্রমহীন জীবনে হঠাৎ অর্থলাভের সাথে সাথে জইনুল আহসান বাবুর জীবনে অনেক নতুন অধ্যায়ের দরজা খুলেছে। এসকর্ট মানে কী সেটা তিনি এখন জানেন। এত সুন্দরী ও প্রশিক্ষিত মেয়েগুলোর নাম এসকর্ট কেন সেটা অবশ্য জানা হয়নি। পানিপথের যুদ্ধের ইতিহাস লিখতে না পেরে মাধ্যমিকে ইতিহাসে ফেল করলেও বিদেশী পানীয়র ইতিহাস এখন তার ঠোঁটস্ত। অর্থ আয়ের পাশাপাশি অর্থ ব্যয়ের অনেক উপায় তিনি আপনাতেই জেনে গেছেন।

স্রোতের মতো আসা টাকা ধরে রাখার খুব বেশি চেষ্টা করেননি। বয়সে তখন মাত্র তরুণ, এখনই টাকা জমানোর দরকার ছিল কী? টাকা আসার লাইন বের হয়ে গেছে, আসতেই থাকবে। গ্রামের অর্ধ পাকা ঘর ভেঙে ডুপ্লেক্স করেছেন যেন সাংবাদিক বা সেলিব্রেটিদের এলাকায় নিয়ে গেলে অপমান না হয়। ব্যাংকে কিছু টাকা জমা ছিল।

ফেসবুকে পরিচিত এক আগুন সুন্দরীকে একবার ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন। এক বেলার আনন্দের চড়া দাম দিতে হয়েছিল তারপর। মেয়েটা কীভাবে জানি গোপন ভিডিও করে দাবি করে বসল বড় অংকের টাকা। জইনুল বাবু আগে জানতেন ব্ল্যাকমেইল কেবল মেয়েদের করা হয়, ছেলেরাও যে এই সমস্যায় পড়তে পারে সেবারই প্রথম জানা। নিজের সেলিব্রেটি জীবনে প্রথম সমস্যা অনুভব করেছিলেন তখন, কেলেংকারীকে মিডিয়া পর্যন্ত আসতে দিলেন না তিনি। গোপনে কয়েক লাখ চলে গেল অন্য একাউন্টে।

বেল তলায় যেতে হয়েছে তারপরও। আরেক সুন্দরী কীভাবে জানি ভুলিয়ে ভালিয়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে দেয়। মাহি নামের এই মেয়ে মারাত্মক সুন্দরী, ঢাকার এক পুলিশ উপকমিশনারের মেয়ে। বেশ স্বাভাবিকভাবে কিছুদিন প্রেমের পর মাহি নিজেই বাবুকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। বাবু ভেবে দেখেন মেয়ে সব দিকই ভালো। পুলিশ উপকমিশনারের মেয়ে, শিক্ষিতা, সুন্দরী। বিয়ে করলেও বাবুর সেলিব্রেটি স্ট্যাটাসে সমস্যা হবে না। বরং এই মেয়ে ফস্কে গেলে পরে আর পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ।

দুজনের সম্মতিতে বিয়ের ব্যাপারটা মিডিয়া ও পরিবারে গোপন করা হলো। জইনুল বাবু অনেক ভেবে দেখলেন, মেয়েটা বেশ সরল। সরল না হলে এভাবে বিয়ে কেউ গোপন রাখে? জইনুল বাবু চাইলেই বিয়ের পরেও যে কোনো মেয়ের থেকে সুবিধা নিতে পারেন। মিডিয়া বিয়ের কথা জানে না, টুকটাক জড়িয়ে পড়া নিয়ে তাদের আপত্তি থাকার কথা না। বরং সেলিব্রেটিরা কে কার সাথে জড়াল এটা তাদের ব্যবসার প্রসারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ খবর।

সরল সহজ মাহি না বরং জইনুল বাবু নিজেই, এই সত্য প্রকাশ হতে দেরি হলো না। বিয়ের খবর গোপন করতে পারার আনন্দে বাবু ভুলেই গিয়েছিলেম কাবিনের দাম ৬০ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। জইনুল বাবুর মতো বিশাল সেলিব্রেটির বিয়ের খবর যখন প্রকাশ পাবে তখন যদি দেখা যায় দেন মোহর কম তাতে বাবুরই অসম্মান হয়। মনের সুখে ৬০ লাখ টাকায় রাজি হওয়া বাবুকে বিয়ের মাত্র তিন মাস পরেই এই টাকা ফেরত দিতে হলো।

তার স্ত্রী মাহির গালে কাঁটা দাগ নিয়ে করা ভিডিও এলো তার হাতে। মাহি কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, "প্রিয় দেশবাসী, আমি জান্নাত মাহি। আপনাদের অতি প্রিয় ও পরিচিত গায়ক জইনুল আহসান বাবুর প্রলোভনে পড়ে আজ আমি অসহায়-নির্যাতিতা। বাবু আমাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ের প্রলোভনে অসংখ্য দিন শরীর ভোগ করে। আমি বিয়ের কথা বললেই মারধর করত।

অবশেষে আমি মামলা দেবার হুমকি দিলে সে বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ে করে। কিন্তু বিয়ের পরে শুরু হয় নতুন নির্যাতন। সে আমাকে প্যান্টের বেল্ট দিয়ে পেটায়, বুকে পেটে লাথি মারে। তার অত্যাচারে আমি অনেক রাত অজ্ঞান কাটাই। এই দেখুন নির্যাতনের চিহ্ন... (গাল ছাড়াও মাহি তখন গলার নিচে বুকের খানিকটা উপরের কাপড় খুলে দেখায়, দেখায় পেটের একাংশ। তিন জায়গাতে কাঁটা দাগ)


প্রিয় দেশবাসী, আমি এর বিচার চাই। আপনারা বলুন আমি কি প্রেম করে ভুল করেছি? কী অন্যায় ছিল আমার?

অচেনা আইডি থেকে আসা এই ভিডিও দেখে দম বন্ধ অনুভব করেন বাবু। মনে মনে গালি দিয়ে বলেন, "এই ছিল তোর মনে?" সত্যি বলতে তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি এমন কোনো বিপদ তার দিকে ধেয়ে আসতে পারে। করণীয় কী, ভাবেন ঠাণ্ডা মাথায়।

যে আইডি থেকে ভিডিও এসেছে, করণীয় বলে দেয়া আছে সেখানেই। মাহিকে তালাক দিতে হবে, দিয়ে দিতে হবে কাবিনের ৬০ লাখ টাকা। আর না হলে এই ভিডিও ভাইরাল হবে। মাহির বাবা পুলিশ, কঠিন মাইর তো খাবেনই, ৭ বছরের আগে ছাড়া পাবেন না জইনুল বাবু। নারীবাদীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে যাবে তার বাসা। এসব তো দৃশ্যমান। অদৃশ্য সমস্যাও আছে। এ কয়দিনে যত মেয়ের সাথে ইটিশ পিটিশ করা হয়েছে, এই সুযোগে সেগুলোও বের হয়ে আসবে। দেশের ক্রেজ জইনুল আহসান বাবুর পথ থেমে যেতে পারে এখানেই।

তারচেয়ে গোপনে ৬০ লাখ টাকা দিয়ে এই অধ্যায় খতম করে দিলেন বাবু। ৬০ লাখ আয় করতে বেশিদিন লাগবে না। যারা বলেন টাকা আয় করা কঠিন, সাফল্য সময় সাপেক্ষ ব্যাপার... এরা আসলে হতাশাবাদী। "গাও বাঙালি গাও" এর স্টেজে তো আর এরা ওঠেনি!

কিন্তু দেড় বছর পার হতেই টাকা আয় করা জইনুল আহসান বাবুর জন্য কিছুটা কঠিন হয়ে গেল। এখন আর আগের মতো কনসার্টের ইনভাইটেশন আসে না। আগের মতো সাংবাদিকরা গিজগিজ করে না বাসায়। "গাও বাঙালি গাও" এর নতুন সিজন শেষ হয়েছে। আবারও সেকেন্ড রানার আপ হয়েছে এদেশী ছেলে, নাম তমাল। তার পেছনে ছুটছে মিডিয়া। পাশাপাশি জুটেছে তামিম নামের নতুন এক দেশী কিশোর।

দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে "তুমি আমার এমনই একজন" গেয়ে ইউটিউবে ছাড়ার পর রীতিমতো ঝড় উঠে গেছে। তমালের পাশাপাশি মিডিয়ার বাকি অংশ তামিমের পেছনে। লেট নাইট টিভি শো ভাগাভাগি করছে এই দুইজন। এক বছর আগে "দৈনিক শব্দ বোমা" পত্রিকায় বাবুর যে সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল, নাম কাল বদলে তমালের নামে ছাপা হয়েছে একই সাক্ষাৎকার।

কয়েকদিন অপেক্ষা করলেন জইনুল আহসান বাবু। তিনি হালের ক্রেজ, এত দ্রুত তাকে কেউ ভুলে যাবে- এটা হয় নাকি? আবার ঠিকই ছুটে আসতে হবে তার কাছে। কিন্তু তাও খুব একটা কেউ আসে না। আসে নতুন ইউটিউবার বা ছাই পাশ অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিক। এদের কেউ কেউ আবার করে ফেলে বেখাপ্পা একটা প্রশ্ন, "ভাই মৌলিক গান কবে করবেন?"

আরে ব্যাটা গানের আবার মৌলিক যৌগিক কী? গান তো গান। আমি যে গান গাই তাতে মানুষ লাফায় না? মাথা ঝাকায় না? তুই লাফাস না?- বাবু মনে মনে ভাবেন। কিন্তু সেটা মুখে বলেন না। মুখ হাসি হাসি করে বলেন, আসবে ভাই আসবে। এত তাড়া কিসের? এ বছরের মাঝামাঝিতে সারপ্রাইজ আছে। অপেক্ষা করেন।

মাঝামাঝি কেটে বছর শেষ হয়ে যায়, মৌলিক গান আর আসে না। মিডিয়াতেও হাঁক ডাক কমছে তো কমছেই। জেড বাংলা থেকে ফিরে আসার পর দৈনিক শব্দ বোমার সাংবাদিক ফরিদ তার রুমে বসে একদিন অপেক্ষা করেছিল দর্শন পেতে, সেই ফরিদ এখন ফোন ধরে না। ইনিয়ে বিনিয়ে নিউজ করার কথা বলার আগেই "ব্যস্ত আছি ভাই" বলে ফোন রেখে দেয়।

নিজের পড়তি বাজার দেখে জইনুল আহসান বাবু ভাবলেন, এভাবে চলতে পারে না। তাকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। মানুষের আগ্রহে ফিরতে হবে আবারও। আবার হতে হবে লাখ লাখ মানুষের ফেসবুক পোস্ট, মিডিয়ার খবর। কিন্তু কীভাবে? "গাও বাঙালি গাও" এর তো পুনর্জন্ম সম্ভব না? কীভাবে? কী করে আবার জনতার আগ্রহের জায়গায় যাবেন?

পথ জানাই আছে তার। খানিক দ্বিধা ঝেড়ে নামলেন সে পথে। দেখা যাক মিডিয়া এবার তাকে কী করে এড়িয়ে চলতে পারে? কীভাবে ফেসবুক চুপ থাকে? নিজের ভেরিফাইড করা পেজ আছে। ফলোয়ার আছে এক মিলিয়ন। সেখানে পোস্ট দিলেন, "জাতীয় কবি হিসেবে কাজী নজরুল আমার একেবারেই পছন্দ না। তারচেয়ে এই সময়ের মজিদ উদ্দিন অনেক ভালো কবিতা লিখেন।"

প্রত্যাশিতভাবেই ঝড় বয়ে গেল দেশে। পোস্টের পর পোস্ট। অধিকাংশই গালি। আবার গালির কাউন্টারেও গালি আছে। আছে "মত প্রকাশের স্বাধীনতা সকলের আছে" টপিকে ইন্টেলেকচুয়াল বিতর্ক। হালের কবি মজিদ উদ্দিনও এলেন আলোচনায়। অযাচিতভাবে আলোচনায় আসা ভদ্রলোক লজ্জায় আত্মগোপনে চলে গেলেন প্রায়।

মিডিয়া পাড়া সরব হলো আবারও। "এ কী বললেন জেড বাংলা স্টার বাবু?" "বাবুর ফাঁস উক্তি ভাইরাল" "নজরুলকে দু চোখে দেখতে পারেন না জইনুল আহসান বাবু" "বদলে যেতে পারেন জাতীয় কবি-বুকে হাত দিয়ে বললেন বাবু"... নিউজের পর নিউজ।

এসব দেখেন আর চোরা হাসি দেন জইনুল বাবু। হলো তো এবার? হলো তো আলোচনা? সোজা আঙুলে ঘি উঠে না এটাই হলো কথা। কিন্তু ঝড় থেমে গেল কিছুদিন পরেই। বাবু আবার হারিয়ে যেতে থাকলেন স্রোতের আড়ালে। এ কী বিপত্তি! খবর হওয়া ছাড়া জীবন কাটানো সম্ভব? আগের কৌশলেই ফিরে যেতে হলো বাবুকে। লিখলেন "আমি আসার আগে দেশে কোনো ভালো শিল্পী ছিল না। আমিই এদেশের একমাত্র ভালো গায়ক।"

গালির বন্যা বইল আরেকবার। আগের বার যারা তার পক্ষে দাঁড়িয়েছল, এবার তাদের অনেকেই পক্ষ ত্যাগ করল। "মত প্রকাশের স্বাধীনতা" গ্রুপও এবার নীরব। তবে তাতে অবশ্য জইনুল আহসান বাবুর কিছুই যায় আসে না। মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে যাওয়াটাই ছিল উদ্দেশ্য- সেটা তো সফল। আগ্রহে যাবার বাজার মূল্য আছে। যতবার এমন বিতর্কের সৃষ্টি হয় ততবার বাবুর নিজের ইউটিউব চ্যানেলের নতুন পুরাতন গানের ভিউ বেড়ে যায়। গালি দিতে যাওয়া জনতা তো আর জানে না তাদের গালিও বাবুর জন্য টাকা উৎপাদন করে।

কিন্তু একদিন শেষ হয়ে গেল এই খেলা। এমন খেলা আজীবন চলতে পারে না, ইতিহাস বারংবার এটাই সাক্ষী দেয়। দ্রুত উত্থানে দ্রুত পতন; বিজ্ঞান-দর্শন-কামরূপ... কোনো তত্ত্ব নেই যে এই ধারণাকে অস্বীকার করে। দুই মাসের রিয়্যালিটি শোয়ের তৈরি গায়ক জইনুল আহসান বাবু তিন বছর পূর্ণ হবার আগে পুরোপুরি ঝরে গেলেন।

বাবুর নাম চলে গেল ইন্টারনেট ও টেলিভিশন যুগের বিজলি বাতিদের নামের আর্কাইভে। হয়ে গেলেন সাবেক। এক সময় আবিষ্কার করলেন খ্যাতি তো বটেই, বাকি জীবনের জন্য খুব বেশি অর্থও অবশিষ্ট রাখতে পারেননি তিনি।

"গাও বাঙালি গাও"- এর বিচারকদের কথা মনে পড়ে বাবুর। শ্রেয়া ঘোষাল তাকে সব সময় রক স্টার বলে ডাকতেন। নচিকেতা অনেক বার কুর্নিশ করেছেন বাবুকে। তখন তার নিজের কাছে মনে হতো জেমস আইয়ুব বাচ্চু কোন ছার? জগতের সবচেয়ে বড়ো রকস্টারের নাম জইনুল আহসান বাবু।


এখন বুঝেন, রিয়্যালিটি শো'য়ের বিচারকরাও পারফর্মার। বিচার কাজ করার সময় তাদের স্তুতি বাণীগুলো হোম ওয়ার্কের অংশ। তারা দুই মাস এমনই প্রশংসা করেন, প্রশংসা করার টাকা পান। একজন জইনুল আহসান বাবুর সারা জীবনে তার পাশে থাকেন না প্রশংসা করবার জন্য। 

আরো দুই বছর তীব্র হতাশায় কাটিয়ে, ফ্ল্যাট বিক্রি করার অর্থ মদ-জুয়া-নারীতে ব্যয় করে জইনুল বাবু ছুটলেন গ্রামের দিকে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বছর। যে সময়ে বাবু জেড বাংলা রাজ করেছেন তখন চাইলে এমপি পদে দাঁড়াতে পারতেন। কিন্তু দিন খারাপ হয়ে গেছে- এই সত্য মেনে জইনুল বাবু চাইলেন চেয়ারম্যান হওয়াটাকেই লক্ষ্যবস্তু করে নিলেন। চেয়ারম্যানদের টাকা কম না। রাজনীতিটাকে শিখে গেলে আরো উপরে ওঠার সময় পাওয়া যাবে। বয়স তো খুব বেশি হয়নি।

জইনুল বাবুর আশা ছিল চেয়ারম্যান ইলেকশন তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাবেন। এই এলাকার মানুষ এক সময় তাকে দেখার জন্য প্রায় টিকেট কেটেছে। জেড বাংলা থেকে ফেরার পর পুরো উপজেলায় মিছিল করেছে। এখন চেয়ারম্যান হবার জন্য তাকে ভোট না দিয়ে যাবে কোথায়? এই হিসাবে ভুল ছিল না বাবুর। ভুল হয়ে গেল অন্যখানে। তিনি রানিং চেয়ারম্যানকে চিনতে ভীষণ ভুল করে ফেলেছিলেন।

নমিনেশন জমা দেবার কয়েক দিন আগে এক রাতে রানিং চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহর বাসায় ডাক পড়ল বাবুর। চা নাস্তার পর্ব সেরে বাবুকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন বরকতউল্লাহ, শুনলাম ইলেকশন করবা? মিটিং টিটিং করতেছ!

বাবু বললেন, জ্বী।

- গান বাজনা বাদ দিয়ে ইলেকশন কেন?

- ভাবলাম জনসেবায় নামি একটু। মানুষের একটা হক আছে না আমার উপর?

মধ্যবয়সী বরকতউল্লাহ জইনুল বাবুর মুখের ওপর বললেন, "বাল সেবার নাম আমার কাছে লইয়া লাভ নাই। আমি তিন বারের চেয়ারম্যান। দাদারে বাচ্চা জন্ম দেয়া শিখাবা না।"

ঘাবড়ে গিয়েছিলেন জইনুল বাবু। এমন কথা শুনতে হবে একেবারে ভাবেননি তিনি। বহু কষ্টে স্বাভাবিক থাকলেন তিনি। অপেক্ষা করলেন পরের কথা শোনার জন্য। বরকতউল্লাহ পান চিবাতে চিবাতে বললেন, "তুমি আমাদের গৌরব-অহংকার। মনে কইরা দেখো তোমারে যে সংবর্ধনা দেয়া হইছিল সেটা আয়োজন করছিলাম আমি বরকত নিজে। চেয়ারম্যান হইবা, গম চুরি করবা আমার আপত্তি নাই। আমি আছিই কয়দিন, গম চুরি করমুই কয়দিন? তবে কথা হইল..."

বরকতউল্লাহ একটু থামলেন। পানের পিক ফেলে বললেন, "কথা হইল তোমার বাবা বয়স কম। রাজনীতি বুঝো নাই এখনো। এক দুই না শিইখা নামতেছে মাঠে। দেখা গেল আচমকা খালের পাড়ে তোমার লাশ পাওয়া গেল। দুই রানের চিপায় গুলি খেয়ে মরে পড়ে আছ। ভালো দেখাইব সেটা?"

জইনুল বাবু ঢোক গিলে বলল, "আপনি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন?"

- আরে না। হুমকি দিমু কেন? এই লাইন খারাপ বাবা। মারার লাইগা কম মানুষ আছে? এই এলাকায় গত বছর তিনটা মার্ডার হইছে। তিনটা লোক গুলি খাইছে রানের চিপায়। উহু, তাতে মরে নাই। মাথায়ও গুলি মারা হইছে। মরছে ঐটাতেই। কিন্তু পাবলিক কী খারাপের খারাপ... খালি রানের চিপার গুলির কথা কয় আর হাসে। হাহাহা হেহেহে...

তিনটা লাশের গল্প বাবু নিজেও জানেন। এবার ভয়ের চূড়ান্ত সীমায় চলে গেলেন তিনি। ভোটের লড়াই এমন কঠিন কে জানত? বাবু বসা থেকে ওঠে বললেন, "চাচা আমি ইলেকশন করব না। যাই।" বাবুকে জোর করে বসালেন রহমতউল্লাহ। বিগলিত স্বরে বললেন, "আমি বললাম আর তাতেই তুমি ইলেকশন করা বাদ দিয়ে দিবা? জনসেবা করবা না? ইলেকশন অবশ্যই করবা তুমি। আমি বরকত বলতেছি।"

দ্বিধায় পড়ে গেলেন বাবু। এই লোকটা মাত্রই ইলেকশন না করার জন্য হুমকি দিল, এখন আবার ইলেকশন করার কথা বলছে... মানে কী? মানে যাই হোক, এসব প্যাঁচে বাবু আর নাই। বাবু হাত কচলে বললেন, "আমি রাজনীতির আশেপাশে নাই চাচা। এই আলোচনা থাক।"

বরকতউল্লাহ মুখ কিছুটা কঠিন করে বললেন, "কিন্তু তুমি তো রাজনীতির মাঠে নাইমাই গেছ যে বাবা! মাথায় ইলেকশন ঢুকা মানেই তুমি এর মধ্যে আছ। তোমাকে তো আমি ছাড়তে পারি না।"

- "কী করবেন?" ভয়ে ভয়ে বললেন বাবু।

- "তুমি এখান থেকে বাইর হইয়া আমার নামে উল্টাপাল্টা কথা ছড়াইবা না এর গ্যারান্টি কী? দেখা যাইব তোমার রানের চিপায় গুল্লি করছে এক পার্টি, ফাঁসলাম আমি। কেমন হয়ে যাইব না?"

রীতিমতো অসহায় বোধ করেছিলেন বাবু। বুঝতেই পারছিলেন না কী বলা উচিত। কী উচিত সেটা বলে দিলেন বরকতউল্লাহ। বাবুকে মেম্বার ইলেকশনে দাঁড়াতে হবে। মেম্বার হলে রহমতউল্লার ছায়ায় তিনি থাকবেন, কোনো অনিষ্ট বাবুকে ধর‍তে পারবে না। রূপনগর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডে দাঁড়াতে হবে বাবুকে। মেম্বারদের মার্ডার হবার রেকর্ড খুব কম। বাবু ইলেকশন না করলেও চেয়ারম্যানিতে জড়িয়ে পড়েছেন। বিপদ থেকে বাঁচতে মেম্বার হওয়াই একমাত্র উপায়।

জইনুল আহসান বাবু জানতেন, বরকতউল্লাহ তাকে কেন মেম্বার বানাতে চাইছেন। মেম্বার হিসেবে নমিনেশন না দিলে তাকে হত্যা করা হতে পারে এই হুমকিও ধরতে পেরেছেন বাবু। নিজের জীবন বাঁচাতে ঢাকা ফিরবেন কিনা ভাবলেন কয়েকবার। পরক্ষণেই মনে পড়ল রহমতউল্লাহর সাথে ঢাকাস্থ মাফিয়াদেরও পরিচয় আছে।

বাধ্য হয়ে রূপনগর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের সদস্য পদে নমিনেশন দিলেন জইনুল আহসান বাবু। জিতলেন বিপুল ব্যবধানে। তার ১৯০৯ ভোটের বিপরীতে আগের মেম্বার গরু চোর শুক্কুর পেল মাত্র ১৮ ভোট। বাংলাদেশের ইতিহাসে হয়ে গেল এক অলিখিত রেকর্ড। ইলেকশন জেতার কয়েকদিন পর নবাগত চেয়ারম্যান রহমতউল্লার বাড়িতে আবার ডাক পড়ল বাবুর।

নেশার ঘোরে রহমত বলে দিলেন সব। জইনুল আহমদ বাবুল জইনুল আহসান বাবু হয়ে গেলেও তার সব খবর রাখতেন রহমত। জানতেন তার উত্থানের ইতিহাস, জানতেন তার পতনের গল্পও। দ্রুত উপরে উঠা গাছের ভীত শক্ত হয় না, কাণ্ড সতেজ থাকে না, থাকে না টিকে থাকার শক্তিও। রহমত ঠিক জানতেন, বাবুল থেকে বাবু হওয়া লোকটা ভেঙে পড়ে আবার ফিরে আসবে গ্রামে।

যখন বাবুলের ক্রমাগত পতন দেখছিলেন, তখনই আশংকা করেছেন সব হারিয়ে বাবু ফিরে আসতে পারে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে। গ্রোমারদের কাছে কথা বলা শেখা টিয়া পাখি ঢাকা শহরে টিকবে না। এর কষ্ট সইবার ইতিহাস নেই, ধৈর্য নেই। একে আসতে হবে শিকড়ে।

বাবুল সত্যিই চলে এসেছে। যা ভেবেছেন রহমত তাই করতে চেয়েছে। বাবুল যদি ভয় না পেত, যদি সত্যিই ইলেকশন করত; ভরাডুবি হতো রহমতের। কিন্তু রহমত জানতেন, দুই মাসের প্রোডাক্ট এই ছেলের ঘটে দুনিয়ার বাস্তব হিসেব নেই। নাকে নল দিয়ে সহজে খাইয়ে এর মুখে খাবার শক্তি শুষে নিয়েছে টিভি আর পত্রিকা। ধারাবাহিকভাবে পতিত হওয়া এই শিশুকে সহজেই ভয় দেখানো যাবে।

বাবুল আর কোনোদিন চেয়ারম্যান হতে পারবে না, অন্তত রহমত যতদিন বেঁচে আছেন। কোনো মেম্বার কেউ রানিং চেয়ারম্যানকে টপকে জিততে পারেনি।কোথাও না। যাকে নিয়ে আলোচনা, সেই জইনুল আহমদ বাবুল কিংবা জইনুল আবেদীন বাবুর এখন আর খুব একটা খারাপ লাগে না। রূপনগর ইউনিয়নের মিটিং এ তাকে নিয়মিত দেখা যায়। রিলিফ বা গর্ভ ভাতা নিতে মাঝে মাঝে বেশ সুন্দরী মেয়েরা আসে ইউনিয়ন অফিসে। বাবুর তখন ঢাকার এসকর্ট মেয়েগুলোর কথা মনে পড়ে। আহা! কত কায়দা কানুন জানত এরা!

মনে পড়ে জেড বাংলার সে সব দিনের কথা। কী রঙিন দিন ছিল! রঙ চকমকে ছিল সেই সময়! শ্রেয়া ঘোষালকে কাছ থেকে দেখবার আনন্দ, ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি... মাঝে মাঝে মনে পড়ে তার। ঢাকার ফ্ল্যাট, মাহি আর নাম ভুলে যাওয়া কয়েকটা মেয়ে কিংবা বিদেশী পানীয়... সে সব কি সত্যিই সত্যিই ছিল নাকি ছিল তামাশা?

মাঝে মাঝে এখনো তাকে নিয়ে ফিচার ছাপা হয়। এক সময়ের ক্রেজ এখন গ্রামের মানুষের সেবা করছেন, প্রশংসা ঝরে পত্রিকায়। মানুষ আহা উহা করে। কেউ কেউ বলে, যাক! ছেলেটা তাহলে ভালো হয়ে গেল। ভদ্র হয়ে গেল। কেউ এখনো গালি দেয়।

জইনুল আহসানের কাছে মাঝে মাঝে সবকিছুকেই তামাশা লাগে। বাবুল নামের সহজ সরল ছেলেটাকে বাবু বানিয়ে তামাশ করা হয়েছে। বাবুল ছেলেটার আজকে একটা চাকরি থাকতে পারত, সহজ একটা জীবন হতে পারত। গ্রামের একটা সুন্দরী মেয়ে তার স্ত্রী হতে পারত। দ্রুত উপরে উঠিয়ে নিচে ফেলা দেয়া নামের যে সব শো, এসব তামাশা ছাড়া আর কিছু না। মাথায় বাস্তবতা জ্ঞান ঢুকানোর আগেই চোখে চাকচিক্য ঢুকিয়ে বেঁচে থাকাকে ওলট পালট করাকে কী জীবন বলে?

না, একে বলে তামাশা।

আরো পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা