গিয়াসউদ্দিন তাহেরী: স্রোতের বিপরীতে থাকা একজন!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
গণ্ডমূর্খ আর সুবিধাবাদীদের ভীড়ে গিয়াসউদ্দিন তাহেরী অনন্য একজন হিসেবেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন বরাবর। ওয়াজ-মাহফিল দিয়ে কোটি কোটি টাকা কামানো বক্তারা সবাই যখন লুকিয়ে আছেন, তখনও তাহেরী এসে দাঁড়িয়েছেন মানুষের পাশে, বাড়িয়ে দিচ্ছেন সাহায্যের হাত।
মাওলানা গিয়াসউদ্দিন তাহেরী ভাইরাল হয়েছিলেন ওয়াজ মাহফিলে ব্যাতিক্রমী ঢংয়ে বক্তৃতা দিয়ে। দর্শকের মনযোগ আকর্ষণের জন্যে ‘চা খাবেন? ঢেলে দেই?’ টাইপের হাস্যকর কিছু কাজ তিনি করেছেন, কাজেই ধর্মীয় বক্তার লেবাস ছাপিয়ে তার গায়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে কমেডিয়ানের খেতাব। তবে হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হওয়া এই মানুষটাই করোনাভাইরাসের মহামারীর সময়ে এগিয়ে এসেছেন, নিজের গ্রামের অসহায়-দুঃস্থ পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছেন, প্রচারের আলোর বাইরে থেকে তাদের সাহায্য করছেন সাধ্যমতো। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাছিহাতা ইউনিয়নের চাপইর গ্রামের দিনমজুরদের তালিকা করে প্রত্যেকের ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছেন তাহেরী এবং তার লোকজন।
সারা বছর ওয়াজ-নসিহত করে বেড়ানো আয়না বিক্রেতা কিংবা আলোর পাখিরা যখন এই দুঃসময়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত, অথবা জামাতে নামাজ পড়া নিয়ে ফতোয়া জারীতে সময় পার করছেন, করোনাভাইরাস নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করে সেটাকে ধর্মের চাদরে মুড়ে সাধারণ বিষয়ে পরিণত করতে চাইছেন, তখন আমাদের চোখে ‘কমেডিয়ান’ হয়ে থাকা তাহেরী চলছেন উল্টোরথে, তিনি সেটাই করছেন, যেটা প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের করা উচিৎ।
পত্রিকায় তাহেরীর কথাগুলো পড়লাম, তার চিন্তাভাবনা এবং দর্শনের গভীরতা দেখে মুগ্ধ হতে হলো। ভদ্রলোক বলছিলেন- 'প্রত্যেক সামর্থবানরা যত্রতত্র দান না করে নিজ নিজ গ্রামে দান করলে আমার মনে হয় কেউ আর অনাহারে থাকবে না। ধরেন, আমার গ্রামে একজন এসে ৫-৬ জনকে ত্রাণ দিয়ে গেলেন। উনিই আবার অন্য গ্রামে গিয়ে দান করলেন এভাবে কিন্তু বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।, এই চিন্তা করে আমি আমার গ্রামের দিনমজুরদের তালিকা তৈরি করেছি। এবং সে অনুযায়ী সন্ধ্যার পরে ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দিয়ে আসছি।'
সন্ধ্যার পরে কেন? এই প্রশ্ন করা হয়েছিল তাহেরীকে, তিনি জবাব দিয়েছেন- 'আমাকে অনেকেই পরামর্শ দিয়েছেন যে স্থানীয় স্কুল মাঠে নির্দিষ্ট দূরত্বের দাগ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে ত্রাণ তুলে দিতে। কিন্তু বিষয়টা লোক দেখানো হয়ে যায়। আমি না করে দিয়েছি, আমি বলেছি ত্রাণ গ্রহীতার ছবি প্রকাশ্যে আসুক বা দান করার ছবি প্রকাশ্যে আসুক এটা আমি চাই না। এজন্য আমি সন্ধ্যার পরে সকলের বাসায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।'
এখন দান করাটা একটা প্রচারণার মতো ব্যাপার হয়ে গেছে। ব্যাপারটাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই, কার শো-অফ করা দানেও যদি কারো উপকার হয়, তাহলে উপকারটাকেই বড় করে দেখা উচিৎ। তবে হাদীসে বলা আছে, এমনভাবে দান করো, যাতে ডান হাত দিয়ে দান করলে বাম হাত টের না পায়। তাহেরীও হাদীসের ফর্মূলাই অনুসরণ করছেন। ওয়াজ-মাহফিলে দেয়া বক্তব্যের কারণে তিনি যথেষ্ট ভাইরাল হয়েছেন, মানুষকে সাহায্যের কাজ করতে এসে নতুন করে ভাইরাল হতে চান না, সেটা বোঝা গেল তার কথাবার্তাতেই- 'দানের বিষয়টা আসলে বলা ঠিক না। আমি বলতে চাই, এই মহামারী কতদিন থাকবে বলা যাচ্ছে না। এখনই শেষ না। আমি গত ৫ দিন ধরে পরিকল্পনা করেছি কীভাবে আমার গ্রামের মানুষদের সহায়তা করবো। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমি ত্রাণ দিয়েছি, দিচ্ছি। সামনে আরো সময় আছে, সেভাবেই আমি এগিয়ে যাব।'
আপনারা মানুন আর না মানুন, এই দেশে এখন ওয়াজে বক্তৃতা দেয়াটা একটা ব্যবসা, বক্তাদের কাছে এটা একটা লোভনীয় চাকরির মতোই। একেকটা ওয়াজ-মাহফিলের জন্যে বক্তাদের লাখ লাখ টাকা পারিশ্রমিক দেয়া হয়, কারো কারো তো নানা রকমের আবদারও থাকে- হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যেতে হবে, ৩০/৪০ জন সফরসঙ্গীর জন্যে আয়োজন রাখতে হবে, এরকম আরও নানা কিছু।
গত এক-দেড় বছরে শুধু ওয়াজে বক্তৃতা করেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন, এমন অনেক বক্তা আছেন। কারো কারো শিডিউল তো এক বছর আগে থেকেই নিয়ে রাখতে হয়! কেউ কেউ আবার সুদূর মালয়েশিয়া থেকে বছরে তিন মাসের জন্যে দেশে আসেন, শুধু শীতের সময়টায় ওয়াজ করবেন বলে! ওয়াজের সিজন শেষ হলেই তারা আবার যার যার জায়গায় ফিরে যান! এটাকে আপনি ব্যবসা না বললে আর কি বলবেন?
ধর্মের গীত গেয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করা সেসব তালেবরদের কারো দেখা নেই এখন। অন্ধের দেশে আয়না বিক্রি করতে আসা নয়নের মনিরা কে কোথায় আছেন কেউ জানে না, তাদের টিকির নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না এখন আর! করোনার প্রকোপে লকডাউনের এই সময়ে দেশের নিম্নবিত্ত মানুষজন যখন কাজ হারিয়ে বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে, একটু সাহায্যের জন্যে হাত পাতছে দ্বারে দ্বারে, কেউ আবার চক্ষুলজ্জার খাতিরে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে- সেই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্যে কোন ধর্মীয় বক্তাকে বাণী দিতে দেখলাম না এ পর্যন্ত। বরং একদল তো ধর্মের নাম ভাঙিয়ে যা তা বলে যাচ্ছেন, করোনাভাইরাস নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করছেন, মুসলমানের করোনা হয় না, মসজিদে ভাইরাস ঢুকতে পারে না বলে ফতোয়া দিচ্ছেন। মসজিদে চোর ঢুকে জুতা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে, আর ভাইরাস নাকি ঢুকতে পারবে না- এই উজবুকদের কথা শুনলে এখন আর হাসিও পায় না।
অথচ তাহেরী গত কিছুদিনে (লকডাউনের আগেই) বেশ কয়েকটা ওয়াজ স্থগিত করেছেন, বক্তৃতা দিতে যাননি, বলেছেন পরে যাবেন। এসব তিনি করেছেন নিজের সচেতনতা থেকে, যাতে জনসমাগম না হয়, করোনা ছড়াতে না পারে। আমরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করলেও, গণ্ডমূর্খ আর সুবিধাবাদীদের ভীড়ে গিয়াসউদ্দিন তাহেরী অনন্য একজন হিসেবেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন বরাবর। তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা হয়েছে, কিন্ত কেউ বলতে পারবে না যে তাহেরী কোনদিন সাম্প্রদায়িক বা উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন, ‘ঘরে ঘরে আল্লামা সাঈদী দাও’ বলে হেঁড়ে গলায় চিৎকার করেছেন, কিংবা ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের অপমান করেছেন। ধর্মীয় বক্তা হিসেবে তাহেরী কতটা ভালো সেটা জানিনা, কিন্ত মানুষ হিসেবে তিনি যে ফার্স্টক্লাস, সেটার নমুনা তো চোখের সামনেই দৃশ্যমান!
আপনাকে ধন্যবাদ গিয়াসউদ্দিন তাহেরী, স্রোতে গা না ভাসিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন আপনি, আপনার জন্যে হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসা…