ভিলেন থেকে সুপারহিরো: ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তো এমনই হওয়া উচিত!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
দু’দিন আগে যারা ভিলেন ছিলেন সবার চোখে, তারাই এখন অনেকের চোখে সুপারহিরো! তাবলিগের মুসল্লিরা দেখিয়েছেন, একটা ভুলেই সব কিছু শেষ হয়ে যায় না...
মানুষগুলো ভুল করেছিলেন। ছোটখাটো নয়, বেশ বড়সড় ভুল, যেটার মাশুল তাদের বাইরেও অনেককেই দিতে হয়েছে, তাদের কারণে বিপদে পড়েছে নিরপরাধ অনেকেও। কিন্ত ভুলের শাস্তি হিসেবে তারা যা পেয়েছেন, সেটাকে বিশাল বললেও কম বলা হয়। একটা বিশেষ ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে, নিজ দেশে সংখ্যালঘু নাগরিক হবার কারণে তাদের অযথাই আক্রমণের নিশাণা বানানো হয়েছে।
রাষ্ট্রের উঁচু পর্যায় থেকে শুরু করে পদলেহনকারী মিডিয়া কিংবা সাম্প্রদায়িক মানসিকতা পোষণকারী লোকজন- সবাই তাদের কাঠগড়ায় তুলেছে। ভুল করা সেই মানুষগুলো এখন দেশের জন্যে, অন্যের উপকারের জন্যে এগিয়ে এসেছেন, প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা করছেন নিজেদের কৃতকর্মের। ভুলের সমালোচনা করেছে সবাই, সংশোধনের যে উদ্যোগ তারা নিয়েছেন, সেটাকেও তো সাধুবাদ জানানো দরকার, তাই না?
ঘটনাটা গত মার্চের। করোনাভাইরাসের প্রকোপ ততদিনে শুরু হয়ে গেছে ভারতে, জনসমাগম এড়িয়ে চলার কথা বলা হচ্ছে সর্বত্র। এরইমধ্যে দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজে এক ধর্মীয় সমাবেশে যোগ দিতে একত্রিত হয়েছিলেন কয়েক হাজার মুসলমান ধর্মাবলম্বী। ভারতজুড়ে তখনও লকডাউনের ঘোষণা না এলেও, এর আগেই দিল্লির রাজ্য সরকার গণজমায়েতের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। সেই নিষেধাজ্ঞা মানেনি নিজামুদ্দিন মারকাজে জড়ো হওয়া মানুষগুলো। এদের নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা সা’দ।
১২ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত চলে সেই ধর্মীয় সমাবেশ। প্রায় তিন-চার হাজার মানুষের জমায়েতের ব্যাপারে নাকি কোন তথ্যই ছিল না দিল্লি পুলিশের কাছে! সমাবেশ শেষ হবার পরে হাজার হাজার মুসলমান সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েন পুরো ভারতে, বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কা থেকে যাওয়া নাগরিকদের কেউ কেউ ফিরে আসেন নিজ দেশে। তবে তাদের মধ্যে অনেকের শরীরে যে করোনাভাইরাসের বীজ প্রবেশ করেছে, সেটা তারা বুঝতে পারেননি।
কয়েকদিন পরে তেলেঙ্গানায় ওই মারকাজ থেকে ফেরা দুজনের শরীরে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব পাবার পরেই নড়েচড়ে বসেছিল ভারত সরকার। লোকেশন ট্রেস করে জানা গেল, কয়েকদিন আগেই তারা নিজামুদ্দিন থেকে এসেছেন। খোঁজ নিয়ে আকাশ ভেঙে পড়লো সবার মাথায়! দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজ তখন করোনাভাইরাসের বিশাল একটা ফ্যাক্টরিতে পরিণত হয়েছে। লকডাউনের কারণে আটকা পড়া দেড়-দুই হাজার মুসলমান তখনও ওই বিল্ডিংয়ে অবস্থান করছেন।
রাতের বেলায় পুলিশি অভিযান চালিয়ে জায়গাটাকে খালি করা হলো, বের করে আনা হলো সবাইকে। পরীক্ষা করা হলো প্রত্যেকের, সাড়ে ছয়শোর বেশি পজিটিভ রোগী পাওয়া গেল। আইসোলেশনে নিয়ে যাওয়া হলো সবাইকে, অনেকের স্থান হলো হাসপাতালে। জ্বলে উঠলো সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প। কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা করোনাভাইরাস ছড়ানোর পেছনে মুসলমানদের দায়ী করা শুরু করলো, সরকারে থাকা বিজেপির নেতারা মুসলমানদের গালমন্দ করতে থাকলো অযথাই।
সেই ঘৃণার আগুনে পেট্রোল ঢাললো মিডিয়ার একাংশ। টক শো’র শিরোনাম হলো, ‘ভারতে করোনার বিরূপ অবস্থান জন্যে কি মুসলমানরাই দায়ী?’ নিজামুদ্দিনের করোনায় আক্রান্তরা হাসপাতালে গিয়ে নার্সদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করছেন, নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন- এরকম মনগড়া খবর বানিয়ে পরিবেশন করা হলো! অথচ লকডাউনের মধ্যেই যে হাজার হাজার হিন্দু পূণ্যার্থী রামনবমী পালনে একত্রিত হয়েছিল, সেখান থেকেও যে করোনার বিস্তার ঘটতে পারে- সেটা বললো না কেউ।
দু’দিন আগে যারা ভিলেন ছিলেন সবার চোখে, সেই মানুষগুলোকেই এখন সুপারহিরোর তকমা দিচ্ছেন অনেকে। ভারতের উগ্রপন্থীরা যাদের করোনাভাইরাস ছড়ানোর অভিযোগে দুষেছিল, পুরো মুসলিম সম্প্রদায়কে কাঠগড়ায় তুলে ফেলেছিল, এখন নিজামুদ্দিনের সেই আক্রান্ত লোকগুলোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ভারত। সেই মারকাজের আক্রান্তদের মধ্যে যারা সুস্থ হয়েছেন, তারা নিজেদের শরীর থেকে প্লাজমা দান করছেন অন্যান্য করোনা রোগীদের চিকিৎসায় সাহায্যের জন্য।
প্লাজমার ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি। দিল্লির রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা চালাচ্ছে। প্লাজমা থেরাপি পদ্ধতিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা কোনও রোগীর রক্তের প্লাজমা আক্রান্তের দেহে ইনজেক্ট করা হয়। ফলে নতুন ওই রোগীর দেহেও অ্যান্টিবডি গড়ে ওঠে, যা করোনা প্রতিরোধে সহায়তা করে।
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল অনুরোধ করেছিলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত থেকে যারা সুস্থ হয়েছেন তারা যেন নিজেদের রক্তের প্লাজমা দান করেন। এই আহ্বানের পর দিল্লির সুলতানপুরি সেন্টারে কোভিড-১৯ রোগ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা চারজন তাবলিগ জামাত সদস্য নিজেদের রক্তের প্লাজমা দান করেছেন। তাবলিগ জামাতের প্রধান মাওলানা সা’দও তাবলিগ সদস্যদের প্লাজমা দান করার জন্য আহ্বান করেছেন। ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে ওঠা তিন শতাধিক তাবলিগ জামাতের সদস্য ইতিমধ্যেই দিল্লি সরকারের কনসেন্ট সেন্টারে নিজেদের প্লাজমা দান করার জন্য আবেদন করেছেন।
করোনাকে সিরিয়াসলি না নিয়ে, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে জমায়েত করে মারকাজের মুসল্লিরা ভুল করেছিলেন, ঘাতক ভাইরাসকে আমন্ত্রণ করে জায়গা দিয়েছিলেন নিজেদের শরীরে। সেখান থেকে অন্যদের শরীরে ছড়িয়েছে ভাইরাস, আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। বিনিময়ে তারা পেয়েছেন কয়েকগুণ বেশি ঘৃণা, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্পের রেশ। যেটা তাদের প্রাপ্য ছিল না। ভুল সংশোধনের তো উপায় নেই, তারা অন্য রোগীদের সুস্থ করায় অবদান রাখতে চাইছেন, ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে এর চেয়ে ভালো উপায় আর কী হতে পারে?
প্রিয় পাঠক, করোনার এই দিনগুলিতে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হতেই পারেন আপনি। সেটা হতে পারে অর্থনৈতিক, মানসিক- বা অন্য কিছু। আপনার সমস্যার কথা জানান আমাদের, আমরা চেষ্টা করব সেটা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অবহিত করার, যাতে বেরিয়ে আসে সমাধানের পথ।