সিনথিয়া গুহ: সাদা অ্যাপ্রন পরিহিত এক দেবদূতের গল্প
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
"আমাদের কাছে রানার চাওয়া তো খুব বেশি কিছু ছিল না। তিনি শুধু জীবনের শেষ কয়টাদিন পরিবারের সঙ্গে কাটাতে চেয়েছেন। মানুষ হিসেবে যদি এইটুকু না করতে পারতাম, তাহলে নিজেকে অপরাধী মনে হতো..."
ভারতের গুজরাটের সুরাট শহরের সরকারী একটা হাসপাতালের সামনে একটা বড়সড় বিলবোর্ড লাগানো আছে। সেখানে লেখা- 'আপনি জানেন, করোনার এই সময়ে মন্দিরগুলো কেন বন্ধ রাখা হয়েছে? কারণ ঈশ্বর আর তার দেব-দেবীরা সবাই মন্দির ছেড়ে ডাক্তারের রূপ ধরে হাসপাতালে এসে কাজ করছেন!'
ডাক্তারদের সাক্ষাৎ ভগবান বলা হয় অনেক আগে থেকেই। মরণাপন্ন রোগীকে মৃত্যুর মুখ থেকে যদি কেউ ফিরিয়ে আনতে পারেন, সেটা একজন চিকিৎসকই। কিন্ত চিকিৎসা সেবা দেয়ার বাইরেও কখনও কখনও ডাক্তারেরা রোগীর বড্ড আপনজন হয়ে ওঠেন। চেনা নেই, জানা নেই, আত্মীয়তার কোন বন্ধন নেই, এমন রোগীর জন্যেও নিজেদের উজাড় করে দেন কেউ কেউ। সাদা অ্যাপ্রন পরিহিত মানুষগুলোকে তখন সত্যিই দেবদূত বলে মনে হয়।
আজ আপনাদের সেরকমই একজন দেবদূতের গল্প শোনানো যাক, ভীনদেশী এক মরণাপন্ন রোগীর শেষ ইচ্ছে পূরণ করার জন্য যিনি ক্রাউডফান্ডিং করে তিনদিনের মধ্যে চল্লিশ লাখ টাকা জোগাড় করেছেন, হাজারটা ঝামেলা মাথায় নিয়ে সেই রোগীকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন, যাতে মানুষটা তার শেষ সময়টা পরিবারের সান্নিধ্যে কাটাতে পারেন! সেই চিকিৎসকের নাম সিনথিয়া গুহ, সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত আছেন তিনি।
সিনথিয়ার এই গল্পের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে চরিত্রটি, তার নাম রানা শিকদার। বাংলাদেশী এই নাগরিক সিঙ্গাপুরে একটা শিপইয়ার্ডে কাজ করতেন। দরিদ্র পরিবারে বড় হয়েছেন রানা, অভাব দেখেছেন চারপাশে, সেই অভাবের ছোবল থেকে নিস্তার পেতেই জায়গা-জমি বিক্রি করে, টাকা ধার নিয়ে সিঙ্গাপুর পাড়ি জমিয়েছিলেন উজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের আশায়, যেখানে অভাব থাকবে না, টাকাপয়সা নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকবে না।
সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি, মাস শেষে বেতন যা পেতেন, সেটা খুব বেশি নয়। সিঙ্গাপুরে থাকা-খাওয়ার খরচ, দেশে পরিবারের কাছে পাঠানো- সব মিলিয়ে জমাতে পারতেন না তেমন কিছুই। ২০১৫ সালে দেশে ফিরে এলেন, অল্প কিছু টাকা নিয়ে একটা দোকান দিলেন, ভাবলেন আর সিঙ্গাপুর যাবেন না, দেশেই থিতু হবেন। বিয়েও করলেন, সন্তানের বাবা হলেন, কিন্ত অভাব ঘিরে ধরলো আবারও। বাধ্য হয়েই রানা ভাবলেন, আবার সিঙ্গাপুর যাবেন। যেই ভাবা সেই কাজ, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি আবার পাড়ি জমালেন সিঙ্গাপুরে, আবারও শিপইয়ার্ডের কাজ।
রানা শিকদার ভেবে রেখেছিলেন, কয়েক বছর শিপইয়ার্ডে কাজ করে কিছু টাকা জমিয়ে একেবারে দেশে ফিরে যাবেন, একটা মুদি দোকান দেবেন, বা অন্য কোন ব্যবসা করবেন। প্রবাস জীবনে আর ফিরবেন না। কিন্ত বিধাতা গল্পটা অন্যরকম করেই ভেবে রেখেছিলেন, তার চিত্রনাট্য বদলানোর সামর্থ্য তো কারো নেই।
এবছরের মে মাসের ঘটনা। হঠাৎ রানার পেটে ব্যথা আর বমি হলো। রানা গেলেন চিকিৎসকের কাছে। ওষুধ খেয়ে ব্যথা কমায় আবারও ছুটলেন কাজে। সপ্তাহখানেক না যেতেই আবার ব্যথা, বমি। এবার ভর্তি হতে হলো সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল তার পাকস্থলীতে ক্যানসার ধরা পড়েছে। চিকিৎসকেরা জানালেন, একেবারে শেষ পর্যায়ে আছে ক্যানসার। তাদের আর কিছুই করার নেই।
নিজের অন্তিম পরিণতির কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন রানা। চিকিৎসকদের কাছে আরজি জানালেন, বাঁচার যেহেতু কোন আশা নেই, জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি পরিবারের সঙ্গে কাটাতে চান, সেই ব্যবস্থা কি করা যায়? করোনার কারণে গোটা বিশ্ব তখন থমকে আছে, বিমান চলাচল বন্ধ। দেশে ফিরতে হলে রানাকে ভাড়া করতে হবে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, তাতে খরচ পড়বে প্রায় বত্রিশ লাখ টাকা, রানার পরিবারের পক্ষে যেটা যোগাড় করা অসম্ভব। নানা জায়গায় অনুমতির ব্যাপারস্যাপারও আছে। কাজেই রানাকে মরতে হবে বিদেশ বিভুঁইয়ে, পরিবার থেকে অনেক দূরে।
গল্পটার ঠিক এই জায়গায় আমাদের সুপারহিরো সিনথিয়া গুহ'র আগমন। রানার শেষ ইচ্ছের কথাটা তিনি জানলেন ১৫ই মে। রানার মুখ থেকে তার জীবনের গল্পটাও শুনলেন, শুনলেন তার ফুটফুটে ছেলেটার কথা, যার কথা বলতে গিয়ে রানা শুধুই কান্না করেন, আর বলেন, মরার আগে ছেলেটাকে কি একবার দেখব না ম্যাডাম? পরের গল্পটা আমরা বরং সিনথিয়ার মুখেই শুনি-
‘রানার শেষ ইচ্ছাটা (দেশে ফেরা) আমি জানতে পারি ১৫ মে। এক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করতে বললেন। যোগাযোগ করি, কিন্তু আশানুরূপ সাড়া পাইনি। এক পর্যায়ে হাসপাতালের একজন নার্স প্রস্তাব করেন, আমরা ক্রাউডসোর্সিংয়ের মাধ্যমে রানার জন্য ফান্ড তৈরি করতে পারি।
জানতে পারলাম ১০ জুনের আগে স্বাভাবিক ফ্লাইট চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমি দ্রুত একটা মেডিকেল ইভাকুয়েশন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা জানায়, যদি সিঙ্গাপুরের স্থানীয় কেউ দায়িত্ব নেয়, তবে তারা রোগী ঢাকায় পৌঁছে দেবে। টাকা পরে দিলেও হবে। এরপর দ্রুত যোগাযোগ করি সিঙ্গাপুরের মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স সেন্টারে। তারা অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে। আমরা ক্রাউডসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ফান্ড জোগাড়ের পুরো ব্যাপারটা তাদের বুঝিয়ে দেই।
যখন সব মোটামুটি গুছিয়ে আনা হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ হাইকমিশন রানার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে বলল। আমি বাংলাদেশে রানার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে হাইকমিশনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিলাম। এরপর হাইকমিশন বলল, করোনা পরীক্ষার ফলাফলও জমা দিতে হবে। তাও দেওয়া হয়। এর পর এক শুক্রবার বাংলাদেশ হাইকমিশন জানায়, রানাকে বাংলাদেশের কোন হাসপাতাল গ্রহণ করবে তা তাদের জানাতে এবং ওই হাসপাতালের একটা চিঠি হাইকমিশনে পাঠাতে।
সৌভাগ্যবশত, আমি বাংলাদেশে প্রায় ছয় বছরের মতো ক্যানসারের ওপর কাজ করেছি। তাই সেখানে আমার পরিচিত কিছু ডাক্তার বন্ধু আছেন। তাদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করি। তারা রানাকে গ্রহণ করতে রাজি হয় এবং সিঙ্গাপুরে একটা চিঠিও পাঠায়। বাংলাদেশ হাইকমিশনে ওই চিঠি জমা দেওয়ার পর তারা জানায়, বিশেষ বিমান অবতরণের জন্য সিভিল এভিয়েশনের অনুমতি লাগবে। আমরা আবার বাংলাদেশে যোগাযোগ করে অনুমতি জোগাড় করি। সবশেষে ২২ মে রাতে আমরা রানাকে তার জন্মভূমিতে, তার পরিবারের কাছে পাঠাতে সক্ষম হই।’
আমাদের কাছে রানার চাওয়া তো খুব বেশি কিছু ছিল না। তিনি শুধু জীবনের শেষ কয়টাদিন পরিবারের সঙ্গে কাটাতে চেয়েছেন। মানুষ হিসেবে যদি এইটুকু না করতে পারতাম, তাহলে নিজেকে অপরাধী মনে হতো। রানাকে বিশেষ বিমানে বাংলাদেশে পাঠাতে খরচ হয়েছিল ৪৮ হাজার সিঙ্গাপুর ডলার (বাংলাদেশী মুদ্রায় ৩১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা)। আর রানার জন্য আমরা যে তহবিল গঠন করেছিলাম, মাত্র ৭২ ঘণ্টায় তাতে জমা পড়েছিল ৬০ হাজার সিঙ্গাপুর ডলার (৩৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা)।"
মে মাসের ২৩ তারিখ রানা তার পরিবারের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন। তার দুই সপ্তাহ বাদে, জুনের দশ তারিখে তিনি পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে, নিজের বাড়িতে, মায়ের কোলে মাথা রেখে। শিয়রে তখন বসেছিলেন তার স্ত্রী, তার সন্তানও ছিল পাশে, যাকে মৃত্যুর আগে একটাবার দেখতে চেয়েছিলেন রানা। সিনথিয়া গুহ তার ভালোবাসা আর মানবিক অনুভূতির ভাণ্ডার নিয়ে এগিয়ে না এলে যেটা সম্ভব হতো না কখনও।
একজন ভীনদেশী নাগরিকের জন্য সিনথিয়া যা করেছেন, যে মহানুভবতা দেখিয়েছেন, এই সময়ে এমন বিরল দৃষ্টান্তের দেখা পাওয়া যায় না। সিনথিয়ার মতো মানুষেরা আছেন বলেই হয়তো পাপের সাগরে ডুবে থাকা এই পৃথিবীটা এখনও টিকে আছে, নইলে ভালোবাসা আর মানবতা নামের বস্তুগুলো তো অদৃশ্যই বলা চলে!
তথ্য ও ছবি কৃতজ্ঞতা- দ্য ডেইলি স্টার
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে