সিলেট সিটি কর্পোরেশন দেখিয়ে দিয়েছে, কীভাবে নগরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়, কীভাবে ডিজিটাল নগর গড়তে হয়। ঢাকার ভবিষ্যত নগরপিতারা দেখেছেন তো?

সিলেট শহরের কয়েকটা ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে অন্তর্জালে। এমনিতেই সিলেটকে বাংলাদেশের লন্ডন বলা হয়, ছবিগুলোতে শহরটাকে দেখে মনে হচ্ছিল শিলং বা গ্যাংটকের মতো পাহাড়ী কোন শহরের ছবি দেখছি বুঝি! কিন্ত কয়েকদিন আগেও তো শহরের এই জায়গাগুলোর চেহারা এমন ছিল না। মনে হচ্ছে কিছু একটা নেই- কী সেটা? 

ছবির ক্যাপশনেই রহস্যভেদ হলো, সিলেট শহরের রাস্তার পাশে বৈদ্যুতিক যেসব কেবল বা ইন্টারনেট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কেবল ছিল, সরিয়ে ফেলা হচ্ছে সেসব। এখন থেকে মাটির ওপরে অগোছালোভাবে কোন তার থাকবে না শহরে, সব যাবে মাটির নিচে দিয়ে। সিলেট হবে বাংলাদেশের প্রথম তার এবং বৈদ্যুতিক খুঁটিবিহীন শহর! 

উদ্যোগটা নিয়েছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন, নগরীকে পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্যে তারা অপরিকল্পিতভাবে ঝুলে থাকা বৈদ্যুতিক খুঁটি আর তারগুলো সরিয়ে ফেলার কথা ভেবেছে। এর পরিবর্তে বিদ্যুতের লাইন যাচ্ছে মাটির নিচে দিয়ে, যেটা উন্নত দেশগুলোতে হরহামেশাই দেখা যায়, তবে বাংলাদেশে এই প্রথম। এখন থেকে রাস্তা বা অন্যকিছুতে কোন প্রতিষ্ঠান যদি খোঁড়াখুঁড়ি করতে চায়, সেটা গ্যাসের লাইন হোক বা ওয়াসাই হোক- সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি নিয়ে করতে হবে। যাতে ভূগর্ভস্থ বৈদ্যুতিক লাইনে কোন সমস্যা না হয়।

সিলেট এখন দেশের প্রথম ঝুলন্ত তারবিহীন নগরী

তবে পুরো কাজটা মোটেও সহজ কিছু ছিল না। পাইলট প্রকল্প চালু করতেই প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে সিটি কর্পোরেশনকে। একদিন আগেও শাহজালাল দরগা রোডের প্রতিটি খুঁটিতে বৈদ্যুতিক লাইনের সঙ্গে মাকড়সা জালের মতন ঝুলছিলো টেলিফোন লাইনসহ অন্যান্য ক্যাবল লাইন। তারের ভীড়ে আকাশ চোখে পড়ে না, এমনই একটা অবস্থা ছিল! চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধানে সেই চিত্রটা বদলে গেল পুরোপুরি, বৈদ্যুতিক লাইন আর কেবল চলে গেল মাটির নিচে, রাস্তার পাশ থেকে হাওয়া হয়ে গেল পিলারগুলো। 

বিদ্যুৎলাইন মাটির নিচে নেওয়ার পর পুরোটা দিনজুড়ে, এমনকি রাতের অনেকটা সময়ও দিন থেকে রাত অব্দি খুঁটি সরানোর কাজ করেছেন বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন। শুরুতে অনেকের কাছেই বাড়তি উপদ্রব বলে মনে হয়েছে ব্যাপারটাকে, প্রথা ভাঙতে তো একটু সময় লাগে। কিন্ত খুঁটি আর তারের জঞ্জাল সরে যাওয়ার পরেই শহরবাসী অবাক হয়ে দেখেছেন, এতদিন ধরে যে শহরে তারা বসবাস করে আসছেন, সেই শহরের সৌন্দর্য্যটা ঢাকা পড়ে ছিল তার আর পিলারের নিচে! 

সিলেট নগরীর সৌন্দর্য্য বেড়ে গেছে বহুগুণ

সিলেট সিটি কর্পোরেশন জানিয়েছে, প্রায় ৬০ কোটি টাকা খরচায় ৭ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎলাইন নির্মাণ করা হবে সিলেট শহরজুড়ে। প্রায় পাঁচশো আরএম স্কয়ার ক্যাবল ক্যাপাসিটির তার নগরের ইলেক্ট্রিক সাপ্লাইস্থ বিদ্যুৎ সাবস্টেশন কেন্দ্র থেকে শুরু হয়ে ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইন আম্বরখানা হয়ে যাবে চৌহাট্টায়। সেখান থেকে একটি লাইন যাবে নগরীর জিন্দাবাজার হয়ে সিটি কর্পোরেশন ও সিলেট সার্কিট হাউজ পর্যন্ত। আরেকটি লাইন যাবে চৌহাট্টা থেকে রিকাবীবাজার হয়ে ওসমানী হাসপাতাল পর্যন্ত। প্রতিটা এলাকাকে পর্যায়ক্রমে তারের জঞ্জাল থেকে মুক্ত করা হবে।

ঢাকা শহরে তারের জঞ্জালের অবস্থা আরও ভয়াবহ। মানুষের মাথার ওপর মাকড়সার জালের মতো ঝুলে থাকে তার, এরই মধ্যে আমাদের বসবাস। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা অন্য কোন দুর্ঘটনায় নিমিষেই ঝরে যেতে পারে শত শত প্রাণ, কিন্ত কারো কোন হেলদোল নেই এটা নিয়ে। না প্রশাসনের, না সিটি কর্পোরেশনের, না জনগণের। এমন নয় যে এই সমস্যার কথা আমাদের নগরপিতারা জানেন না, তারা জানেন ঠিকই, কিন্ত এত ঝামেলা কাঁধে নিতে চান না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে দু-চারটে বাণী ছাড়াই তাদের কাজ। এর বেশি পরিশ্রম করতে তারা কুণ্ঠাবোধ করেন। 

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অল্প কয়দিন পরেই। কোন মেয়রপ্রার্থীর ইলেকশন ম্যানিফেস্টোতে এরকম ঢাকাকেও তার আর বৈদ্যুতিক খুঁটিমুক্ত করার পরিকল্পনা আছে কীনা, আমাদের জানা নেই। সিলেট সিটি কর্পোরেশন দেখিয়ে দিয়েছে, কীভাবে নগরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়, কীভাবে ডিজিটাল নগর গড়তে হয়। ঢাকার ভবিষ্যত নগরপিতারা দেখেছেন তো? 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা