মুসলমানের ঘরে যেমন খাবার নেই, তেমনই হিন্দুরও পকেট খালি। তাহলে বেছে বেছে শুধু একটা ধর্মের মানুষকে কেন সাহায্য করা হবে?
একটা দৃশ্যের কথা ভাবুন। ত্রাণ দেয়া হচ্ছে কোথাও, অসহায় আর বিপদাপন্ন মানুষকে সাহায্য করার কাজ চলছে। মহৎ উদ্যোগ, কোন সন্দেহ নেই। অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে, ধাক্কাধাক্কি করে ত্রানের প্যাকেটটা নিতে গেলেন আপনি, তখন আপনাকে বলা হলো, এই সাহায্য আপনি পাবেন না, কারণ আপনি যে ধর্ম পালন করেন, সেই ধর্মের মানুষের জন্যে ত্রাণ বরাদ্দ করা হয়নি। সাহায্য দেয়া হবে শুধু একটা বিশেষ ধর্মের মানুষকেই- এমন কথা শুনলে কেমন লাগবে?
কাল্পনিক কোন ঘটনা নয়, বাস্তবেই ঘটেছে এমনটা। সিলেটের এক মসজিদে করোনার ছোবলে বিপর্যস্ত অসহায় মানুষকে সাহায্য করার জন্যে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছিল, হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন সেখানে যাওয়া মাত্রই ত্রাণ বিতরণ করতে থাকা ধর্মপ্রাণ কমিটির লোকজন জানিয়েছেন, হিন্দু ধর্মাবলম্বী কাউকে সাহায্য দেয়া হবে না, কারণ তাদের নাম নাকি তালিকায় নেই! তালিকা বানানো হয়েছে শুধু মুসলমানদের নাম দিয়ে, যেন করোনার এই প্রকোপে বাংলাদেশে শুধু মুসলমানরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মানুষকে সাহায্য করাটা পূণ্যের কাজ, কোন সন্দেহ নেই। কিন্ত সাহায্যটাকে এভাবে ধর্মের চাদরে মুড়ে দেয়াটা যে কতখানি অমানবিক, সেটা সিলেটের এই অমানুষগুলো জানে না। মসজিদের মতো একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে তারা অসহায় মানুষকে সাহায্য করার মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প টেনে আনতে ভোলেনি। ইসলাম কি কোথাও বলেছে, যে বিপদের মুহূর্তে শুধু মুসলমানকেই সাহায্য করতে হবে? অন্য ধর্মের মানুষদের প্রতি সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিতে ইসলামের কোথাও কি নিষেধ করা হয়েছে? তাহলে অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর সময় কেন সাম্প্রদায়িকতা টেনে আনা?
করোনার প্রকোপ ঠেকাতে পুরো দেশ একরকম স্থবির হয়ে আছে, সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে নিম্ন আয়ের লোকজন। বাইরে বের হবার নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের হাতে কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই, তাদের হাহাকার দূর করার চেষ্টা করছে অনেকেই। কিন্ত সেটাও পুরোপুরি পূরণ করতে পারছে না তাদের চাহিদা। মুসলমান যেমন না খেয়ে আছে, তেমনই হিন্দুরাও অভুক্ত। মুসলমানের ঘরে যেমন খাবার নেই, তেমনই হিন্দুরও পকেট খালি। তাহলে বেছে বেছে শুধু একটা ধর্মের মানুষকে কেন সাহায্য করা হবে?
নবীজী (সা) বিদায় হজের ভাষণেই প্রতিবেশীর অধিকারের কথা বলেছেন। তেষট্টি বছরের জীবনে কখনও তিনি মানুষকে ধর্ম দিয়ে বিচার করেননি, অসহায়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন নিজেকে উজাড় করে দিয়ে। এমনকি যে বিধর্মী বুড়ি তার চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো তাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে, সেই বুড়ির অসুস্থতার সময়ে তিনি নিজে গিয়ে বৃদ্ধার সেবা করেছেন, তাকে খাবার দিয়েছেন, ঔষধ দিয়েছেন। আর সেই নবীর উম্মত হয়ে মসজিদের প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে আমরা মুসলমানকে ত্রাণ দিচ্ছি, আর হিন্দুরা এলে বলছি হিন্দু কারো নাম লিস্টে নেই, হিন্দুরা ত্রাণ পাবে না- এর চেয়ে জঘন্য ব্যাপার আর কী ঘটতে পারে?
রমজান মাসে ঢাকায় বৌদ্ধ বিহারের পক্ষ থেকে মাসব্যাপী দরিদ্র্য মুসলমানদের ইফতার বিতরণের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হই আমরা। রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকেও এরকম উদ্যোহ নিতে দেখেছি। দূর্গাপূজার সময় হিন্দু-মুসলমানকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মন্দির পাহারা দিতে দেখেছি, যাতে কেউ এসে প্রতিমা ভাঙচুর করতে না পারে। সবসময় জেনে এসেছি, এটাই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেহারা। কিন্ত সিলেটের এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, এর বিপরীত চিত্রটাও আছে, এবং সেটার সংখ্যা একদম নগন্য নয়।
এসব দুই নম্বুরী সাম্প্রদায়িক মানসিকতার তথাকথিত সমাজসেবীদের চেয়ে করোনাভাইরাসও ভালো। ভাইরাস অন্তত হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদটা বোঝে না। সে আক্রমণ করলে সবাইকেই করে, মারলে সবাইকেই মারে। অমুক ধর্মের মানুষকে আক্রমণ করব, তমুক ধর্মকে ছাড় দেব- এরকম একপাক্ষিক চিন্তাভাবনা ভাইরাসের মধ্যে নেই। সাহায্যের নাম করে সাম্প্রদায়িক বিষবাস্পে সমাজটাকে ভরিয়ে তোলা এই ভন্ডের দল ভাইরাসের চেয়েও নিকৃষ্ট।