বাবার ইচ্ছে ছিলো ছেলেকে ডাক্তার বানাবেন। কিন্তু ছেলে পালিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। দেশ ছেড়েই চলে গেলেন একেবারে। যখন ফিরলেন, তখন তিনি অন্য মানুষ। সাহিত্যের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেটা তিনি স্পর্শ করেননি...
'সব্যসাচী' শব্দের অর্থ যার দুই হাত সমানভাবে চলে। সাধারণত যারা একইসঙ্গে অনেক কাজ করতে পারেন, তাদের প্রতিভা বোঝাতে আমরা 'সব্যসাচী' শব্দ ব্যবহার করি। সেরকমই আমাদেরও একজন সব্যসাচী লেখক ছিলেন। অনেকেই হয়তো ধরে ফেলেছেন, কার কথা বলছি। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। কথা বলছি সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে। জীবদ্দশায় তিনি লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, নাটকসহ বহু কিছু। সাহিত্যের অনেক জায়গাতেই তাঁর বিচরণ ছিলো পরাক্রমশালী সম্রাটের মতন।
মানুষটির জন্ম দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা কুড়িগ্রামে। অধিক বর্ষায় বন্যা ও বর্ষার অভাবে তীব্র খরার এ জনপদের মানুষ স্বভাবগতভাবেই লড়াকু, মানবিক ও সংবেদনশীল। এরকম অঞ্চলে জন্ম নেয়া এ মানুষটির কলমেও তাই বরাবরই আমরা দেখি মানবিক সব উপাখ্যান। কুড়িগ্রামের 'হক পরিবার' এ জন্ম নেয়া এ মানুষটির ছিলো আট ভাই-বোন। তিনি ছিলেন সবার বড়। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের হাল ধরার একটা তাগিদও বরাবরই ছিলো।
বাবার ইচ্ছে ছিলো, ছেলে ডাক্তার হবে। অথচ ছেলের ডাক্তার হওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই। কুড়িগ্রাম থেকেই স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে তাই সৈয়দ শামসুল হক ঘর ঘেকে পালিয়ে চলে যান মুম্বাইয়ে। সেখানে একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থায় কাজ করেন বেশ কিছুদিন। সেখানেও মন টেকে না। আবার ফিরে আসেন দেশে। জগন্নাথ কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেই লিখে ফেললেন উপন্যাস- দেয়ালের দেশ।
যদিও লেখালেখির শুরুটা বেশ আগেই। যে বছর মুম্বাইয়ে চলে গিয়েছিলেন, সে বছরেই লিখেছিলেন একটি গল্প, সেটি প্রকাশিত হয়েছিলো ফজলে লোহানি সম্পাদিত 'অগত্যা' নামের একটি ম্যাগাজিনে। গল্পের নাম 'উদয়াস্ত।' সাহিত্যের পোকা ঠিক তখনই ঢুকে গিয়েছিলো মাথায়।
যাই হোক, 'দেয়ালের দেশ' প্রকাশিত হওয়ার পর ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা শুরু করেন তিনি। যদিও জন্ম গ্রামে, কিন্তু তাঁর লেখায় বরাবরই ফুটে উঠেছে সমকালীন মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী সমাজের গল্প। সে কারণেই তাঁর লেখা খুব তাড়াতাড়িই পছন্দ হয়ে যায় পাঠক সমাজের। এছাড়াও লেখেন এক মহিলার ছবি’, অনুপম দিন, সীমানা ছাড়িয়ে'র মতন উপন্যাস। মাত্র উনত্রিশ বছরেই পেয়ে যান বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সবচেয়ে কমবয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার যে রেকর্ড আজও অক্ষত। তিনি পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কারও।
এরপর কবিতা লেখাও শুরু করলেন তিনি। 'কবি' সৈয়দ শামসুল হক কে অনেকে 'গল্পকার' সৈয়দ শামসুল হক এর চেয়ে বড় করে দেখেন। বাংলাদেশের কবিতার জগতে বেশ অন্যরকম এক ধারারই সূচনা করেছিলেন তিনি। আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লেখার যে চল তিনি শুরু করেছেন, সেটি অনুসরণ করেছে সমসাময়িক এবং পরবর্তী অনেক লেখকই। পরানের গহীন ভিতর, বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা, বিরতিহীন উৎসব... তাঁর কবিতাগুলো এখনো পথ দেখায় অনেক নতুন কবিকে।
নাটকের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যাবে৷ বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কিছু নাটকের নাম বললে সেখানে 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' এবং 'নুরুলদীনের সারাজীবন' এর কথা বারবার আসবে। গণনায়ক, ঈর্ষা, নারীগণ, উত্তরবংশ এর মতন নাটকও লিখেছেন তিনি। অসাধারণ সব কাব্যনাট্য লিখে বাংলা নাটকের ইতিহাসে তিনি নিজের অবস্থানকেই পরিষ্কার করে দিয়েছেন। এক্সপেরিমেন্টাল কাজ হিসেবে লিখেছেন 'খেলারাম খেলে যা' উপন্যাসের মত উপন্যাস, যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেই ছিলো নতুন স্টাইলের উপন্যাস! যদিও 'খেলারাম খেলে যা'কে 'অশ্লীলতা'র ট্যাগ দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু এই উপন্যাস বাংলাদেশে এখনও তুমুল জনপ্রিয় এক উপন্যাস।
তিনি যে শুধু সমসাময়িক বিষয় নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন, এমন না। তাঁর উপন্যাসে তিনি মুক্তিযুদ্ধকেও এনেছেন ক্ষণেক্ষণেই। বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ, নীল দংশন, নিষিদ্ধ লোবান, দ্বিতীয় দিনের কাহিনী... প্রত্যেকটি উপন্যাসেই মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে আলাদা দ্যোতনা নিয়ে। আলাদা চেতনা নিয়ে।
শুধুমাত্র গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক লিখে ইস্তফা দিলেও তিনি পারতেন। তা তিনি করেননি। নবীন লেখকদের জন্যেও লিখেছেন বই। 'মার্জিনে মন্তব্য' এর মতন বই লিখেছেন। নতুন যারা লেখালেখি শুরু করতে চায়, তাদের 'রিডিং ম্যাটেরিয়াল' হিসেবে যে বইটি বরাবরই থাকে টেবিলে। এছাড়াও ভাষার ব্যবহার নিয়ে লিখেছেন 'হৃৎকলমের টানে' বা 'কথা সামান্যই' এর মত বই।
বাবার মৃত্যুর পর পরিবারে একটু টানাপোড়েন দেখা দেয়। সে সময়ে সিনেমার জন্যে চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন। সিনেমার গানও লেখেন। 'বড় ভালো লোক ছিলেন’ সিনেমার জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে এবং 'পুরস্কার' সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচয়িতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেন! তাঁর লেখা গান 'হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস দম ফুড়াইলে ঠুস' 'চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা' গানগুলোও খুবই বিখ্যাত হয়েছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গণে।
এসবের পাশাপাশি সাংবাদিকতাও করেছেন বহুবছর। বিবিসি'র সাথেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর পাঠ করেছিলেন তিনি এই বিবিসি থেকেই। পরিচিতদের কাছে ছিলেন প্রিয় 'হক ভাই।'
চার বছর আগের এই দিনে প্রয়াত হন গুণী এ মানুষটি। তবে তিনি প্রয়াত হলেও 'কীর্তিমানের মৃত্যু নেই' এই বেদবাক্যকে সঠিক মেনে তাঁর জীবনভর অসাধারণ সব কাজের জন্যে মানুষ এখনও মনে রেখেছে তাকে। লেখালেখির সাথে দীর্ঘ ষাট দশকের যে সম্পর্ক, সেটি পার্মানেন্ট মার্কারের মতনই তাকে দিয়েছে অমরত্ব। তিনি বেঁচে আছেন তাঁর কলমের মধ্য দিয়েই।
এই বিরল প্রতিভাবান লেখকের প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি রইলো।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন