বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রম্য লেখক হয়েও যিনি কলম ধরেছিলেন সাম্প্রদায়িকতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
পড়াশোনার জন্যে যখন সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে যান, তখন থেকেই লেখালেখি নিয়ে গভীরভাবে ভাবনাচিন্তা শুরু। বাংলা সাহিত্যে এক অন্যরকম স্টাইল শুরু করে যেভাবে তিনি এগোলেন, সে গল্পের পরতে পরতে রয়ে যায় নানারকম চমক!
প্রবল রসবোধ ও পাণ্ডিত্যের মেলবন্ধন আছে এরকম সাহিত্যিকের লিস্টি করতে বসলে প্রথমদিকেই সেখানে হাজির হয়ে যাবেন সৈয়দ মুজতবা আলী। যাঁর ভ্রমন কাহিনী 'দেশে বিদেশে' পড়েন নি, এমন মানুষের সংখ্যা গুনে বলে ফেলা যাবে হয়তো। নিজের প্রত্যেক লেখায় যিনি স্বভাবসিদ্ধ রসালো বর্ণনার পাশাপাশি দেন তথ্যের অদ্ভুত এক মিশ্রনও। বাংলা সাহিত্যে অদ্ভুত রকমের ঋদ্ধ এক লেখার স্টাইল তাঁর। প্রচুর পড়াশোনা যেন ঠিকরে ঠিকরে পড়ে লেখাগুলো থেকে। অথচ তথ্যের ভারে কখনোই যেন বিস্বাদ হয় না লেখাগুলো। লেখাগুলো হয়ে থাকে মেলার মাঠের হাওয়াই মিঠাই। যেন মুখে দিলেই মিলিয়ে যায় উদরের অভ্যন্তরে। কিন্তু রেশ থেকে যায় বহুক্ষণ। এটাই তাঁর লেখার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য।
মানুষটি জন্মগ্রহণ করেছিলেন অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে আসামের অন্তর্ভুক্ত সিলেটের করিমগঞ্জে। বাবা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দার আলী ছিলেন সাব- রেজিস্ট্রার। তার ছিলো বদলীর চাকরী। বদলীর চাকরী হওয়ায় তাকে তল্পিতল্পা নিয়ে ক্রমশ ছুটতে হতো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। এসব কারণেই বালক মুজতবাকেও বছর বছর স্কুল পরিবর্তন করতে হতো। এভাবেই স্কুল পরিবর্তন করতে করতে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ফেলেন তিনি। ভর্তি হন শান্তিনিকেতনে। মুজতবা আলী'কে প্রথম দেখায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ওহে, তোমার মুখ থেকে তো কমলালেবুর গন্ধ বেড়োচ্ছে। সিলেট ছিলো কমলালেবুর জন্যে বিখ্যাত। সে কারণেই কবিগুরু এই মন্তব্য করেন মুজতবা আলীকে। আস্তে আস্তে সখ্যতা বাড়তে থাকে দুজনের মধ্যে। মুজতবা আলী ছিলেন বিশ্বভারতীর প্রথম দিককার ছাত্র। এখানে থাকাকালীন সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, হিন্দি, গুজরাটি, ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয়সহ পনেরোটি ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান নেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার জিজ্ঞেস করছিলেন, এখানে তো এলে, তুমি এখান থেকে কী শিখতে চাও? মুজতবা আলী বিব্রত। তিনি জানেন না, তিনি কী শিখবেন। আমতা আমতা করে বললেন, যেকোনো একটা জিনিস শিখবো। ওটাতেই ভালো করার চেষ্টা করবো। কবিগুরু তখন হাসতে হাসতে বলেছিলেন- বুঝলাম। কিন্তু একটা জিনিসের বদলে একাধিক জিনিস জানলে সমস্যা কী? সৈয়দ মুজতবা আলীর কথাটা মনে ধরলো। এরপর থেকে তিনি আশেপাশে যা-ই পেলেন সেটাই শেখার চেষ্টা করলেন। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন পনেরোটি ভাষা শেখার অনুপ্রেরণাও তিনি পেলেন রবিঠাকুরের ঐ একটি লাইন থেকেই।
শান্তিনিকেতনের সময়টা বেশ ভালো ছিলো। পড়াশোনার পাশাপাশি প্রচুর আড্ডা মারতেন। প্রবল জ্ঞানগর্ভমূলক কথাবার্তাও সে আড্ডায় থাকতো, অবশ্যই রসের মোড়কে৷ খুব অল্পদিনের মধ্যেই সৈয়দ মুজতবা আলী হয়ে গেলেন শান্তিনিকেতনের আড্ডার মধ্যমণি। মানুষজন বাইরে থেকে ঘুরতে এলে তাকে খুঁজতো। একবার এরকম হলো- একদল মানুষ বাইরে থেকে এসেছে। শান্তিনিকেতনে অনেককিছু দেখেটেখে তারা শেষমেশ এসেছে মুজতবা আলীর সাথে দেখা করতে৷ দেখা হওয়ার পর তিনি দর্শনার্থীদের স্বভাবসুলভ বিদ্রুপের ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন- শান্তিনিকেতনে এসে ক্ষিতিমোহনবাবুকে দেখেছ? দলের লোকজন বললো, দেখেছি। নন্দলাল বসুকে? হ্যাঁ, দেখেছি। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে? তাঁকেও দেখেছি।’ তার পরেই তিনি বেজার মুখে মন্তব্য করলেন,
ওঃ বাঘ সিংহ সব দেখে, এখন বুঝি খট্টাশটাকে দেখতে এসেছ!
এরকমই প্রবল ছিলো তাঁর রসবোধ।
শান্তিনিকেতনের আড্ডার দিনও একসময় ফুরিয়ে আসে তাঁর। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে এখান থেকে বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এ বিষয়ে আরেকটু তথ্য জানিয়ে রাখা ভালো- শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় 'বিশ্বভারতী' ম্যাগাজিনে মুজতবা আলী লিখতেন বিভিন্ন বিষয়ে। শুধু 'বিশ্বভারতী'তে না, ‘সত্যপীর’, ‘ওমর খৈয়াম’, ‘টেকচাঁদ’, ‘প্রিয়দর্শী’ ছদ্মনামে দেশ, আনন্দবাজার, বসুমতী, সত্যযুগ, মোহাম্মদী প্রভৃতিতে কলাম লিখতেন তিনি। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন সময়েই তাঁর ভেতরে লেখালেখির ভূত পাকাপাকিভাবে ভর করে।
শান্তিনিকেতন থেকে বের হয়ে তিনি পড়াশোনা করতে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি চাকরী শুরু করেন কাবুলের শিক্ষা দপ্তরে। এরপর তিনি চাকরী করেছন অজস্র। কখনো শিক্ষকতা, কখনো শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টা, আকাশবানীর স্টেশন রিডার সহ অনেক রকম কাজেই তিনি যুক্ত ছিলেন। এইসব চাকরীর ফাঁকে ফাঁকে তিনি পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন নিয়মিত। দর্শনশাস্ত্র পড়ার জন্য বৃত্তি নিয়ে গিয়েছেন জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে। মিশরের কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশোনা করে তিনি।
তবে যতই উচ্চপদে চাকরী করেন না কেন, মানুষ হিসেবে বরাবরই তিনি ছিলেন হাস্যরসে ভরা। খুব ছোট ছোট মজার ঘটনাও চাউর আছে তাকে নিয়ে। একবার পুজোর ছুটিতে তিনি ফিরছেন কলকাতায়, সাথে একদল সঙ্গী, যাদের মধ্যে আছেন সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রিয় ব্যক্তিগত চিকিৎসকও। স্টেশনে এসে জানা গেল, ট্রেন একটু লেটে আসবে। সবাই ভাবলেন, হাতে যেহেতু একটু সময় পাওয়া গেলোই, একটু খাওয়াদাওয়া করা যাক। খেতে বসেছেন তারা, এমন সময় ট্রেনের হুইসেল! খাওয়া ফেলে রেখেই সবাই চলে এলো বাইরে। এসে দেখে, প্লাটফর্মে ঢুকছে একটি মালগাড়ি। তাদের ট্রেন না। এটা দেখে হাসতে হাসতে মুজতবা আলী তার ব্যক্তিগত চিকিৎসককে বললেন,
এই ঘটনাকে ডাক্তারি ভাষায় কী বলে, জানো? এটিকে বলে ফলস লেবার পেইন!
ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সাথেও বিভিন্ন রকম হাসিঠাট্টা করতেন তিনি। শান্তিনিকেতনে জার্মান ভাষার ক্লাস নিতেন তিনি তখন। একবার সেখানে আসে জার্মান ভাষা নিয়ে পাশ করে যাওয়া এক ছাত্রী। ঘুরতে ঘুরতে ছাত্রীটি আসে মুজতবা আলীর ক্লাসে। মুজতবা আলী তার পরিচয় জানতে পেরে বলেন,
এ কী সুন্দরী! আমি পড়াতে এলাম আর তুমিও চলে গেলে? এ তো ঠিক হলোনা। আচ্ছা কেমন জার্মান ভাষা শিখেছো, বলো শুনি। জার্মান ভাষায় খিস্তি করো তো একটু।
এরকমই পাগলামি তিনি করতেন৷ এরকমই ছিলো তার স্বভাব।
জীবদ্দশায় ঘুরেছেন তিনি বহু দেশে। পড়াশোনা ও কাজের কারণে অনেক জায়গাতেই যেতে হয়েছে তাকে। এসব জায়গার অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ভ্রমণকাহিনী। এছাড়াও লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা। লিখেছেন ত্রিশটির মত বই। জীবদ্দশায় পেয়েছেন অজস্র পুরস্কারও। হাস্যরসাত্মক কথাবার্তার মধ্য দিয়ে জীবনবাস্তবতাকে তিনি যেভাবে ফুটিয়ে তুলতেন, সেরকমটি পারেনি অনেক বিদগ্ধ সাহিত্যিকই। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে তাঁর মতন প্রবল প্রতাপশালী সাহিত্যিক ছিলেন না আর একজনও।
কথাবার্তা বলতেন খুব সোজাসাপটা। অনেক বিতর্কিত বিষয়ে নিরপেক্ষ মন্তব্য করে অনেকেরই চক্ষুশূল হয়েছেন তিনি, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এসে। অবশ্য তাতে তার তেমন কোনো হেলদোল হয়নি। তিনি নিজের মতই নিরপেক্ষ ছিলেন পুরো জীবনকালে। মুজতবা অপছন্দ করতেন কট্টর সাম্প্রদায়িক মানুষদেরও। মুজতবার ধর্মদর্শন নিয়ে বড় ভাই সৈয়দ মুর্তাজা আলী মন্তব্য করেন:
তাঁর (মুজতবা আলীর) সাহিত্যে বিন্দুমাত্র ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিল না। কিন্তু তাঁর এই উদারতার জন্য গোঁড়া স্বধর্মীরা তাঁকে কোনোদিন ক্ষমা করেননি।
এই গুনী ও সৎ মানুষটিরই শেষ জীবন কেটেছে নিদারুণ কষ্টে। টাকার অভাবে অনেকটা মানবেতর জীবনই কাটাতে হয়েছে তাকে। তবে জীবন যেরকমই হোক, কলম এবং বিদ্রুপে তার ছিঁটেফোঁটাও আসতে দেননি তিনি কখনোই। জীবনের শেষদিন পর্যন্তই তিনি করে গিয়েছেন রসিকতা।
ছোটবেলায় মুজতবার ডাকনাম ছিল 'সিতারা'। কাছের মানুষেরা ডাকতেন 'সীতু' বলে। 'সিতারা' শব্দের অর্থ নক্ষত্র। বাবা-মা বুঝেছিলেন কী না, জানা নেই। তবে ডাকনামকে সার্থক প্রমাণ করে তিনি একসময়ে এসে সত্যিই হয়ে গিয়েছেন বাংলাসাহিত্যের এক বড়সড় নক্ষত্র। যদিও জীবন যে খুব সুখের কেটেছে, তা বলা যাবে না। তবে তিনি আপোষ করেন নি কোনোদিন। প্রবল জ্ঞানী হওয়া সত্বেও কোনোদিন সেগুলো নিয়ে বড়াই করেন নি। নিজের লেখাতেই নিজেকে কটাক্ষ করেছেন, সমাজকে কটাক্ষ করেছেন, জীবন-বাস্তবতাকে কটাক্ষ করেছেন। এসব কারণেই হয়তো সৈয়দ মুজতবা আলী এখনো প্রাসঙ্গিক, আলোচিত ও প্রশংসিত। এখনো তাঁর লেখাগুলোকে ধরা হয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে। এখনো তাঁর লেখালেখি নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়। এখনো বহু পাঠক পড়তে শুরু করেন তাঁর বই দিয়েই।
প্রখর ধীশক্তিসম্পন্ন এই মানুষটির জন্মদিন আজকে। জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি রইলো।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন