ভারতে বিজেপি সরকারের যখন বারবার বলছে ‘অবৈধ বাংলাদেশিরা’ দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে বসবাস করছে, যখন এনআরসির উত্তাপ গোটা ভারতজুড়ে তখন এমন সাহসী বক্তব্য একজন মুক্তিযোদ্ধার পক্ষেই সম্ভব।
'আমার দেশের একজন নাগরিক প্রয়োজনে সমুদ্রে সাঁতার কেটে ইতালি যাবে, তবে ভারত নয়। কারণ ভারতের মাথাপিছু আয় খুব বেশি নয়। ভারতের চেয়েও আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার এখন অনেক বেশি, ৮ শতাংশের ওপর ঘোরাফেরা করছে। তো বাংলাদেশিরা তাদের চেয়ে কম আয়ের দেশে কোন দুঃখে আসতে যাবে, বলুন তো?’
বাংলাদেশের একজন কূটনীতিকের কী অসাধারণ বক্তব্য। তাও আবার বিদায়ী ভাষণে। ভারতে বিজেপি সরকারের যখন বারবার বলছে ‘অবৈধ বাংলাদেশিরা’ দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে বসবাস করছে, যখন এনআরসির উত্তাপ গোটা ভারতজুড়ে তখন এমন সাহসী বক্তব্য একজন মুক্তিযোদ্ধার পক্ষেই সম্ভব।
সেদিন তার ওই বক্তব্যটি শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করেছিল ভারতের একাধিক গণমাধ্যম। আমি বলবো, বাংলাদেশ-ভারত অভিবাসী নিয়ে যতো কথা হবে রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম অালীর কথাগুলো আমার মনে থাকবে।
এই তো, সপ্তাহ দুয়েক আগে ব্যাংককে অভিবাসন নিয়ে একটা বৈঠকে ভারতীয় একজন যখন অবৈধ বাংলাদেশিদের নিয়ে মন্তব্য করছিলেন, আমি তখন ভারতের আমাদের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। আমার সাথে সহমত প্রকাশ করেছিলেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কর্মকর্তা শাবেরি।
অসম্ভব প্রজ্ঞার অধিকারী, রসিক, সাহিত্যপ্রেমী, মুক্তিযোদ্ধা এবং সর্বোপরি নিপুণ কূটনীতিবিদ সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী একটা কথা প্রায়ই বলতেন বলে ভরতীয় সাংবাদিকদের কাছে জেনেছি। একান্ত আলোচনায় বা ঘরোয়া বৈঠকে বহুবার সৈয়দ সাহেব বলেছেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে একজন রাষ্ট্রদূতের পারফরম্যান্সে ভালো-মন্দ বলে আসলে কিছু হয় না। দুটো দেশের মধ্যে সম্পর্ক যতটা ভালো বা যতটা খারাপ, সেই ডিপ্লোম্যাটের পারফরম্যান্সও আসলে ততটাই ভালো বা খারাপ।’
কী অসাধারণ বক্তব্য! আপনারা নিশ্চয় জানেন, লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাতিজা ছিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। এ বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি: মজলিশি মুজতবা আলী শিরোনামে একটা দারুণ লেখা লিখেছিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী।
চাচাকে নিয়ে তাতে তিনি লিখেছেন, “চাচা তার অনবদ্য সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন তার পাঠকদের কাছে। তবে আমার কাছে আমার মহাপণ্ডিত চাচা একজন মজলিশি মানুষ, যিনি কথার জাদুকর এবং তার গুণগ্রাহী আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আড্ডা দিতে পছন্দ করতেন। তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেন অকাতরে”।
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী লিখছেন, “একদিন চাচাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘দেশে-বিদেশে’তে আপনি যেভাবে দিনক্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন, তাতে মনে হয় আপনি কোনো ডায়রি রাখতেন। চাচা বললেন, তিনি ‘দেশে-বিদেশে’ লিখেছেন কাবুল ছাড়ার প্রায় দুই দশক পরে।তিনি লিখেছেন সম্পূর্ণ তার স্মৃতিশক্তির ওপর ভিত্তি করে। কারণ তার কোনো ডায়রি ছিল না।
চাচা আমাকে বললেন, ভাতিজা যখন তুমি কিছু লিখে রাখ, তখন তোমার স্মৃতিশক্তি তা ভুলে যায়, কারণ তুমি তার ওপর ভরসা করোনি। কাজেই স্মৃতিশক্তি বাড়াতে হলে ধীরে ধীরে তাকে শক্ত করো, সমৃদ্ধ করো। সে তোমার সঙ্গে থাকবে। কাগজ খুঁজতে হবে না”।
ভারতের অানন্দবাজার পত্রিকাতেও অনবদ্য ‘চাচা কাহিনী’ লিখেছিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর জন্ম ১৯৪৪ সালে সিলেটে। বড় ভাই এসএম আলী ছিলেন ডেইলি স্টারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী মোয়াজ্জেম আলী ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে কূটনীতিক হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে কর্মরত ছিলেন। সে সময় ৪ আগস্ট তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানান এবং স্বাধীন বাংলাদেশের আলাদা দূতাবাস খোলেন। বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে ইউনেস্কোর কাছে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেতে ভূমিকা রাখেন তিনি।
সাবেক এই পররাষ্ট্রসচিব ও কূটনীতিক আজ সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। পরপারে ভালো থাকুন হে বীর যোদ্ধা! আপনাকে স্যালুট।