অনেকের ভুল ধারণা, যাদের অনেক টাকা তারাই কেবল সুইস ব্যাংকগুলোতে টাকা রাখতে পারে! কোটিপতি না হলে এখানে ব্যাংক একাউন্ট খোলা যায় না! আসলে এটি একটি মিথ মাত্র।

ঘটনা ১- বিখ্যাত ইন্টিলিজেন্স অফিসার জেমস বন্ড গেলেন স্পেনে সুইস ব্যাংকের একটি শাখায়। কিন্তু কী বিপদ! শুরুতেই তাকে আটকে দেয়া হলো। ব্যাংকারের সাথে দেখা করার আগে জেমস বন্ডের মতো মানুষকেও আপাদমস্তক তল্লাশির তলে পড়তে হলো। সুইস ব্যাংকের কী কঠোর নিরাপত্তার নমুনা, নিরাপত্তা লাইনের লোককেও ছাড়াছাড়ি নাই! 

ঘটনা ২- ড্যান ব্রাউনের দুনিয়া কাঁপানো দ্যা ভিঞ্চি কোড বইয়ে ত্রিকোণ আকৃতির একটি নিরাপত্তা চাবির কথা উল্লেখ আছে। এই চাবি সাধারণ কোনো চাবি নয়। এই গোপন চাবির মাধ্যমে একটি রোবোটিক হাতকে এক্টিভেট করা হয়। রোবোটিক হাতটি এক্টিভেট হওয়ার পর সেটি প্যারিসের সুইস ব্যাংকয়ের দেয়াল থেকে একটি সেফটি ডিপোজিট বক্স টেনে বের করে। আর সেই ডিপোজিট বক্সেই থাকে খৃষ্টান ধর্মের সেই গোপন রহস্য। একটি ব্যাংকের জন্যে রোবট, ভাবা যায়? 

কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, বাস্তবের সুইস ব্যাংকে এ ধরণের কোনো ঘটনা নেই। গল্প, সিনেমা, উপন্যাসে সুইস ব্যাংককে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় আসলে ব্যাপারগুলো তেমন নয়। সেখানে কোনো রোবোটিক সিস্টেম নেই। এটা সত্যি যে সুইস ব্যাংকের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে, কিন্তু তাই বলে সিনেমার মতো বাস্তবে একাউন্টে প্রবেশের আগে তল্লাশি করা হয় না সুইস ব্যাংকে। 

বছরের পর বছর ধরে সুইস ব্যাংকের সম্পর্কে আমাদের মনে যে ধারণা তৈরি হয়ে আছে তার অধিকাংশই মনগড়া। তার মধ্যে সবচেয়ে সহজ এবং সত্য একটি তথ্য হচ্ছে সুইস ব্যাংক বলেই আসলে কিছু নেই! সুইস ব্যাংক বলে যে টার্মটির সাথে আমরা পরিচিত এটি ভুল।

বহুল আলোচিত সুইস ব্যাংক বলতে কী বোঝায়? 

১৮৫৪ সালে সুইস ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ১৯৯৮ সালের পর থেকে সুইস ব্যাংক বলে আর কিছু নেই। সে বছর সুইস ব্যাংক ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ড এর সাথে একীভূত হয়ে যায়। বর্তমানে ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ড গোটা ইউরোপের মধ্যে সবচাইতে বড় ব্যাংক এবং সারা বিশ্বে এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক। মোদ্দাকথা এই যে, সুইস ব্যাংক বলে আপাতত এখন কোনো একক ব্যাংক এর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু Swiss Financial Market Supervisory Authority (FINMA)-এর অধীনে সুইজারল্যান্ডের সকল ব্যাংকই সুইস ব্যাংক বলে পরিচিত। তার মধ্যে আছে ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ড, ক্রেডিট সুইস ইত্যাদি। 

কেন এই সুইস ব্যাংকগুলো এত জনপ্রিয়? এত আলোচিত? 

এর প্রধান কারণ, প্রাইভেসি এবং স্থিতিশীলতা। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং সিস্টেমকে পৃথিবীর অন্যতম স্থিতিশীল ব্যাংকিং সিস্টেম বলা হয়। তাছাড়া সেখানে ক্লায়েন্টদের গচ্ছিত অর্থ সম্পদের সর্বোচ্চ তথ্যগত নিরাপত্তা দিয়ে আসছিলো সুইস ব্যাংকগুলো। আজ থেকে ৩০০ বছর আগে থেকেই এই ধরণের গোপন একাউন্ট খুলে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে টাকা রাখার ব্যাপারটি প্রচলন হয়েছে। 

ইতিহাস বলে, মূলত ফ্রান্সের রাজাদের সঞ্চিত অর্থ গোপন রাখার প্রবণতা থেকে শুরু হয়েছিলো এই ধরণের ব্যবস্থা। এছাড়া ১৭১৩ সালের জেনেভা সিটি কাউন্সিলের একটি আইন এই গোপনীয়তাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, কোনো গ্রাহকের একাউন্টের তথ্য সে ছাড়া আর কেউ জানবে না। গ্রাহকের একাউন্ট তথ্য সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রাখার নীতিমালা করা হয়েছিলো। তখন ব্যাংকের কাছেও নিজের নাম পরিচয় ঠিকানা গোপন করে একাউন্ট খোলা যেতো। ফলে তখন থেকেই বিভিন্ন দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ এসে জমা হতে থাকলো সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে। যদিও বর্তমানে ব্যাংকের কাছে পরিচয় গোপন রাখার অপশন নেই। তবে নাম্বারড একাউন্ট এর ব্যবস্থা আছে। এই একাউন্টে গ্রাহকের নামধামের পরিবর্তে তাকে নির্দিষ্ট কিছু গোপন নাম্বার দেয়া হবে যা তার গোপনীয়তা রক্ষা করবে। ব্যাংকের খুব কম মানুষই জানবে এই নাম্বারের পেছনের মানুষটি কে! 

সুইস ব্যাংকগুলোতে কার কত অর্থ জমা আছে এধরণের তথ্য সাধারণত তারা প্রকাশ করে না। এসোসিয়েশন অব সুইস প্রাইভেট ব্যাংকার্স এর প্রধান মিশেল ডি রবার্ট গোপনীয়তার ব্যাপারে বলেন, “একজন ডাক্তার কিংবা আইনজীবি যেভাবে ক্লায়েন্টের তথ্য গোপন রাখে এখানেও ব্যাপারটি একই। সুইস ব্যাংক তার ক্লায়েন্টের তথ্য কাউকে দিতে বাধ্য নন, এটা রীতিমতো নীতি এবং আইনবিরুদ্ধ”। আর এই কারণেই সুইস ব্যাংকগুলো এতটা জনপ্রিয়। 

সুইস ব্যাংকে একাউন্ট খোলার যোগ্যতা

একটা তথ্য দেই। ২০১৬ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ১০ লাখ সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা! ধারণা করা হয় এর অধিকাংশই পাচারকৃত কালো টাকা। বিভিন্ন দেশ থেকে রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, মাফিয়া, ক্রিমিনাল সহ কোটিপতিরাই মূলত অর্থ পাচার করে সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা রাখে। 

অনেকের ভুল ধারণা যাদের অনেক অর্থ তারাই কেবল সুইস ব্যাংকগুলোতে টাকা রাখতে পারে। কোটিপতি না হলে এখানে ব্যাংক একাউন্ট খোলা যায় না। আসলে এটি একটি মিথ মাত্র। আপনি যদি সৎ হন তাতে নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। সুইস ব্যাংকগুলোতে প্রচুর সাধারণ মানুষের একাউন্ট আছে। যেসব দেশের সরকার ব্যবস্থা অস্থিতিশীল এবং অর্থনীতি ভঙ্গুর এমন দেশগুলোর মানুষেরা সুইস ব্যাংকগুলোতে একাউন্ট খোলে আর্থিক নিরাপত্তার কারণে। শুধু অবৈধ অর্থ রাখা কিংবা অর্থের গোপনীয়তাই কিন্তু একাউন্ট খোলার মূল উদ্দেশ্য না। 

১৮ বছর বয়সী যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সুইস ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে পারে। একাউন্ট খোলার পর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ একাউন্টে জমা রাখতে হয়, এটি ব্যাংক ভেদে ভিন্ন হয়। 

যে ধরনের একাউন্ট খোলা যায়

অন্যান্য সাধারণ ব্যাংক এর মতোই এখানেও চলতি হিসাব, সঞ্চয়ী হিসাব সহ বিভিন্ন একাউন্ট খোলা যায়। তবে বিদেশী নাগরিকদের জন্য সুইস ব্যাংকগুলো ইনভেস্টমেন্ট একাউন্ট খুলতে উৎসাহিত করে।

ইনভেস্টমেন্ট একাউন্ট খোলার নিয়ম: যিনি একাউন্ট খুলতে চান তিনি অথবা তার প্রতিনিধিকে প্রথমেই পছন্দের সুইস ব্যাংকটির যেকোনো একটি শাখায় ভিজিট করতে হবে। প্রতিনিধি পাঠালে প্রতিনিধি এবং যার নামে একাউন্ট তার তথ্য ব্যাংককে দিতে হবে।

অফিস বা নিজ প্রতিষ্ঠানের সত্যায়িত আইডি কার্ডের ফটোকপি, পাসপোর্টের ফটোকপি ব্যাংকের কাছে জমা দিতে হবে। কিছু ব্যাংক অবশ্য এই প্রক্রিয়াটি মেইলের মাধ্যমেই করে। তবে অন্যান্য ব্যাংকের মতো সুইস ব্যাংকগুলোও অর্থের উৎস যাচাই করতে চাইতে পারে। সেক্ষেত্রে ব্যাংককে আয়ের উৎসের ডকুমেন্টও প্রদান করতে হবে।

উদাহরণ- আপনি একাউন্ট খোলার সময় বললেন, আপনি বাড়ি বিক্রি করে টাকা পেয়েছেন। সেক্ষেত্রে বাড়ি বিক্রির রশিদ ব্যাংক চাইতে পারে। তাছাড়া ব্যাংক যদি সন্দেহ পোষণ করে আপনার ডকুমেন্টের সাথে দেয়া ঠিকানাও ভেরিফাই করতে পারে। অতঃপর ব্যাংকের দেয়া আবেদনপত্রের কাগজপত্র আপনাকে পূরণ করতে হবে।

সম্প্রতি আন্তজার্তিক চাপের কারণে এবং বিভিন্ন দেশে কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় একাউন্ট খোলার প্রক্রিয়াটি বেশ সময় নিয়েই করে ব্যাংকগুলো। একজন বিদেশী নাগরিককে ইনভেস্টমেন্ট একাউন্ট খুলতে প্রায় ১০০ পাতার কাছাকাছি পেপারওয়ার্ক করতে হয় আবেদন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। এছাড়া ব্যাংক একাউন্ট অনুমোদন পেতে হলে নির্দিস্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। বর্তমানে কিছু প্রাইভেট সুইস ব্যাংকে নতুন ইনভেস্টমেন্ট একাউন্ট খুলতে আড়াই লাখ ডলার বিনিয়োগ করতে হয়। তবে কিছু ব্যাংকে পঞ্চাশ হাজার ডলার হলেই একাউন্ট খোলার অনুমোদন পাওয়া যায়। তবে বিনিয়োগের এই পরিমান দেশভেদে ভিন্ন, যেমনঃ কানাডার কেউ সুইস ব্যাংকের ইনভেস্টমেন্ট একাউন্ট খুলতে হলে জমা রাখতে হবে দুই মিলিয়ন ডলার! 

ব্যক্তিগত একাউন্ট খোলার নিয়ম: এই একাউন্ট খোলার ক্ষেত্রেও পূর্বের মতো ব্যাংকের কোনো শাখায় ভিজিট করতে হবে। যারা সুইজারল্যান্ডে নতুন তারা উপরিউক্ত ডকুমেন্ট সহ নিজে উপস্থিত থেকে একাউন্ট খোলার আবেদন করবে। যারা সুইজারল্যান্ডের বাইরে থেকে ব্যাক্তিগত একাউন্ট খুলতে চায় তাদেরকে একাউন্ট খোলার প্রক্রিয়াটি মেইলের মাধ্যমে করার অনুরোধ জানাতে হবে। 

তারপর আপনাকে একজন ব্যাক্তিগত একাউন্ট ম্যানেজারের সাথে যুক্ত করে দেয়া হবে। কে আপনার ম্যানেজার এটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে পরবর্তী ট্রানজেকশনের জন্য। তাই ম্যানেজারের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য তার মেইল এড্রেস, ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে রাখতে হবে। ব্যক্তিগত একাউন্টয়ের রক্ষণাবেক্ষণ ফি বাবদ প্রতি মাসেই ১০-৩০ সুইস ফ্রা গুনতে হবে। এছাড়া ডেবিট, ক্রেডিট কার্ড থাকলে তার জন্যেও অতিরিক্ত ফি দিতে হবে। 

নাম্বারড একাউন্ট খোলার নিয়ম: আগেই বলেছি, গোপনীয়তা রক্ষা যদি একাউন্ট খোলার মূল কারণ হয় তাহলে নাম্বারড একাউন্ট খোলাই শ্রেয়। ব্যাংকের কিছু হাই অফিশিয়াল কর্মকর্তা ছাড়া এই একাউন্টগুলোর তথ্য আর কেউ জানে না। যদি কেউ নাম্বারড একাউন্ট খুলতে চায় তাকে সশরীরে উপস্থিত থাকতে হবে এবং উপরে উল্লিখিত ফর্মালিটিজগুলো শেষ করতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় কমপক্ষে এক লক্ষ ডলার ডিপোজিট করতে হবে। আর বছরে ৩০০ ডলার গুনতে হবে শুধুমাত্র একাউন্ট মেইনটেইনেন্সের জন্যে! 

আরও কিছু তথ্য: আপনি যদি চান আপনার অর্থের উৎস কেউ না জানুক, তাহলে এমন সুইস ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে হবে যার শাখা আপনার দেশে নেই। এছাড়া একাউন্ট ট্র্যাক ডাউন হওয়ার ভয় থাকলে ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, চেক এর সুবিধা নেয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে ট্রাভেলার্স চেকের মাধ্যমে একাউন্ট অপারেট করতে হবে।

তবে একটি সতর্ক বার্তা না দিলেই নয়। সুইস ব্যাংক যদি মনে করে আপনার অর্থের উৎসে ঝামেলা আছে এবং এই অর্থ ড্রাগের বিজন্যাস থেকে আসা তাহলে তারা একাউন্ট খোলার অনুমতি নাও দিতে পারে। ভারতে বিগত কিছু বছরে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমার হার অর্ধেক হয়ে গিয়েছে কেবল এই কারণেই।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা