বলিউড একজন ইরফানকে হারিয়েছে। কিন্ত সুতপা তো হারিয়েছেন তার সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে। সেই শোক তিনি কিভাবে সামলাচ্ছেন?

দুজনের পরিচয় হয়েছিল দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায়। ইরফান এসেছেন জয়পুর থেকে, সুতপা গিয়েছেন কলকাতার বাঙালি আবেশ গায়ে মেখে। গল্পের শুরুটাও সেই এনএসডি থেকেই। প্রথমে বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম, শেষে বিয়ে। ইরফান যখন একজন নোবডি ছিলেন, হাতে কাজ ছিল না, একটা রোলের জন্যে ঘুরছেন তীর্থের কাকের মতো- সেই দিনগুলোতে ইরফানের কাছে স্বস্তির নাম হয়ে তার পাশে ছিলেন সুতপা সিকদার। 

সুতপা ইরফানের হাত ধরে ছিলেন স্বামীর জীবনের শেষ দিনটিতেও। বলিউড একজন ইরফানকে হারিয়েছে, ভক্তরা প্রিয় অভিনেতাকে হারিয়েছে। কিন্ত সুতপা? তিনি তো হারিয়েছেন তার সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে, তার সন্তানদের বাবাকে। সেই শোক তিনি কি করে সামলাচ্ছেন? সেটাই সুতপা লিখেছেন ফেসবুকে, জানিয়েছেন তার মানসিক অবস্থা, ইরফানকে নিয়ে করা সেই স্মৃতিচারণ এগিয়ে চলোর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। 

অনেকে বলছে, আমি ভীষণ একা হয়ে গেলাম! একা? আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না, কত মানুষ আমাদের ভালোবাসা জানাচ্ছে, আমাকে নিয়ে, আমার বাচ্চাদের নিয়ে চিন্তা করছে, আমাদের ভালো থাকার জন্যে প্রার্থনা করছে এখন। এতগুলো মানুষের ভালোবাসার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কি একাকীত্ব অনুভব করা যায়? কতগুলো মানুষ ইরফানের চলে যাওয়াটাকে নিজেদের আপনজন কারো বিদায় হিসেবে ভাবছে, তাদের ভীড়ে আমি কি করে শোকের সাগরে ভাসি? 

ইরফান-সুতপা

আর হারিয়ে ফেলা? ইরফানকে তো আমরা হারাইনি। বরং পেয়েছি ওর কাছে, জীবনে চলার শিক্ষা, জীবনটা মনের মতো করে কাটানোর শিক্ষা। ইরফান আমাদের শিখিয়েছে, আমাকে, আমার বাচ্চাদের, বুঝিয়েছে হাতে ধরে। এখন পরীক্ষা দেয়ার পালা, আমরা কতটা কি শিখেছি। এটা তো একদিন করতেই হতো, তাই না? আজ অথবা কাল... এতে হারানোর কি আছে? 

আমাকে কয়েকজন বলেছে, পরিবারের পক্ষ থেকে তুমি একটা স্টেটমেন্ট দাও, সবাইকে জানাও। এটাকে কি ফ্যামেলি স্টেটমেন্ট বলা যায়? কী করে বলি, বলুন তো? যখন হাজার হাজার মেসেজে ভরে আছে আপনার ইনবক্স, একদম অচেনা-অজানা মানুষজন ফোন করে দুটো সেকেন্ড কথা বলতে চাইছে, জানাতে চাইছে তারা ইরফানকে কতটা ভালোবাসতো, ওর অভিনয়ের কত বড় ভক্ত ছিল, পুরো ঘটনাটা তাদেরকে কতটা কষ্ট দিচ্ছে, তারা আমাদের ব্যথার সমব্যথী হতে চাইছেন- এতসবের পরে এটা আর কিভাবে ফ্যামেলি স্টেটমেন্ট থাকে? 

পুরো জিনিসটা এখনও আমার কাছে অবিশ্বাস্য। এত জলদি সব কিছু হয়ে গেল! ইরফানের মতো করে যদি বলি, ইটস ম্যাজিক্যাল! ওকে আমি সবসময় বলতাম, তুমি আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছ। ও ছিল পারফেকশনের ভক্ত, সেরা জিনিসটা বের করে আনতে চাইতো সবসময়। আমার ভেতরেও ওই মানসিকতাটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল ইরফান, সবচেয়ে ভালো কাজটাই আমার করা চাই! 

ওর জীবনটা একটা ছন্দে চলতো, আমরাও তাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের জীবন ছিল মাস্টারক্লাস অভিনয়ের ভরপুর, কাজেই যখন ওর ক্যান্সার ধরা পড়লো, ইরফানের ভাষায় সেই বিনা দাওয়াতের মেহমানরা ওর শরীরে বাসা বাঁধলো- তখনও কোথাও ছন্দপতন হলো না। ডাক্তারের রিপোর্ট আমাদের জীবনের চিত্রনাট্য হয়ে গেল, সেটাকে 'পারফেক্ট' বানানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করে গেলাম আমরা। চিত্রনাট্যটা ভালো হতে হবে, অভিনয় খাসা হতে হবে, কোথাও কোন কমতি থাকা চলবে না। 

স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে ইরফান

গত দুই বছরের জার্নিতে অসাধারণ কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে আমাদের। সবার নাম নেয়া সম্ভব না এই অল্প সময়ে। নাম উল্লেখ না করেই আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি তাদের প্রতি, যারা পাশে ছিলেন আমাদের। যারা থাকতে পারেননি, তাদেরও ধন্যবাদ। এই কঠিন সময়টাতে আমি এক অন্য ইরফানকে আবিস্কার করেছি, দৃঢ়চেতা, নির্ভীক, সাহসের সঙ্গে সত্যের মুখোমুখি হওয়া অসাধারণ একজন মানুষ, আমাদের একসঙ্গে যাত্রার ৩৫ বছরে যে রূপটা আমি কখনও দেখিনি, দেখার দরকার হয়নি। হি ওয়াজ দ্য পিয়ানিস্ট অফ আওয়ার ফ্যামিলি, শেষ মুহূর্তেও নিজের কাজটা করে গেছে, বরং আমাদের সাহস দিয়ে গেছে, একজন ফ্যামিলিম্যানের জায়গা থেকে এর চেয়ে বেশি অবদান কেউ রাখতে পারে কিনা, আমার জানা নেই। ওর মতো মানুষকে বন্ধু হিসেবে, জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে আমই ভাগ্যবান। 

আমরা শুধু দম্পতি ছিলাম না, একসঙ্গে আমরা একটা দল ছিলাম, একটা জুটি ছিলাম, একটা গোটা জগত ছিলাম আমরা দুজনে। ও ছিল বিশাল একটা গাছের মতো, রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে যে আগলে রাখতো সবাইকে। বাবলি আর আয়ানকে (ইরফান-সুতপা দম্পতির সন্তান) ও নিজের হাতে গড়েছে, কোন ধরণের জোর-জবরদস্তি কিংবা স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ছাড়াই। ওদের ভালো-মন্দের সহজপাঠ দিয়েছে, নিজের জীবনবোধের আশ্চর্য্য দর্শনটা ওদের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে, সন্তানদের হাতে ধরে শিখিয়েছে, জীবনের শক্ত জমিনে কিভাবে টিকে থাকতে হবে। আমার বাচ্চা দুটো এখন আমাকে সাহস দেয়, ওরা বলে, বাবার কথামতো চলবে, বাবা যা শিখিয়েছেন, যা বলেছেন, সব ওরা মনে রাখবে। আমি এরচেয়ে বেশি আর কি চাইতে পারি জীবনের কাছে? 

নাইট ফ্লাওয়ার ইরফানের খুব প্রিয় ছিল। যেখানে ও গেছে, সেখানে নিশ্চয়ই পাওয়া যায় এটা। ওকে মনে রাখার জন্যে আমরা নতুন একটা নাইটফ্লাওয়ারের গাছ কিনব ভাবছি। আমাদের সুখ-দুঃখের অশ্রুজলে ভিজে গাছটা বড় হবে, ইরফান সেই ফুলের সুবাস হয়েই আমাদের মাঝে থাকবে চিরদিন। আড়াই বছর ধরে, কিংবা তারও আগে, অসম্ভব একটা জার্নি করেছে ও, ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়ে একটু বিরতি নিক মানুষটা। নাইটফ্লাওয়ারের মতো আমার সন্তানরাও একদিন ফুল হয়ে ফুটবে, সময় লাগবে জানি, কিন্ত আমি নিশ্চিত, যাদের শরীরে ইরফানের রক্ত আছে, যাদের মন আর মাথার ভেতরে ইরফানের দর্শন আর ভালো-মন্দের বোধ আছে, তারা অকালে ঝরে পড়বে না। 

সবাইকে ধন্যবাদ। ইরফান কখনও 'ফ্যান' শব্দটায় বিশ্বাস করতো না, আমিও করি না। আপনারা ফ্যান নন, আপনারা আমাদের ফ্যামিলি... 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা