আপনারা যারা জীবনে স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেন, লড়াই করতে ভুলে যান, হতাশ হয়ে যান, তারা জুনায়েদ, শ্যামল বা মিনারদের গল্পগুলো শুনতে পারেন। সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। অথচ এটাই তো আসল জীবনের গল্প...
জুনায়েদের সাথে আমার প্রথম দেখা ঢাকায়। অদম্য কয়েকজন মেধাবীদের গল্প শুনতে শুনতে সেদিন কেঁদেছিলাম। এর ঠিক একমাস পর সিলেট সফরে গিয়ে ওকে আসতে বলেছিলাম। আমার অনেক সহকর্মী তখন ওর গল্পটা শুনে আমার মতোই কাঁদেন। আজ আপনাদের ফের সেই গল্প শোনাই। মনে হবে সিনেমা।
জুনাইদ ছোটবেলায় বোধবুদ্ধি হওয়ার পর নিজেকে আবিষ্কার করেছিলো কক্সবাজারের ঝাউতলায়। কোথায় বাবা-মা কোথায় পরিবার কোন তথ্যই জানা নেই ওর। প্রকৃতিই বোধহয় ওকে বড় করেছিল। তাতে সারথী হন নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ সাহারা খাতুন। শুঁটকির আড়তে কাজ করতেন তিনি, শীতকালে পিঠা বেচতেন। জুনাইদ তার সাথে থাকতো। কিন্তু বয়স যখন পাঁচ-ছয়, তখন সাহারাও চিরবিদায় নিলেন। জুনায়েদ হারাল মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকুও। ফিরে গেল তাঁর পুরোনো ঠিকানায়—পথে।
সাহারা খাতুনকে নানি ডাকত জুনাইদ। তাঁর আশ্রয়ে থাকার সময় লাকড়ি জোগাড় করা, শুঁটকি শুকানোর মতো কাজ করেছিল সে। পথে নেমে শুরু করল কাগজ টোকাতে। ঘুমাত খোলা আকাশের নিচে—মাটিতে। কপাল খুব ভালো থাকলে কোনো ছাউনির নিচে—মেঝেতে। খাবার বলতে ছিল উচ্ছিষ্ট। বিশেষ করে সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে যাওয়া মানুষের ফেলে দেওয়া খাবার।
কয়েক বছর পরে টেকনাফে চলে যায় জুনায়েদ। এক জেলে পরিবারের সাথে শুরু করে সমুদ্রে মাছ ধরা। তবে মাছ ধরার কাজ না থাকলে পাহাড় থেকে লাকড়ি এনে দিতে হবে। বিনিময়ে থাকা-খাওয়া।
জুনায়েদ এরপর রাত জেগে নৌকা বেয়ে যায় সমুদ্রে, জাল পেতে মাছ ধরে। মাঝেমধ্যে পাহাড়ে যায়, লাকড়ি জোগাড় করে এনে হাটে বেচে টাকা বুঝিয়ে দেয়। আর সুযোগ পেলেই বাজারের চায়ের দোকানের বাঁশের বেড়ার ফুটোয় চোখ রাখে। সিনেমা দেখার বেজায় নেশা ধরে গেছে তত দিনে। আমির খানের থ্রি ইডিয়টস দেখে ফেলল জুনাইদ। শুরু হলো নতুন স্বপ্ন। কতো বাচ্চারা স্কুলে যায়। যদি তাদের মতো স্কুলে যেতে পারতো।
ইচ্ছের সলতেটা আরও উসকে দিয়ে গেল সমুদ্রের এক বন্ধু, যার নাম জুবায়ের। বয়সে সে জুনাইদের ছোটই ছিল, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে বিরতি নিয়েছিল। সমুদ্রে মাছ ধরতে যেত জুনাইদের মতোই। হঠাৎ একদিন সে বলল, আর মাছ ধরতে আসবে না, আবার স্কুলে যাবে। জুনাইদ বলল, ‘আমিও তো স্কুলে যাইতে চাই। তুই একটা ব্যবস্থা করবি আমার জন্য?’ জুবায়ের দিল জাহাঙ্গীর স্যারের ঠিকানা। বলল, ‘জাহাঙ্গীর স্যার ভালো মানুষ। তাঁর কাছে গিয়া বুঝায়া বললে ব্যবস্থা হবে।’
জাহাঙ্গীর স্যার ঠিকই ব্যবস্থা করলেন। যে ছেলের বর্ণপরিচয় নেই, তার ওপর আস্থা রাখলেন। নুরুল আমিন নামের আরেক ছাত্রের কাছে পাঠালেন জুনাইদকে। পরে অনেক কষ্টে জমানো ১০ টাকা দিয়ে কিনল ‘বাংলা শিক্ষা’ ও ‘মাই স্পেলিং বুক’। বই কেনার তারিখটাও ঠিক মনে রেখেছেন জুনাইদ—২০১১ সালের ৭ অক্টোবর! সে সময় রাত জেগে মাছ ধরতেন, সুযোগ পেলেই কুপির আলোতে নৌকায় খুলে বসতেন বই দুটি। দিনেও ঘুমাতেন না, বই খুলে বসতেন।
জুনাইদ বলছিলেন, ‘কেউ বিশ্বাস করে না, কিন্তু আমি ১০ দিনে দুটি বই-ই পড়ে শেষ করলাম। একশটার মতো ইংরেজি শব্দও শিখে ফেললাম। মাঝেমধ্যে জাহাঙ্গীর স্যার যেখানে প্রাইভেট পড়াতেন সেখানে যেতাম। পাশে দাঁড়িয়ে থেকেই ৪৫ ডিগ্রি কোণ আঁকাও শিখে ফেললাম। তারপর একদিন স্যারকে বললাম, স্যার, আমিও পরীক্ষা দেব। স্যার রাজি হলেন। প্রাইভেটের ওই পরীক্ষায় আমি দ্বিতীয় হলাম।’
জাহাঙ্গীর স্যার তখন জুনাইদকে স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু ওই জেলে পরিবার ভীষণ বেঁকে বসল। জুনাইদ নৌকায় একটা পড়ার টেবিলের মতো বানিয়ে নিয়েছিলেন, সেটাও লাথি মেরে পানিতে ফেলে দিল। বলল, ‘শখ কত!’ লোকে হাসাহাসি করতে লাগল। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করল, ‘পড়াশোনা করে তুই কী হবি?’ কিশোর জুনাইদ বলল, ‘ইঞ্জিনিয়ার হব।’
২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে মাছ ধরার কাজে বিরতি দিল জুনাইদ। কাঠমিস্ত্রির কাজ করে জোগাড় করল ১ হাজার ৬০০ টাকা। ওই টাকা, জাহাঙ্গীর স্যারের সুপারিশ আর বুকভরা সাহস নিয়ে সে গেল টেকনাফের মৌসুনী দ্বীপের ল্যাদা জুনিয়র হাইস্কুলে। অনেক অনুনয়ের পর, ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জুনাইদ এক লাফে ভর্তি হলো অষ্টম শ্রেণিতে। নিজের টাকায় বই, স্কুলের পোশাক কিনল। কিন্তু খেয়ে-পরে বাঁচতে তো হবে। তাই আবারও গেল মাছ ধরতে।
সারা রাত মাছ ধরে কোনোরকমে স্কুল ড্রেস পরে, বই-খাতা বগলদাবা করে ছুটে যেতে লাগল স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে। এই করে করেই জুনাইদ একদিন জেএসসি পরীক্ষায় পেলেন জিপিএ-৫! তারপর?
নবম শ্রেণিতে পা রাখার আগে ইটভাটায় কাজ নিল জুনাইদ। কাঠমিস্ত্রির কাজও করল। তিন হাজার টাকা জোগাড় হওয়ার পর গেল টেকনাফের হ্নীলা হাইস্কুলে। ভর্তি হল সেখানে। শিক্ষকরা স্কুলের বেতন, পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ফি—সবই দিয়ে দিলেন। এভাবেই এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৪.৮৩ পেল।
এরপর জুনাইদ ভর্তি হন উখিয়া ডিগ্রি কলেজে। কলেজে পড়ার টাকা জোগাড় করতে শুরু করলেন রাজমিস্ত্রির কাজ। ফলে ক্লাস শুরু হওয়ার এক মাস পর কলেজে যাওয়ার সুযোগ হলো। আবারও জায়গির থাকলেন। কলেজ বেতন মওকুফ করে দিল। টিউশন শুরু করলেন। নিজে কিন্তু কখনো কারও কাছে প্রাইভেট পড়েননি। তারপর একদিন বন্ধুদের মেসে উঠলেন জুনাইদ। থাকা-খাওয়া ফ্রি, শুধু বন্ধুদের পড়াশোনায় সহযোগিতা করতে হতো। তারপর ঘটলো জীবনের আরেক দুর্ঘটনা।
তারিখটা ঠিক মনে রেখেছেন জুনাইদ—২০১৭ সালের ৩০ মার্চ। দুদিন পর এইচএসসি পরীক্ষা। ঠিক করলেন, স্কুলের শিক্ষকদের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে আসবেন। উঠে বসলেন অটোরিকশায়। খানিক বাদেই ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন চার যাত্রীর দুজন। জুনাইদের অবস্থাও সাংঘাতিক। পেট ফুঁড়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেরিয়ে গেছে। চোখ আর মাথায় কঠিন আঘাত। শরীরের অধিকাংশ হাড়ই ভেঙে গেছে। বন্ধুরা ছুটে এলেন। অ্যাম্বুলেন্সে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়ার পথে চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিলেন, জুনাইদ আর নেই, হৃদ্যন্ত্র থেমে গেছে।
উখিয়ায় ফিরে আসছিল অ্যাম্বুলেন্সটি। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর জুনাইদের হৃৎপিণ্ড জানান দিল, এখনো থামিনি! মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরলেন জুনাইদ। কিন্তু ডাক্তাররা বললেন, ও আর দাঁড়াতে পারবে না। চোখে দেখতে পাবে না।
জুনায়েদ আমাদের বলেছিলো, আমি যে কোন মূল্যে বাঁচতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস যদি শুধু মস্তিষ্ক ঠিক থাকায় বেঁচে থাকতে পারেন, আমিও পারবো। আসলেই পেরেছিল।
এক বছর চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতাল ও কুতুপালংয়ের এক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে থাকার পর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলো। জুনাইদের ভাষায়, ‘অবিশ্বাস্যভাবে ফিরে এসেছি আমি। হয়তো আমার স্বপ্ন পূরণের জন্যই ওপরওয়ালা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।’
এক বছর পর, ২০১৮ সালে আবার এইচএসসি পরীক্ষা দিতে বসেন জুনাইদ। অসুস্থ শরীরে ইট ভেঙে খাবার জোগাড় করে, ভাঙা পা ড্রেসিং করে পরীক্ষা দেন। এইচএসসিতে পেলেন জিপিএ-৪.৫০। বন্ধুবান্ধব, শিক্ষকদের সহযোগিতায় ভর্তি পরীক্ষা দিল কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সুযোগ পেয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু শেষমেশ বেছে নিয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিষয়টি। কারণ তাকে প্রকৌশলী হতে হবে।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারে প্রথম হয়েছে জুনাইদ। আমাকে জুনায়েদ বলেছিল, ভাই আমি বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমাই না। কোন মানুষের কষ্ট দেখলে আমার কান্না লাগে। আমার স্বপ্ন পৃথিবীর প্রতিটা শিশু স্কুলে যাবে। আদর পাবে। আমি যদি গোটা দুনিয়ার প্রেসিডেন্টও হই আমি বালিশে ঘুমাবো না যতোক্ষণ পর্যন্ত না দুনিয়ার সব শিশুকে স্কুলে আনতে পারবো।
আপনারা যারা জীবনে স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেন, লড়াই করতে ভুলে যান, হতাশ হয়ে যান, তারা জুনায়েদ, শ্যামল বা মিনারদের গল্পগুলো শুনতে পারেন। সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। অথচ এটাই তো আসল জীবনের গল্প।
এমন হাজারো গল্প আছে বলেই মানুষ বেঁচে থাকে। এমন হাজারো গল্প আছে বলেই রোজ সকালে সূর্য উঠে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন