সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সাবধান ইন্ডিয়া থেকে সুশান্তকে বের করে দেয়া হয়েছে আচমকাই, তার 'অপরাধ', সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করে তিনি মুম্বাইয়ের গণ জমায়েতে যোগ দিয়েছেন, ছবি পোস্ট করেছেন সোশ্যাল মিডিয়াতে।
সুশান্ত সিংকে আপনারা অনেকেই চিনে থাকবেন। বলিউডি নায়ক সুশান্ত সিং রাজপুতের কথা বলছি না। এই সুশান্ত সিংও অভিনেতা, তাকে আপনারা দেখেছেনও। প্রচুর সিনেমা আর সিরিয়ালে অভিনয় করলেও, তিনি বিখ্যাত হয়েছেন মূলত 'সাবধান ইন্ডিয়া' নামের একটা টিভি সিরিজ উপস্থাপনা করে। তার গম্ভীর কণ্ঠ সেই সচেতনতামূলক টিভি সিরিজটাকে অন্যরকম একটা মাত্রা দিয়েছিল। সেই সাবধান ইন্ডিয়া থেকে সুশান্তকে বের করে দেয়া হয়েছে আচমকাই, তার 'অপরাধ', সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করে তিনি মুম্বাইয়ের গণ জমায়েতে যোগ দিয়েছেন, ছবি পোস্ট করেছেন সোশ্যাল মিডিয়াতে।
নাগরিকত্ব বিলের সংশোধন আইন নিয়ে পুরো ভারত এখন উত্তাল। তরুণ-তরুণী থেকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই এখন দাঁড়িয়ে আছেন একই মিছিলে। সেই মিছিল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে একটাই মূলমন্ত্র- অখণ্ড ভারত! নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের নামে বিজেপি সরকার যেভাবে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করতে চাইছে, সেটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে লাখো-কোটি মানুষ।
সেই গণমিছিলে ছাত্র আছে, আছে উদ্বাস্তু ভিক্ষুক। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা যেমন রাস্তায় নেমেছেন, তেমনই আছেন একদম ছাপোষা মানুষ, এমনকি গৃহিণীরাও। সরকারী চাকুরিজীবীরা যেমন এই আইনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করছেন, তেমনই আবার ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে, সেশন জটে পড়ার শঙ্কা মাথায় নিয়ে রাস্তা অবরোধ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা।
সেই মিছিলে যুক্ত হয়েছেন বলিউড সেলিব্রেটিদের অনেকেও, তারকাখ্যাতির ভীড়ে যারা নিজেদের নাগরিক দায়িত্ব ভুলে যাননি। সুশান্ত সিং তাদেরই একজন। দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি হামলাটা তাকে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা দিয়েছিল। আর সেজন্যেই তিনি সাধারণের কাতারে নেমে এসেছেন, দাঁড়িয়েছেন রাজপথে। মুম্বাইয়ের হাজার হাজার মানুষের মতো অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন, দেশকে বিভক্ত করার এই আইন যাতে বাতিল করা হয়।
দিল্লি কিংবা উত্তরপ্রদেশে যারা সিটিজেনশীপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিলের বিরোধিতা করেছেন, তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে পুলিশ, টিয়ার গ্যাস আর গুলি চলেছে, আহত-নিহত হয়েছে মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকে ছাত্রদের পিটিয়েছে পুলিশ, হিজাব পরিহিত তরুণীদের উদ্দেশ্য করে বলেছে পাকিস্তান চলে যেতে। সুশান্ত সিংয়ের পিঠে তো আর লাঠির বাড়ি দেয়া যাবে না, তাই তার শাস্তিটা হয়েছে অন্যরকম। হাতে না মেরে ভাতে মারার কাজটা করা হয়েছে তার বেলায়, সুশান্তের কাজটাই নেয়া হয়েছে ছিনিয়ে।
টুইটারে সুশান্ত যখন খবরটা জানিয়েছিলেন, তখন অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি। কেউ কেউ তো কমেন্টও করেছে- আন্দোলনে যোগ দেয়ার 'পুরস্কার' কীনা এটা? সুশান্ত সরাসরি কোন জবাব দেননি, বরং আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন সাবধান ইন্ডিয়ার সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠান স্টার ভারতকে। বলেছেন, 'দুটোকে একত্রে মেলানোর কোন দরকার নেই। চ্যানেল ভেবেছে, উপস্থাপক ছাড়াই নতুন ফরম্যাটে অনুষ্ঠানটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, ওদের জন্যে শুভকামনা।'
স্টার ভারতের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, আন্দোলনে সুশান্তের যোগ দেয়ার সঙ্গে সাবধান ইন্ডিয়া থেকে তাকে বাদ দেয়ার কোন সম্পর্ক নেই। চ্যানেল নাকি অনেক আগেই ভেবে রেখেছিল, নতুন বছরে নতুন ফরম্যাটে শো'টাকে এগিয়ে নেয়া হবে। জানুয়ারির ১৫ তারিখ পর্যন্ত সুশান্তের সঙ্গে চুক্তি ছিল তাদের, সেই চুক্তি নবায়ন করা হয়নি- এটাই নাকী আসল ঘটনা। কিন্ত সময় আর ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে কারোরই অসুবিধা হবার কথা নয়, হচ্ছেও না।
নিজের দায়িত্ব ভেবেই এই আইনের প্রতিবাদ করছেন সুশান্ত, তার কাছে ভারত মানে বহু জাতি, বহু ধর্ম আর বহু ভাষার মিলনস্থল, একটা নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি সরকারের এই ক্ষোভ দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকেই শুধু ঠেলে দেবে, কোন কল্যান সাধিত হবে না এতে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবার আছে, যারা এই আইনের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন না, তাদেরকেও বিন্দুমাত্র অসম্মান করতে চাননি তিনি, বলেছেন-
'অন্য কারও দায়িত্ব তো আমি নিতে পারব না, কিন্তু আমার নিজের কথা বলার সাহস আছে আর সেটা আমি বলবই। এমনও নয় যে কেউ কিছু বলছে না, রিচা চড্ডা, তাপসী পান্নু, জীশান আয়ুবের মতো মানুষজন বলছেন। যাদের অন্যায় মনে হয়েছে তারা বলছেন, যাদের মনে হচ্ছে না তারা চুপ করে আছেন। এটা তাদের বিষয়, আমাদের সেটার সম্মান করা উচিৎ।'
ভারতে এখন ভিন্নমতের দমনটা খুব বেশি করে চোখে পড়ছে। কট্টরপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে, দ্বিমত পোষণ করলেই তাকে অ্যান্টি ন্যাশনাল বা পাকিস্তান পন্থী ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদের সেময়টায় সেটা যেন আরও প্রকট হয়ে উঠলো। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় গ্রেফতার করা হয়েছে ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ'র মতো সজ্জন একটা মানুষকে, যার লেখা ইতিহাসের বই স্কুল কলেজে পড়ে পরীক্ষা দিচ্ছে কোটি কোটি ভারতীয় কিশোর। কানহাইয়া কুমার থেকে জাভেদ আখতার- কাকে টার্গেট করেনি বিজেপি আর তাদের আইটি সেল? সেই তালিকায় সুশান্ত সিংয়ের নামটা কেবল নবতম সংযোজন। সিস্টেমের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়ালে 'শাস্তি' তো পেতেই হবে, তবে অখণ্ড ভারতের স্বার্থে সেই শাস্তিটা মাথা পেতে নিতে রাজী আছেন সুশান্ত সিং।