সিনেমা আর বাস্তবে মিল খোঁজাটা বোকামি। সিনেমার চরিত্রের সাথে ব্যক্তি অভিনেতাকে মিলিয়ে ফেললে কখনোই সে ব্যক্তির মন পড়া যাবে না। সবাই বলছে ছিছোরে সিনেমার সে আন্নি যে কীনা তার আত্মহত্যাপ্রবণ ছেলেকে বাঁচানোর জন্য পুরনো বন্ধুদের জড়ো করে লাইফ লেসন শিখিয়েছিল সে কীভাবে নিজের ব্যক্তিজীবনে হার মেনে নিলো। কারণটা সহজ, আন্নি আর সুশান্ত এক ব্যক্তি নন।
এই তুলনা এনে ব্যক্তি সুশান্তকে ছোট করার দরকার নেই। প্লিজ, সুশান্তকে জাজ না করি আমরা। সুশান্তের মানসিক অশান্তি কিংবা ডিপ্রেশন সম্পর্কে আমরা কেউই অবগত নই। সুতরাং কোন উপসংহার টানাটা ঠিক হবে না। তার চেয়ে বরং সুশান্তের কাজ নিয়ে আলোচনা করা যাক। যে কাজ দিয়ে সে এতো মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিল, যে ভালোবাসা যথেষ্ট হল না তাকে বাঁচানোর জন্য।
সুশান্তের সাথে আমার প্রথম দেখা স্টার প্লাসের সিরিয়াল কিস দেশ মে হ্যা মেরা দিল দিয়ে। ২০০৭-০৮ এর দিকে হবে হয়তো। সে সিরিয়ালের প্রধান চরিত্র ছিল না সে, মূল নায়কের ছোট ভাই ছিল। কিন্তু তার অভিনয় দক্ষতা আর প্রমাণ করার তেষ্টা দিয়ে সে খুব দ্রুতই জনপ্রিয়তা পেয়ে যাচ্ছিল। একতা কাপুরের নজর এড়ায়নি ছেলেটি। সুযোগ পেয়ে যায় লিড হিসেবেই নতুন একটি সিরিয়ালে কাজ করার। তখন একতা কাপুরের সিরিয়ালযুগের একেবারে শেষভাগ।
সিরিয়াল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অনেকেই। ওকে দেখার জন্যই পবিত্র রিশতা দেখা শুরু করা। অঙ্কিতার সাথে জুটিটাও দারুণ মানাচ্ছিল। সেখান থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি তাকে। টেলিভিশনে ভালোই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সুশান্ত। কিন্তু তখনো জানতাম না যে সুশান্ত আসলে এরকমভাবে স্বপ্নটা দেখে নি। সে চেয়েছিল সিনেমাতে আসতে, প্রথম সারির অভিনেতা হতে। এই কারণেই পড়াশুনা মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছিল।
ব্যারি জনের এক্টিং একাডেমিতে ভর্তি হয়েছিল, শামাক দাভারের ড্যান্স একাডেমিতে ড্যান্সও শিখেছিল। চোখে একটাই স্বপ্ন বলিউডের সিনেমার নায়ক হওয়া। সেখান থেকে টিভিতে এসে সে শুধু ঝালাই করে নিচ্ছিল নিজেকে। বিভিন্ন ড্যান্স রিয়ালিটি শোতে অংশ নেয়া শুরু করলো। তারপর অভিষেক কাপুরের চোখে পড়লো সুশান্ত। চেতন ভগতের উপন্যাস থ্রি মিসটেকস অফ মাই লাইফ অবলম্বনে একটি সিনেমা বানাতে চাচ্ছিলেন তিনি।
প্রধান ৩ চরিত্রে রাজকুমার রাও, অমিত সাধের পাশাপাশি সুশান্তকে ফাইনাল করলেন তিনি। সিনেমা মুক্তি পেলো, ইশান চরিত্রে সুশান্ত যেন নিজের সর্বস্ব ঢেলে দিলো। তিনজন প্রধান চরিত্রের মাঝে আলাদা করে চোখে পড়তে হলে বাড়তি কিছু করতেই হতো, সুশান্ত বাড়তি সবকিছুই করেছে। ক্রিকেটের সাথে আগে থেকেই ভালোবাসা ছিল, চরিত্রের প্রয়োজনে আরও ঝালিয়ে নিয়েছে। রাজকুমার আর অমিতের মতো দারুণ অভিনেতার সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছে।
আত্মবিশ্বাস যেন ঠিকরে পড়ছিল ইশান চরিত্রটির মধ্য দিয়ে। বলিউডেরও চোখে পড়লো। একের পর এক দারুণ রোল বাগিয়ে নেয়া শুরু করলো। ইয়াশ রাজ ফিল্মসের শুদ্ধ দেশি রোমান্সে চুক্তিবদ্ধ হল সুশান্ত, ওদিকে রাজকুমার হিরানির সিনেমায় সাপোর্টিং হলেও বেশ ভালো রোল পেয়ে গেল। অভিনয়ের দিক থেকে নতুনদের মধ্যে তাকেই যেন সবচেয়ে প্রমিসিং মনে হল।
দিবাকর ব্যানার্জির ব্যোমকেশ বকশি সিনেমার প্রস্তাব পেয়ে অসাধারণ সাহস দেখিয়ে জটিল এই চরিত্রটির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা শুরু করলো। বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়লেও যারা দেখেছেন সবাই জানেন থিয়েটারের ঝানু অভিনেতা নীরাজ কবির সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন সুশান্ত এই সিনেমায়। এরপরই আসে সুশান্তের জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় মোড়। ভারতের ক্রিকেট লেজেন্ড মহেন্দ্র সিং ধোনির বায়োপিকে তাকে চূড়ান্ত করা হয়। সুশান্ত দুই বছরের জন্য তার অন্য সব কাজ ছেড়ে দিলো শুধু এই চরিত্রের প্রস্তুতি নিতে।
কারণ সে জানতো বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের চরিত্র করতে হলে তাকে ধোনি হয়ে দেখাতে হবে। ধোনিকে ছায়ার মতো অনুসরণ করা শুরু করলো সে, ধোনির হেলিকপ্টার শট, ধোনির ম্যানারিজম দিনের পর দিন প্র্যাকটিস করে আত্মস্থ করে নিলো। ধোনির রাঁচির একসেন্ট, ধোনির চুল সবকিছুকে সে আপন করে নিলো।
সিনেমা মুক্তি পেলো, সবাই অবাক হয়ে গেল যে চেহারা না মিললেও বাকি সবদিক দিয়ে ধোনিকে ইঞ্চি টু ইঞ্চি কপি করে পর্দায় তুলে এনেছেন সুশান্ত। বক্স অফিসে তুফান উঠিয়ে দিলো সিনেমাটি। যদিও ধোনিকেই এই সাফল্যের বড় অংশীদার বলতে হবে কিন্তু একজন দর্শকও পাওয়া যাবে না যে কীনা সুশান্তের ধোনি হয়ে যাওয়ার প্রশংসা করতে ইতস্তত বোধ করবে। সুশান্ত ভেবেছিল এখান থেকেই হয়তো তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন পূরণ হওয়া শুরু হবে।
সে এ লিস্ট অভিনেতাদের মধ্যে ধীরে ধীরে চলে আসবে, নতুনদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অভিনেতা মানা শুরু হবে তাকে যার বক্স অফিস সাকসেসও আছে। কিন্তু এমনটা আর হল না। এতো সাফল্য, এতো ভালো অভিনেতা হবার পরেও কখনো সুশান্ত যেন লাইমলাইট পান নি। বলিউড পার্টি হোক, নেপোটিজম হোক, স্ট্রাগলিং অভিনেতাদের কথা হোক কোথাওই সুশান্তের কথা কেউ আলোচনায় আনতো না। না ভরুন-টাইগারদের নিয়ে কথা বলার সময় তার কথা উঠতো, না ই বা আয়ুষ্মান-ভিকিদের প্রশংসার সময় তাকে কেউ ডাকতো।
করনের শোতেও তার ডাক পড়তো না, অভিনেত্রীদের মধ্যে কৃতির সাথে সম্পর্কের গুঞ্জন উঠলেও তাদের রাবতা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ায় ডানা মেলতে পারলো না। কিন্তু সুশান্ত হার মেনে নেন নি। তিনি চেষ্টা করে গিয়েছিলেন বক্স অফিস, অভিনয় সবকিছুকে এক সুতোয় গেঁথে রাখতে। তার হাতে ধর্মা প্রোডাকশনের ড্রাইভ সিনেমাটি ছিল যেটাকে ধর্মা ধুম-এর মতো ফ্রাঞ্চাইজ বানাতে চেয়েছিল কিন্তু সুশান্ত আর জ্যাকুলিনের পরপর ফ্লপের কারণে ধর্মা থেকেও একপ্রকার আউটকাস্ট হয়ে গিয়েছিল সিনেমাটি।
কেদারনাথে সবটুকু লাইমলাইট নিয়ে গেল স্টারকিড সারা আলি খান। হাতে ছিল অভিষেক চৌবের সোনচিড়িয়া যার আগের সিনেমাগুলো সমালোচকদের ভীষণ প্রিয় তো ছিলই, বক্স অফিসেও সফল ছিল। সে সিনেমাটিও বক্স অফিসে ডিজ্যাস্টার হয়ে গেল। সমালোচকরা এখন যেমন প্রশংসা করে তেমন প্রশংসা সিনেমা মুক্তির সময় করেন নি কেন তারাই জানেন। ফল্ট ইন আওয়ার স্টারসের মতো জনপ্রিয় ইংলিশ সিনেমার রিমেকে তার অন্তর্ভুক্তি দেখে মনে হয়েছিল এবার একটা সফল সিনেমায় তাকে দেখা যাবে।
কিন্তু মি ঠু ইস্যু আরও বিভিন্ন কারণে সে সিনেমাও আটকা পড়ে গেল। শেষমেশ ছিছোরে যখন এলো এবং বক্স অফিসে দারুণ ব্যবসা করল তখনো যখন কেউ সুশান্তের কথা বলল না তখন সুশান্তের হতাশ না হবার কোন কারণ নেই আসলে। এরপর নেটফ্লিক্সে ড্রাইভ কোনরকমে বেচে দিলো ধর্মা, ওটিটিতে আসা মানেই অভিনেতার মার্কেট ভ্যালু কমে যাওয়া তার ওপর জঘন্য গ্রাফিক্স আর নেগেটিভ রিভিউ মিলিয়ে ড্রাইভের সাথে নিজের নামই উচ্চারণ করতে চাইতেন না যেন সুশান্ত।
ফল্ট ইন আওয়ার স্টারসের রিমেকও ওটিটিতে বিক্রি করে দেয়া প্রায় চূড়ান্ত। সবমিলিয়ে প্রফেশনাল লাইফে সুশান্ত বেশ ঝামেলার মধ্যেই ছিলেন। সফলতা বারবার তার কাছে ধরা দিলেও কোন এক অদ্ভুত কারণে তাকে আলাদা করে কেউ সফল বলতো না। স্টারকিডরা যেভাবে রেডিমেড লঞ্চপ্যাড পেয়ে ইনস্টাতে কয়েক মিলিয়ন ফলোয়ার একত্র করে ফেলেন সেখানে সুশান্তের ফলোয়ার ১০ মিলিয়ন ছাড়ালো তার মৃত্যুর পর।
অথচ সুশান্ত অনেক দূরে যেতে চেয়েছিলেন, দূরে যাবার জন্য সবকিছু করেছিলেনও। পড়াশুনা ছেড়ে দেয়া নিয়ে তার মাঝে কোন আফসোস ছিল না, নিজের গোছালো মনে গুছিয়ে নিয়েছিলেন জীবনে কী চান আর কতটুকু এগুতে চান। ইন্টারভিউগুলোতে তার ফিলোসফি অবাক করতো, এতো গুছিয়ে কেউ চিন্তা করতে পারে।
যে ছেলেটা ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্সার হিসেবে নায়কদের পেছনে নাচতো একসময়, টেলিভিশন সিরিয়ালে সেকেন্ড লিড ছিল সে নিজের সততা ও ট্যালেন্ট দিয়ে সফলতার শিখরে পৌঁছাতে চেয়েছিল। যে সফলতার স্বাদ সে পেয়েছিলও বেশ কয়েকবার কিন্তু কফি উইথ করন আর অনন্যাদের স্ট্রাগলের যুগে সুশান্তের মতো অভিনেতারা কতোটুকুই বা লাইমলাইট পান!
নিয়মিত প্রমাণ করে যেতে হয় সুশান্তের মতো অভিনেতাদের, সফল হলেও কৃতিত্ব দিয়ে দিতে হয় অন্য কাউকে। ডিপ্রেশন আসলে অনেকগুলো দুঃখ ও বিষণ্ণতার সমষ্টি। হতেও পারে এগুলোর ইমপ্যাক্ট ছিল সুশান্তের ডিপ্রেশনে, হতেও পারে তার ব্যক্তিগত জীবনে সে অসুখী ছিল কিছু নিয়ে, হতে পারে কিছুদিন আগে তার ম্যানেজার মেয়েটির আত্মহত্যা তার মনে প্রভাব ফেলেছিল, হতে পারে তার শেষ ইনস্টাগ্রাম পোস্টে প্রয়াত মা’কে স্মরণ করাটা তার একাকীত্বের প্রমাণ ছিল।
মানুষ মৃত্যুর যত কাছাকাছি যায় তত বেশি হয়তো মাকে স্মরণ করে। ইরফানও তার শেষ সময়ে বলেছিল মা আমি তোমার কাছে আসছি, সুশান্তও তার প্রয়াত মায়ের ছবির সাথে নিজের ছবি জুড়ে পোস্ট করলেন ৩ জুন। মানুষের মেন্টাল হেলথ নিয়ে আমরা যত বলি যে সোচ্চার হতে হবে, দেখা যায় আমার পাশের মানুষটিকেই আমি ঠিকমতো সময় দিতে পারছি না। মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করুন, প্রিয় মানুষকে একাকীত্ব যেন আঁকড়ে না ধরে খোঁজ রাখুন, নাহলে বড্ড দেরি হয়ে যায়।
আরও পড়ুন-