ধোনিকে তিনি বলতেন নিজের বড় ভাই, আইডল। অথচ সুশান্তের শেষটা ধোনির মতো হলো না। শূন্য থেকে শিখরে ওঠা, ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় পুরো ভারতে সপ্তম হবার পরও লেখাপড়া ছেড়ে অভিনয়ে আসা তরুণ জীবনের বাইশ গজ ছাড়লেন খুব জলদি...

ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি সিনেমার দুটো দৃশ্য আমার খুব পছন্দের। দুটোই রেলস্টেশনে। ধোনিরূপী সুশান্ত তখন খড়গপুর স্টেশনের টিকেট কালেক্টর। যার ধ্যানজ্ঞান ক্রিকেট, মাথার মধ্যে জাতীয় দলে সুযোগ পাবার চিন্তা, সেই লোক দিনমান বসে বসে স্টেশনের গেটে টিকেট কালেক্ট করে, টিকেট ছাড়া যেসব যাত্রী পাওয়া যায়, তাদের জরিমানা করে। সুশান্ত শুধু যে নিজের ডিউটি পালন করছে তাই নয়, সে রুমমেটদের ডিউটিও করে দেয়, কারণ ঘরে বসে থাকার চেয়ে স্টেশনে বসে থাকতেই তার কাছে ভালো লাগে। জীবনের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা জন্ম নিয়েছিল সেই চরিত্রটার। 

বিরক্তি আর হতাশায় ডুবে থাকা এক বৃষ্টির দিনে সিনিয়র এক বস সুশান্তকে বোঝালেন, এটাই জীবন। এখানে প্রতিটা বল সমানভাবে আসবে না। কখনও ফুলটস হবে, আপনি লফটেড শট খেলবেন। কখনও আবার ইয়র্কার আসবে, আপনি ডিফেন্স করবেন। জীবন আপনাকে ঘাড় বরাবর বাউন্সার ছুঁড়ে দেব, ডাক করা ছাড়া উপায় থাকবে না আপনার সামনে- এটাই জীবনের ধর্ম। টিকে থাকতে হবে, বাজে বল পেলে কাজে লাগাতে হবে, সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। আর যতোক্ষণ সুযোগটা না আসছে, মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে উইকেটে। 

আরেকটা প্রিয় দৃশ্য, সুশান্ত বসে আছেন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অবস্থায়। হুট করে হুইসেল বাজিয়ে একটা ট্রেন এসে দাঁড়ালো তার সামনে, আচমকা সেটার দরজাও খুলে গেল। তিনি ইতিউতি চাইলেন, খানিকটা কনফিউজড তিনি তখনও। কানে বাজছে অদ্ভুত এক চিৎকার- ধোনি! ধোনি! ট্রেন চলতে শুরু করে দিয়েছে আবার, সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে তিনি ট্রেনে চড়ে বসলেন। গন্তব্য অজানা। শুধু জানেন, যেখানে তিনি পড়ে আছেন, সেটা তার গন্তব্য নয়, এখান থেকে পালাতে হবে, মুভ অন করতে হবে। 

ধোনি রূপী সুশান্ত

মেলোড্রামাটিক একটা দৃশ্য, সন্দেহ নেই। বাস্তবে এমন কিছুই ঘটেনি, মহেন্দ্র সিং ধোনি ভেবেচিন্তেই খড়গপুরের চাকরিটা ছেড়েছিলেন। স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় ফিরেছিলেন ঘরে, তার সামনে আচমকা কোন ট্রেন এসে দাঁড়ায়নি। তবুও সিনেমায় এই কাল্পনিক দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগে। সুশান্তের সেই বিহ্বল অবস্থা ঝেড়ে ফেলে দৌড়ে ট্রেনে ওঠাটা দেখতে ভালো লাগে। মিথ্যে জেনেও কল্পনা করতে ভালো লাগে যে, সেদিন ওই ট্রেনে উঠে না বসলে দশ বছর পর ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ শিরোপাটা উঁচিয়ে ধরা হতো না ধোনির। সময়, সুযোগ- এগুলো হাতে এসে ধরা দেয় না, খুঁজে নিতে হয়। বুঝে নিতে হয় যে এটাই সঠিক সময়, এখনই পা ফেলতে হবে সামনের দিকে, ঝুঁকি নিতে হবে। 

সুশান্ত কেন আত্মহত্যা করলেন, পেছনের রহস্যটা কি, এটা হত্যা না আত্মহত্যা- শত শত প্রশ্ন এখন উঠবে। কয়েকদিন আগেই তার সাবেক এক ম্যানেজার আত্মহত্যা করেছেন, আজ সুশান্ত মারা গেলেন, দুটোর যোগসূত্রও খোঁজা হবে নিশ্চয়ই। ধোনির বায়োপিকে অভিনয় করার সময় ভারতীয় অধিনায়কের সঙ্গে খুব খাতির হয়েছিল সুশান্তের। ধোনিকে তিনি নিজের বড়ভাইয়ের মতোই জানতেন। ধোনির চরিত্রের ভেতর ঢোকার জন্য দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তিনি ধোনির সঙ্গে কাটিয়েছেন, তাদের পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিলেন প্রায়। এমনও হয়েছে, ধোনি হয়তো সিরিজ খেলছেন, সুশান্ত সেখানে হাজির হয়ে গেছেন, গ্যালারিতে ধোনির মেয়ে জিভা'র সঙ্গে খুনসুটি করছেন! 

পর্দায় ধোনির চরিত্রটাকে নিঁখুতভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সুশান্ত। ধোনিকে তিনি বলতেন নিজের আইডল। কিন্ত নিজের জীবনের গল্প লেখার সময় আইডলের উল্টোপথেই হাঁটলেন মানুষটা। ধোনিকে কখনও লড়াইয়ের মাঝখানে হাল ছাড়তে দেখিনি। অজস্রবার সবার সব পরিকল্পনাকে ভণ্ডুল করে দিয়ে তিনি জয় ছিনিয়ে এনেছেন। বাকীরা যখন হতাশায় মুষড়ে পড়েছেন, রণে ভঙ্গ দিয়েছেন, তখন ধোনি লড়েছেন, কখনও ব্যাট দিয়ে, কখনও মাথা দিয়ে। ২০১৬ টি২০ বিশ্বকাপে তিন বলে দুই রানের জলবৎ-তরলং সমীকরণটা বাংলাদেশ মেলাতে পারেনি শুধু ধোনির কারণে। সুশান্ত তার আইডল ধোনিকে এই জায়গাটায় অনুসরণ করতে পারলেন না।

এত জলদি সবাইকে বিদায় বলবেন, এটা ভাবতে পারেনি কেউ

অথচ সুশান্ত ভীষণ লড়াকু ছিলেন। সতেরো বছর আগে মাকে হারিয়েছিলেন, মায়ের ভালোবাসা ছাড়াই কাটিয়েছেন দেড়টা যুগ। দিল্লি কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অ্যাডমিশন টেস্টে সপ্তম হয়েছিলেন গোটা ভারতে। পদার্থবিজ্ঞানের অলিম্পিয়াডে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। হতেই পারতেন মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার, উচ্চপদস্থ চাকুরে। কিন্তু তার পরিবর্তে সুশান্ত সিংহ রাজপুত বেছে নিয়েছিলেন রুপোলি দুনিয়াকেই। ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্সার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু, নিজের গরজে নাচ শিখেছেন, থিয়েটারে ভর্তি হয়েছেন। সুশান্ত জানতেন, মন দিয়ে যেটাই ধরবেন, সেখানেই বাজীমাত করবেন তিনি। 

অল্প সময়ের ক্যারিয়ার, এরমধ্যেই মনে রাখার মতো কিছু চরিত্র করে ফেলেছিলেন। কাই পো ছে দিয়ে আগমন, পিকে'র সরফরাজ দিয়ে আমাদের আপন হলেন। বাঙালির প্রিয় চরিত্র ডিটেক্টিভ ব্যোমকেশ বক্সী হিসেবেও দুর্দান্ত করলেন, দিবাকর ব্যানার্জীর পরিচালনায় হিন্দিভাষী এই ব্যোমকেশকে নিয়ে অভিযোগ ছিল না কারোরই। অল্প সময়েই কাই পো ছে, ধোনি, ব্যোমকেশ, কেদারনাথ, সোনচিড়িয়া বা ছিঁছোড়ের মতো সিনেমা যার ক্যারিয়ারে যুক্ত হয়েছে, তার এমন বিদায় মেনে নিতে কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। 

মানুষটা আর দশজনের মতো ছিলেন না। বলিউডি লেট নাইট পার্টি কালচারে সুশান্ত ব্যতিক্রম ছিলেন খানিকটা। তারা দেখতে ভালোবাসতেন, অ্যাস্ট্রোনমি নিয়ে আগ্রহ ছিল প্রচণ্ড। একটু খেয়ালি প্রকৃতির ছিলেন, দুম করে একবার নিজের ইন্সটাগ্রাম একাউন্টের সব ছবি ডিলিট করে দিয়েছিলেন। গত কয়েক মাস ধরেই ভুগছিলেন অবসাদে, মনোবিদের সাহায্য নিচ্ছিলেন। এই অবসাদই হয়তো তাকে ঠেলে দিল মৃত্যুর দিকে। যে তারাদের দেখে সুশান্তের রাত কাটতো, সেই তারা হয়েই মিলিয়ে গেলেন তিনি। নিজের প্রতিটা সিনেমায় তুমুল পজিটিভিটির প্রচারণা চালিয়ে গিয়েছেন যিনি, তিনি এভাবে বিদায় নেবেন, কেইবা ভাবতে পেরেছিল?

দিস ইজ নট ফেয়ার সুশান্ত!

ফলাফল নয়, আমাদের চেষ্টাগুলোই ঠিক করে দেয় জীবনে কে সফল, কে ব্যর্থ- ‘ছিছোড়ে’ ছবিতে অনিরুদ্ধ পাঠক রূপী সুশান্ত বলেছিলেন তার ছেলেকে। সিনেমায় আত্মহত্যার বিরুদ্ধে যুক্তি দেয়া সেই মানুষটাই বাস্তব জীবনে বেছে নিলেন আত্মহননের পথ। ব্যবধান রয়েই গেল জীবন আর পর্দার চিত্রনাট্যের মাঝে। সুশান্ত চোখে আঙুল দিয়ে জানান দিলেন, জীবনটা সিনেমা নয়, এখানে মিরাকল ঘটে না, মেলোড্রামার কোন জায়গা নেই এখানে। আবহসঙ্গীতের সঙ্গে একেকটা ইন্সপিরেশনাল ডায়লগ শুনে যতোটা তৃপ্তি পাওয়া যায় সিনেমায়, সেসব টেকনিক জীবনের উইকেটে কাজ করে খুব কমই। 

জীবন কঠিন, বড্ড কঠিন। মাঝেমধ্যে এটা লিমিটেড ওভারের গেম হয়ে যায়, টি-২০। সেখানে ভালো বলে ডাক করলে চলে না, ডিফেন্সিভ ব্যাটিংটা সেখানে আত্মঘাতি। ঝুঁকি নিয়ে মেরে খেলতে হয়, রান না পেলে উইকেট বিলিয়ে আসতে হয়। 'কেন' নামের প্রশ্নটার জবাব হয়তো মিলে যাবে কখনও, কিংবা মিলবে না। তাতে সুশান্ত ফিরে আসবেন না। দিনশেষে রয়ে যাবে শূন্যতা, একটা ফাঁকা জায়গা, যেটা কখনও পূরণ হবার নয়... 

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা