কঙ্গনা রনৌত যখন জোরগলায় বলেন, এটা আত্মহত্যা নয়, পরিকল্পিত খুন- তখন সেটার বিরোধিতা করার মতো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না...

ঠোঁটকাটা হিসেবে কঙ্গনা রনৌতের সুনাম আছে। বলিউডি পরিবারতন্ত্রের বাইরে থেকে উঠে এসেও যারা শীর্ষস্থান ছুঁয়েছেন, সেই গুটিকয়েক মানুষের একজন তিনি, নেপোটিজমের বিরুদ্ধে বরাবরই তিনি স্বোচ্চার, কারো ধার না ধরে মুখে যা আসে বলে ফেলেন সবসময়। একারণে বি-টাউনে তাকে অপছন্দ করে, এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যা নিয়েও মুখ খুলেছেন কঙ্গনা, বলেছেন কড়া কিছু সত্যি কথা, আঙুল তুলেছেন সুশান্তের মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোকের সাগরে ভেসে যাওয়ার অভিনয় করা কিছু তারকার দিকে। যারা কঙ্গনাকে অপছন্দ করেন, তারাও মনে হয় না তার কথাগুলোর সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন।

নোবডি থেকে ইয়ংস্টারদের একজন হয়েছিলেন সুশান্ত। নিভেও গেলেন খুব দ্রুত, বিদায় নিলেন ধুমকেতুর মতোই। বান্দ্রায় নিজ ফ্ল্যাটে পাওয়া গেছে তার ঝুলন্ত লাশ। অর্থ-বিত্ত-খ্যাতি, কোনকিছুর তো অভাব ছিল না। নয়টার মধ্যে ছয়টা সিনেমাই যার ব্যবসাসফল, তিনি কেন এভাবে নিজেকে শেষ করে দেবেন- এটাই সবার প্রশ্ন। কিন্ত বাতির নিচে অন্ধকার অংশটায় আলো ফেলতে চাইছে না কেউই, বরং সুশান্তের প্রতি শোক জানাতে গিয়ে পাশ কাটাতে চাইছে সেসবের কথা। কঙ্গনা আলো ফেলেছেন সেখানেই। 

২০১৩ সালে সিনেমায় অভিষেক, সাত বছরে নয়টা সিনেমায় অভিনয় করেছেন সুশান্ত, এর মধ্যে ছয়টাই বক্স অফিসে সফল। তবুও কেন প্রযোজকদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে পারেননি সুশান্ত? টানা ফ্লপ দেয়ার পরেও স্টারকিডদের হাতে ভুরি ভুরি সিনেমা। অর্জুন কাপুরের কথাই ধরুন, না আছে অভিনয়, না আছে নাচ, না ফ্যানবেজ- তবুও তার হাতে সিনেমা আছে, কারণ তিনি বনী কাপুরের ছেলে। অথচ সবশেষ সিনেমাটা (ছিছোড়ে, ২০১৯) সুপারহিট হবার পরেই সুশান্তের হাতে নতুন কোন প্রজেক্ট ছিল না। বরং জানা যাচ্ছে, বলিউডের প্রভাবশালী প্রযোজনা সংস্থাগুলো তাকে একরকম 'অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ' করে রেখেছিল। সুশান্তের অপরাধ কি ছিল, সেটা কেউ জানেনা। 

দারুণ সব সিনেমায় কাজ করেও প্রযোজকদের প্রিয়পাত্র হতে পারেননি তিনি

কাই পো ছে, ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী বা ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি সিনেমাগুলোতে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন সুশান্ত। মুগ্ধ হবার মতোই পারফরম্যান্স ছিল তার। অথচ বলিউডের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানগুলোতে সুশান্তের ডাক পড়েছে নাচার জন্যে, তার কাজের স্বীকৃতি কেউ দেয়নি। কঙ্গনা প্রশ্ন তুলেছেন এটা নিয়েও। গাল্লি বয়ের মতো সিনেমা তেরোটা বিভাগে পুরস্কার পেয়ে যায়, অথচ ছিছোড়ে কেন একটা পুরস্কারও পায় না? এমন তো নয় যে ছিছোড়ে পুরস্কারের যোগ্য ছিল না। কঙ্গনার ইঙ্গিতটা বলিউডের চিরকালীন নেপোটিজমের বিষবাস্পের দিকেই। 

সুশান্ত যে অবজ্ঞা এবং অবহেলার শিকার হয়েছেন বারবার, সেই ব্যপারটা মোটেও অমূলক নয়। ক্যারিয়ারের শুরুতে যশরাজ ফিল্মজের সঙ্গে চুক্তি ছিল তার, তাদের ব্যানারে শুদ্ধ দেশী রোমান্স এবং পিকে সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন সুশান্ত। সেই সময়ই তার কাছে সঞ্জয় লীলা বানশালির প্রস্তাব এসেছিল, রাম-লীলা সিনেমায় অভিনয়ের। কিন্ত যশরাজ ফিল্মজের প্রধান আদিত্য চোপড়ার আপত্তির কারণে তিনি সেটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। যশরাজের সঙ্গে চুক্তিতে থাকা অবস্থায় অন্য প্রোডাকশন হাউজের সিনেমায় অভিনয় করতে পারে না কেউ- চুক্তিটা এভাবেই করা হয়। 

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই সময় যশরাজের সঙ্গে রনবীর সিংয়েরও চুক্তি ছিল। অথচ আদিত্য চোপড়া রনবীরকে ঠিকই রাম-লীলা করার অনুমতি দিয়েছিলেন! সুশান্তের মন রাখার জন্য আদিত্য তখন বলেছিলেন, বেফিকরে সিনেমায় তাকে কাস্ট করবেন। অথচ সেটাও রনবীর সিংই পেয়েছেন। সুশান্ত পরে বেরিয়ে এসেছেন যশরাজ থেকে, সম্পর্ক খারাপ হয়েছে, কিন্ত পুরো ব্যাপারটায় সুশান্তের দোষ তেমন পাওয়া যায় না। তার সঙ্গে বঞ্চনা করা হয়েছে। 

সুশান্ত সিং রাজপুত, ছিছোড়ে সিনেমায়

বঞ্চনার শিকার সুশান্ত গোটা ক্যারিয়ারজুড়েই হয়েছেন। যখন ভালো কাজ করেছেন, তখন ক্রেডিট গেছে অন্যের খাতায়। যখন ব্যর্থ হয়েছেন, গোটা দায়ভার এসে পড়েছে তার কাঁধে। পিকে তার সিনেমা ছিল না, সেটার সব আলো আমির খান আর রাজকুমার হিরানী নিয়েছেন। ধোনির বায়োপিকে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন, দুইটা বছর অন্য কোন কাজ করেননি পর্দায় নিখুঁত ধোনি হিসেবে নিজেকে প্রেজেন্ট করবেন বলে। অথচ দিনশেষে সেটা ধোনির নামেই বিখ্যাত হয়েছে, সুশান্তের ডেডিকেশনটা কেউ মনে রাখেনি। কেদারনাথে সবটুকু আলোচনা ছিল সারা আলী খানকে নিয়ে, স্টারকিডের অভিষেক বলে কথা! সোনচিড়িয়ার মতো দুর্দান্ত সিনেমাটা বক্স অফিসে ফ্লপ, কারো কারো ভাবিভঙ্গি দেখে মনে হয়েছে, সব দোষ যেন সুশান্তেরই ছিল! অথচ দারুণ অভিনয় করেছিলেন তিনি সেখানে। 

আজ করন জোহর টুইট করছেন, আলিয়া ভাট বলছেন তিনি শোকের সাগরে ভাসছেন। অথচ এই আলিয়া ভাটই কফি উইথ করনে এসে বলেছিলেন। সুশান্ত সইং রাজপুত হু? এই নামে তো আমি কাউকে চিনি না! করন জোহর সুশান্তের মেমোরি রিওয়াউন্ড করছেন আত্মহত্যার খবরটা শুনে। অথচ তার শো তে সুশান্ত কখনও ডাক পাননি, 'ড্রাউভ' সিনেমাটা সুশান্তকে না জানিয়েই তিনি অনলাইনে রিলিজ দিয়েছিলেন। সুশান্ত অভিমান করেছিলেন প্রচণ্ড। তবে ব্যবসার কাছে সেসব অভিমানের দাম ছিল না।

যে ইন্ডিয়ান মিডিয়া এখন সুশান্তের বাবার চোখের জল লাইভ দেখাচ্ছে, তাদের কাছেও সুশান্ত কখনও প্রিয়পাত্র ছিলেন না। কঙ্গনা ধুয়েছেন তাদেরও, বলেছেন- ‘‘কিছু সাংবাদিক আছেন যারা সুশান্তকে নিয়ে উল্টোপাল্টা লিখছেন। বলছেন, সুশান্ত মনরোগী ছিলেন। মদ্যপানে আসক্তি ছিল তাঁর। তিনি বাতিকগ্রস্ত ছিলেন। সঞ্জয় দত্ত নেশা করলে ওরা কিন্তু বেশ আকর্ষণ বোধ করেন। তখন সেটা অপরাধ হয় না। মানে যারা স্টার, যারা স্টারকিড, তারা ইচ্ছেমতো মদ খেতে পারবে, মাতলামি করতে পারবে, বাইরে থেকে আসা কেউ করলেই দোষ?" 

সুশান্তের ভুল হয়তো ছিল। মানুষ মাত্রই ভুল করে। কিন্ত সুশান্তকে তার ভুলগুলো শুধরে নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে কম। একটা ব্যর্থতায় তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। ধোনি'র বায়োপিকে এমন অসাধারণ ইফোর্ট দিয়ে অভিনয় করা তরুণের হাতে যখন কাজ থাকে না, তখন কঙ্গনার অভিযোগগুলোকেই সত্যি মনে হয়। কঙ্গনা যখন জোরগলায় বলেন, এটা আত্মহত্যা নয়, পরিকল্পিত খুন- তখন সেটার বিরোধিতা করার মতো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। বলিউডের গোটা সিস্টেমটাই সুশান্তের মৃত্যুর জন্যে দায়ী বোধহয়, ডিপ্রেশনটা নয়...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা