সুশান্ত সিং রাজপুত, বলিউড ইন্ড্রাস্ট্রির এক সম্ভাবনাময় তরুণ ছিলেন, যিনি কিনা গতমাসে নিজের ঘরে রহস্যজনকভাবে আত্মাহুতি দিয়েছেন। কিন্তু আসল নাটকীয়তা শুরু হল তার মৃত্যুর পর।

আমি অবাক হয়ে দেখলাম সুশান্তের মৃত্যুর পর আমার বোদ্ধা বন্ধুরা প্রথমে সুশান্তের আত্মহত্যা নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠলেন। এরকম ক'দিন যাওয়ার পর দেখি বলিউডের তথাকথিত 'নেপোটিজম' নিয়ে রমরমা পোস্ট পড়ছে দিনরাত। তখন আবার এদিক দিয়ে ইউটিউবেও ঢোকা দায়। ঢুকলেই মনে হয় পুরো দুনিয়া ফেলুদার মতোন গোয়েন্দায় ভর্তি এবং এসব সুচতুর গোয়েন্দারা সুশান্তের মৃত্যুর পর বিভিন্ন খবর ও ছবি থেকে মৃত্যু রহস্য ভেদ করে ফেলেছেন। 

এসব চুলচেরা গোয়েন্দা রিপোর্টের বেশিরভাগেই অপরাধী হিসেবে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে সুরাজ পানচোলি, করণ জোহর এবং বলিউডের তথাকথিত 'ভাই' সালমান খানকে। মজার কথা হল, এসব কন্সপিরেসি থিউরিগুলো এতো সাজানো ও যৌক্তিক মনে হয় যে, আমি নিজে এখনো ঠিক করতে পারিনি যে কোনটা ছেড়ে কোনটায় বিশ্বাস করব, সবগুলোই বিশ্বাস যোগ্য মনে হয়। তবে হ্যাঁ, আমি এও অস্বীকার করছি না যে সুশান্তের মতো একজন প্রতিভাবান অভিনেতা জীবনযুদ্ধে হেরে এভাবে মৃত্যুকে বেছে নিবে তা কষ্টদায়ক।

মিডিয়া ব্যাপকভাবে আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে, বিশেষ করে সিনেমা। আমার মনে হয়, আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এমন কোনো সিনেমা আছে বা এমন কোনো অভিনেতা আছেন, যাদের কাজ আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়। সিনেমা আমাদের ব্যাপকভাবে ম্যানুপুলেট করে এবং দিনশেষে সিনেমা নির্ঘাত 'পলিটিকাল অ্যাক্ট', তাই হয়তো সিনেমার দর্শকদের মাঝে সুশান্তের মৃত্যু নিয়ে রোল ওঠা খুব স্বাভাবিক। 

কিন্তু আমি সাহস করে বলতে চাচ্ছি এই কন্সপিরেসি থিউরির চর্চা স্বাভাবিক হলেও খুব একটা সুস্থ না। আমার এই দুঃসাহসিক স্টেটমেন্ট ভাঙ্গার আগে একটা গল্প বলা যাক...

'ডেভিড রোজেনহেন ও তার সাত সহযোগী মিলে একটা অদ্ভুত পরীক্ষা চালান। তিনি পালা করে বিভিন্ন মানসিক হাসপাতালে গিয়ে বলেন যে তার সিজোফ্রেনিয়ার উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। যদিও এমন কিছুই ছিল না, তিনি কেবল দেখতে চেয়েছিলেন মেন্টাল হেলথ ওয়ার্কাররা কীভাবে একটা ভুল ইনফর্মেশনকে ভিত্তি করে ফলাফলে পৌছায়। সে রোগের কথা বানোয়াটভাবে বললেও এটি ছাড়া সাইকোলজিস্টদের বাকি সব প্রশ্নের উত্তর, বিশেষ করে তার জীবন সম্পর্কে সঠিক জবাব দেন। 

যেমন এখানে দেখুন, রোজেনহেনের এক ভূয়া রোগী ডাক্তারের কাছে বললেন তিনি ছেলেবেলা মায়ের কাছেই মানুষ হয়েছেন, বাবার সাথে অতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু বড় হতে হতে তার বাবার সাথে সম্পর্ক বেশ পাকা হয়ে উঠে, ওদিকে মায়ের দিক থেকে দূরত্ব বেড়ে যায়। পরবর্তীতে তার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক খুবই সুখকর, যদিও হালকা মনমালিন্য মাঝে মাঝেই হয়। সন্তানদের সাথেও সাধারণত খারাপ ব্যবহার করতে হয় না।'

এখন একটু খেয়াল করুন একজন সাইকোলজিস্টের কাছে একজন রোগী ও রোগীর জীবনের ইতিহাস আছে। এখন রোগের যোগসূত্র বের করার জন্য রোগীর জীবনের সাথে রোগের হিসেব মেলানোর চেষ্টা করবেন। অবশ্যই কোনো একটা যৌক্তিক উপায়ে। কিন্তু যখন কোনো রোগ আসলেই নেই, তখন কিন্তু সমস্ত সমাধানটাই হয়ে উঠবে কাল্পনিক। 

যেহেতু সাইকোলজিস্ট জানেন না যে রোগীর রোগটিই আসলে নেই, সেহেতু সাইকোলজিস্ট তার নিজের মস্তিস্ক ব্যবহার করে একটা কাল্পনিক যোগসূত্র তৈরী করেছেন। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হল ভূয়া রোগীর সিজোফ্রেনিয়ার কারণ কী হতে পারে, সে উত্তর দিল, 'রোগী তার জীবনে অনেক ইমোশনাল ট্রমার ভেতর দিয়ে গিয়েছে, তার মায়ের সাথে তার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গিয়েছে এবং সে মনগড়া ধারণা করে নিয়েছে যে তার বাবার সাথে সম্পর্ক খুবই ভাল যাচ্ছে। স্ত্রীর সাথে তার প্রায় বাকবাতন্ডা হয় এবং সন্তানদের সাথে তার সম্পর্ককে তিনি সংজ্ঞায়িত করেছেন 'খারাপ ব্যবহার' কে টেনে এনে। যা প্রমাণ করে তার পারিবারিক জীবন অসুখী এবং এইসব আপনজনদের কাছ থেকে পাওয়া রিজেকসনের কারণেই তার সিজোফ্রেনিয়া হয়েছে।' 
 
এরকম বহু পরীক্ষা হয়েছে। আরেকটি উদাহরণ দেয়া যাক। 

একদল ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টকে বলা হলো, আপনাদের একে একে একটা বদ্ধ রুমে ত্রিশ মিনিট করে কাটাতে হবে এবং কোনো ধরনের এক্টিভিটি চালিয়ে যেতে হবে। যেমন- হাঁটা অথবা নাচা অথবা মেঝেতে পা ট্যাপ করা, হতে পারে হাততালি দেয়া... এবং আপনাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করে আমরা রুমে মিউজিক বাজাবো, ত্রিশ মিনিটের মাঝে আপনাদের সেই মিউজিক চালু ও বন্ধ হওয়ার প্যাটার্ন খুঁজে বের করে একটা কাগজে সেটা লিখে আনতে হবে।'

পরীক্ষা শেষে সবাই নিজ নিজ প্যাটার্ন নিয়ে বেড়িয়ে আসলো। যেমন, হাতে দুবার তালি দিলে মিউজিক বাজে বা পাঁচবার লাফিয়ে দু বার পা ট্যাপ করলে মিউজিক বাজে। এরকম ফলাফলগুলোই বর্ণনা করলেন ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে মিউজিক বাজানো হয়েছে একদম রেন্ডম ভাবে। এমনকি প্যাটার্ন যেন না আসে তাই একেকবার মিউজিক বাজিয়েছেন একেকজন। কিন্তু তবুও ছাত্রছাত্রীরা প্যাটার্ন খুঁজে পেয়েছিল, কেন? কারণ তারা ভেবেছিল প্যাটার্ন আছে। এবং তাই তারা নিজের মতোন করে ব্যাপারটা কল্পনা করে নিয়েছিলেন। 

এখানে আপনারা আইরোনি ধরতে পারছেন? এই সম্পূর্ন ব্যাপারটি হচ্ছে ইলুউজারি কোরিলেশন। আমরা আমাদের ইন্দ্রীয় দিয়ে সারাদিন যা কিছু উপভোগ করি, তার সবকিছুই আমাদের মস্তিস্কে ট্রান্সফার হয়। যদিও এর সবকিছু আমাদের মেমরিতে থাকে না, কিন্তু আমাদের অচেতন মনের স্টোরেজে অবশ্যই জমা থাকে এবং আমাদের মস্তিস্ক আমাদের অবচেতনে সেসবের অনেককিছু প্রসেস করে এবং একসময় তাই ইন্টিউশন হিসেবে আবার আমাদের সামনে হাজির হয়। এবং আমরা প্রাত্যহিক জীবনে এমন অনেক কিছুই দেখতে পাই যার আদতে বাস্তবের সাথে কোনো যোগসূত্রই নেই। 

যেমন ধরুন, দুমাস আগের একরাতে আমার দাদা মারা যান, সেই দুপুর বেলা আমার টবের সব পুদিনা পাতা শুকিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে আমার দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয় যে এটা উপড় ওয়ালার কাছ থেকে মৃত্যুর আগমনের ব্যাপারে একটা সংকেত ছিল। আরও বছর তিনেক আগে আমার এক কাছের বন্ধু আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। যদিও সে এখনো বেঁচে আছে। সে এই গণ্ডগোল বাধানোর আগে আমার বাসায় আসে এবং এরপর যখন আমি আবিষ্কার করি যে সে দশটা প্যারাসিটামল গিলে ফেলেছে তখন আমার কাছে মনে হয় ওর ওইদিনের ব্যবহারে অনেক অসংলগ্নতা ছিল। আমি চাইলেই বের করতে পারতাম যে সে এরকম কিছু একটা করতে পারে। তখন আমার নিজেকে বিরাট লুজার মনে হচ্ছিল। 

আসলে দুটো ক্ষেত্রেই আমি ভুল ছিলাম। আমার মস্তিস্ক কয়েকটি রেন্ডম ঘটনার মাঝে কাল্পনিক যোগসূত্র স্থাপন করেছিল এবং আমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিল যে, আমি এতোটাই বিজ্ঞ যে আমি এদের মাঝে যোগসাজশ খুঁজে পেয়েছি। এরকম হয়, আমাদের সবার সাথেই হয়। 

এবার ফিরে যাওয়া যাক সুশান্তের গল্পে। খুব রিসেন্ট সময়ে সুশান্তের হাত থেকে কিছু সিনেমা বেড়িয়ে যায়। তার আগে সুরাজ পানচোলির সাথে তার বাকবিতণ্ডা হয় এবং সেই সুরাজের গডফাদার হিসেবে খ্যাত আমাদের সালমান খান। এই ব্যাপারগুলোকে একসুতায় নিয়ে এসে সুশান্তের ভক্তরা দাবী করছেন, সুশান্তের ক্যারিয়ারের এই বিপর্যয়ের পেছনে প্রচ্ছন্নভাবে দায়ী হলেন সালমান। তিনি কলকাঠি নাড়িয়েছেন পেছনে থেকে। তাছাড়া এর আগে ঘটে যাওয়া এ প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন ইস্যু দিয়েও এর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। 

মৃত সুশান্তের লাশে গলার দাগ নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। অনেকে শক্ত দাবি নিয়ে বলছেন, 'ফাঁসির গিটের দাগ এমন হতেই পারে না, এটা আসলে বেল্ট দিয়ে ধস্তাধস্তি করে ফাঁস দেয়ার চিহ্ন'। আমার প্রশ্ন হলো, এর কতোটুকু আসলে সত্যি? সত্যি হোক বা না হোক, আজকের এই স্যোস্যাল মিডিয়ার যুগে সব ব্যাপারেই সবার কোনো না কোনো মতামত থাকে। নিজের মতামত যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করেন অনেকেই, কিন্তু তাতেই কিছু ঠিক বা ভুল কিংবা সত্য অথবা মিথ্যা নির্ধারিত হয়ে যায় না।

আসলে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যে ভুল, তা আমরা মেনে নিতে চাই না। আমরা মনে করি মস্তিস্ক সবসময় ঠিকঠাক হিসেব করে। আসলে না, মস্তিস্ক প্রায়সই আমাদের ধোঁকা দেয়। আর সেটাই আমাদের কন্সপিরেসি থিউরির ব্যর্থতা। এবং এমনটাও হতে পারে, ইলিউজারি কোরিলেশন নিয়ে আমার এ দর্শনও ভুল। কিন্তু তাতে কিছুই আসে যায় না। 

কেননা এ জগতে বসবাসের যে সংক্ষিপ্ত সময় আমরা পাই, তার বেশিরভাগই আমাদের সবার ভুলে ভরা। এবং আমি স্বজ্ঞানে তা স্বীকার করে নিচ্ছি এবং হ্যাঁ, আমি সুশান্ত সিং রাজপুতের একজন ভক্ত ছিলাম। ছিলাম বলছি এ কারণে যে আত্মহত্যার পর সে কোনোভাবেই আর আমার হিরো নেই। 

পুরো লেখায় আমি তার জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে ভারী আলোচনা এড়িয়ে গেছি। কেননা একজন হেরে যাওয়া মানুষের বর্ণিল জীবন যেচে সবার সামনে তুলে ধরলে অনেকে হেরে যেতেও ইচ্ছুক হতে পারে। ফাগুনের পঞ্চমীর চাঁদ উঠলে যেন আর কারও মরে যেতে ইচ্ছে না হয়। জীবনকে ভালবাসতে শিখুক সবাই...

-

* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে

আরও পড়ুন-


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা