দক্ষিণ কোরিয়ায় এমন ভীতিকর ভর্তি পরীক্ষা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
দক্ষিণ কোরিয়ার এই ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি আপনাকে চমকে দেবেই! এখানে পরীক্ষার জন্য বন্ধ রাখা হয় বিমান চলাচল! ৯ ঘণ্টার এই ম্যারাথন পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের জন্য প্রার্থনা করা হয় দেশজুড়ে!
একজন একজন করে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটছে পরীক্ষার্থী ছেলে-মেয়েরা, তাদের গন্তব্য পরীক্ষা কেন্দ্র। রাস্তার দুপাশে সারিবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে শত শত কিশোর-কিশোরী। এরাও ছাত্র-ছাত্রী, তবে পরীক্ষার্থী নয়৷ ওরা এসেছে পরীক্ষার্থীদের সাহস যোগাতে, তাদের উৎসাহ দিতে। উদ্দীপনামূলক গান গাইছে সবাই কোরাসে, তাদের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ড আর ব্যানারে লেখা আছে অনুপ্রেরণামূলক বাক্য। আছেন স্বেচ্ছাসেবীরাও, পানি কিংবা ফার্স্ট এইড মেডিকেল সার্ভিস নিয়ে তৎপর তারাও, কারো কোন দরকার হলেই ছুটে আসছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। রাস্তায় গাড়িঘোড়া কম, এই সময়টায় কেউ বের হয়নি তেমন, যাতে পরীক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে যেতে পারে। তবে প্রচুর পুলিশের গাড়ি আর মোটর সাইকেল টহল দিচ্ছে রাস্তায়, কারো যাতায়াতে কোন অসুবিধা হলেই পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিচ্ছে তারা।
ভাবছেন, কি এমন পরীক্ষা রে বাবা! কোন দেশে হয় এমন কাণ্ডকীর্তি? ঘটনাটা দক্ষিণ কোরিয়ার। প্রতি বছরের নভেম্বর মাসে সেখানে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। কলেজ এন্ট্রান্স এক্সাম নামেও ডাকা হয় এটাকে। স্থানীয়ভাবে এই ভর্তি পরীক্ষাকে ডাকা হয় 'সুনেয়াং' নামে। কোরিয়ার সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করে সেই পরীক্ষায়৷ মেরিট লিস্ট অনুসারে ভর্তির সুযোগ পায় পরীক্ষায় অংশ নেয়া ছাত্র-ছাত্রীরা।
এমনিতে দক্ষিণ কোরিয়ার জীবনযাত্রা উন্নত হলেও, সেখানে ক্যারিয়ার গড়ার বেলায় প্রতিযোগীতাটা খুব বেশি। আর সেই প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে হলে ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে পড়ার সুযোগ পাওয়াটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ সেজন্যেই প্রতি বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করার গুরুত্বটাও অনেক বেশি। ছাত্রছাত্রীরা প্রায় বছরখানেক ধরে প্রস্তুতি নেয় এই পরীক্ষায় বসার জন্যে। 'সুনেয়াং' লিখে গুগল করলেই বুঝতে পারবেন, কি এক মহাযজ্ঞ এটা৷ পাঁচ বিষয়ে একটানা নয় ঘন্টা ধরে পরীক্ষা দিতে হয় ভর্তিচ্ছু ছাত্র-ছাত্রীদের। আছে স্পিকিং এবং লিসেনিং টেস্টও।
পরীক্ষার এই দিনটা পুরো দক্ষিণ কোরিয়াতেই একটু অন্যরকম গুরুত্ব পায়৷ রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি খুব কম দেখা যায়, বাড়িয়ে দেয়া হয় গণপরিবহনের পরিমাণ৷ একটাই কারণ, যানজটের সৃষ্টি যাতে না হয়। প্রতিটা পরীক্ষার্থী যাতে কোনরকমের সমস্যা ছাড়াই পরীক্ষার হলে যেতে পারে, এবং নির্বিঘ্নে লম্বা সময় ধরে পরীক্ষা দিতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে শুধু সরকার নয়, পুরো দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষই এগিয়ে আসে৷ সিউলের স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে শুরু করে ব্যাংক কিংবা অফিস-আদালত, সব জায়গাতেই এই দিন কাজকর্ম শুরু হয় একঘন্টা দেরীতে, যাতে এর আগেই পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে ঢুকে যেতে পারে।
শুধু তা-ই নয়, এই পরীক্ষায় লিসেনিং টেস্টের একটা অংশ আছে, সেটা নির্ধারিত একটা সময়ে সব কেন্দ্রে একসঙ্গে শুরু এবং শেষ হয়৷ আধঘন্টা ব্যপ্তিকালের এই লিসেনিং টেস্ট চলাকালে পুরো দক্ষিণ কোরিয়াতে বিমানের উড্ডয়ন এবং অবতরণ বন্ধ রাখা হয়, যাতে পরীক্ষার্থীদের মনোসংযোগে কোন ব্যাঘাত না ঘটে। পুরো পরীক্ষা পদ্ধতিটে দেখভাল করা হয় সরকারের তরফ থেকে, প্রশ্নপত্র তৈরি করা থেকে সেগুলো কেন্দ্রে কেন্দ্রে বিলি-বন্টন এবং পরীক্ষা শেষে খাতা যাচাই বাছাই- সবকিছুই করা হয় দারুণ সুচারূভাবে।
প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্যে সরকার আলাদা কমিটি গঠন করে দেয়, সেই কমিটির সদস্যদের পরিচয়ও গোপন রাখা হয়। দুটো দলে ভাগ করা হয় তাদের, একদল প্রশ্ন তৈরি করেন, অন্য দলটা সেই প্রশ্নগুলোতে কোন খুঁত আছে কিনা৷ সেটা পরীক্ষা করে দেখেন, এবং চূড়ান্ত মতামত দেন৷ ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ, ম্যাথমেটিক্স, ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ, কোরিয়ান হিস্ট্রি- এই চারটি বিষয়কেই মূল ধরা হয়। এগুলোরও আবার অনেকগুলো শাখা-উপশাখা আছে। পঞ্চম বিষয় হিসেবে সোশ্যাল স্টাডি, সায়েন্স, ভোকেশনাল স্টাডি বা ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজের মতো বিষয়গুলোর মধ্যে থেকে একটি পছন্দ করতে পারে পরীক্ষার্থীরা৷ প্রশ্ন তৈরি আর যাচাই বাছাইয়ের সঙ্গে প্রায় সাতশো মানুষ জড়িত থাকে। এদের সবাইকে প্রতিদিনের জন্যে গড়ে ৩০০ ডলার করে বেতন দেয়া হয় সরকারের তরফ থেকে।
মোবাইল, ব্যাগ, খবরের কাগজ বা কোন খাবার নিয়ে কাউকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। পরীক্ষার হলেই বিরতিতে খাবার সরবরাহ করা হয়। লিসেনিং টেস্টের প্রশ্ন শোনানো হয় জাতীয় রেডিওতে। ছাত্র-ছাত্রীরা যখন পরীক্ষার কেন্দ্রে লড়াই করছে, তখন তাদের বাবা-মায়েরাও বসে থাকেন না৷ তারা ছোটেন প্যাগোডা, মন্দির বা যার যার ধর্মীয় উপাসনালয়ে। এই এক ব্যাপারে বোধহয় বিশ্বের বেশিভাগ বাবা-মা'ই একরকম, সেটা বাংলাদেশ হোক, কোরিয়া হোক, কিংবা উগাণ্ডা৷ সন্তানের মঙ্গলের জন্যে স্রষ্টার পদতলে মাথা ঠেকাতে তাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। আর দক্ষিণ কোরিয়ায় এই পরীক্ষাটাই মোটামুটি ক্যারিয়ারের গন্তব্য ঠিক করে দেয়, তাই এই সুনেয়াং এর গুরুত্ব সেখানে অন্যরকম। তবে অভিযোগ আছে, এই পরীক্ষায় খারাপ ফল করে বা পরীক্ষার মানসিক চাপ সইতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যাও করে।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়ার সৌভাগ্য, কিংবা দুর্ভাগ্য আমার হয়েছে৷ অদ্ভুত একটা সিস্টেম আসলে আমাদের দেশে৷ সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে দেশের প্রায় সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়৷ প্রায় কাছাকাছি সময়েই তারিখ পড়ে সবগুলোর৷ আজ ঢাকা, কাল রাজশাহী৷ পরের সপ্তাহে খুলনা, একদিন বাদেই আবার চট্টগ্রামে দৌড়াতে হয় পরীক্ষা দেয়ার জন্যে। দৌড়াতে দৌড়াতে ঠিকঠাক প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগটাই পাওয়া যায় না৷ দেখা গেল শুক্রবারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা, শনিবারেই আবার পরীক্ষা হবে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে। মেশিনের মতো ছোটা ছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের আর কিছুই করার থাকে না৷ সময়, এনার্জী আর টাকা পয়সার যে কত অপচয় হয় এতে, সেটা ভুক্তভোগীরাই বোঝেন, বোঝেন না আমাদের দেশের শিক্ষিত মানুষেরা।
ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এবং আরও কয়েকজন শিক্ষাবিদ মিলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার একটা রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন কয়েক বছর আগে। সেখানে পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে স্পষ্ট করে বলা ছিল, যে ছেলে বা মেয়ের বাড়ি খুলনায় বা বরিশালে, তাকে পরীক্ষা দেয়ার জন্যে ঢাকা-চট্টগ্রামে এসে দৌড়াতে হবে না৷ নিজের শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কেন্দ্রে বসেই সে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে৷ সারা দেশের প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে একটা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার প্রচলনও করতে চেয়েছিলেন তারা৷ পর্যায়ক্রমে সেখানে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালগুলোকেও যোগ করা হতো, বা তাদের জন্যে আলাদা কোন ফরম্যাট প্রণয়ন করা হতো। কিন্ত কে শোনে কার কথা! এদেশে ভালো কথার ভাত আছে নাকি? সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিলে ভর্তি বাণিজ্য হবে কি করে?
উন্নত দেশগুলোর এত চমৎকার সিস্টেমগুলো আমরা শুধু দেখেই যাবো, সেগুলো আমাদের কাছে কল্পকাহিনীর মতোই মনে হবে। অথচ সামর্থ্য থাকা স্বত্বেও আমরা নিজেদের ঘরে, নিজেদের দেশে সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করবো না, যারা বাস্তবায়নের কথা বলবে, তাদের কথাকে ফুঁ মেরে উড়িয়ে দেবো। এমন করেই তো চলছে সব৷ হয়তো এভাবেই চলবে আজীবন...