২২০ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে যে ঝড়টা সুন্দরবনের ওপর আছড়ে পড়েছে, সেই ঝড় সুন্দরবনের কারণে গতিবেগ হারিয়েছে। কলকাতার সামনে ঢাল হয়ে কেউ ছিল না, ঢাকার সামনে সুন্দরবন ছিল, তাই বেঁচে গেছি আমরা...

ঘুর্ণিঝড় আম্পানের আচমকা থাবায় পুরো পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা ভয়াবহ, কলকাতার বাইরে বরং আরও বেশিই খারাপ। ৭৫ জনের বেশি মানুষ নিহত, আহত কয়েকশো। বাংলাদেশে সাতক্ষীরা জেলা খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আম্পানের কারণে মৃত্যু হয়েছে দশজনের। প্রচণ্ড গতিবেগ নিয়ে যে সাইক্লোনটা এগিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের দিকে, শেষ মুহূর্তে দিক সামান্য পাল্টে সেটার মূল অংশটা আছড়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের ওপর। তাতে বড়সড় ক্ষয়ক্ষতি থেকে বেঁচে গিয়েছে বাংলাদেশ। অন্তত শ'খানেক প্রাণ যেতেই পারতো, হাজারো মানুষ বাড়িঘর হারাতো। আরও একটা জিনিস বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, সেটার নাম সুন্দরবন। 

শ্বেতা সাহা কলকাতার বাসিন্দা। তৃণমূলের রাজনীতি করেন। আম্পানের ভয়াল থাবায় তার শহরটা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। রাতে ঝড় মাথায় নিয়ে ঘুমিয়েছেন, সকালে উঠে দেখেছেন, কোন এক দৈত্য এসে বুঝি পুরো কলকাতাকে পায়ের নিচে পিষে ফেলেছে! ফেসবুকে আক্ষেপ করে তিনি লিখেছেন, "আমাদের (ভারতের) সুন্দরবনের আয়তন যদি বাংলাদেশের সুন্দরবনের মতো বিশাল হতো, আজ এত ক্ষতি হতো না হয়তো!" 

ভদ্রমহিলার আক্ষেপের জায়গাটা খেয়াল করুন। মানচিত্রের দিকে তাকালে আপনারাও বুঝতে পারবেন। আম্পান যে পথে এগিয়ে এসেছে, কলকাতার সামনে বাধা হিসেবে তেমন কিছুই পায়নি সে। উত্তর-দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার মতো জেলাগুলোর সামনেও ঢাল হিসেবে ছিল না কিছুই। কাজেই খড়কুটোর মতো উড়ে গেছে এসব জায়গা, ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে সব। আম্পানের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি কলকাতা শহরের একটা কোণাও। গাছ উপড়ে পড়েছে, ডাল ভেঙ্গে পড়েছে বাস-কারের ওপর, বাড়িঘড় ধ্বসেছে, মানুষ মরেছে, জমে থাকা জল এখনও সরেনি অনেক জায়গা থেকে। 

আম্পানের থাবায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে কলকাতা

অথচ সেই তুলনায় বলার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বাংলাদেশে। কারণ আমাদের সামনে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে জেগেছিল সুন্দরবন। বরাবরের মতো বুক পেতে দিয়ে সে বাঁচিয়েছে আমাদের। উপকূলীয় জেলা হওয়ায় সাতক্ষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্ত সুন্দরবনের কারণে বেঁচে গেছে বাকী অঞ্চল, বেঁচে গেছে রাজধানী ঢাকাও। উপকূল থেকে অনেকটা দূরের কলকাতার ওপরে যে নির্মম বিভীষিকা আম্পান চালিয়েছে, সেটা তো ঢাকাতেও আসতে পারতো, তাহলে ঢাকার অবস্থাটা কি হতো, ভাবুন তো একবার! কতগুলো মানুষ মারা যেতো? কয়দিন পানি-বিদ্যুৎ-ইন্টারনেট ছাড়া কাটাতে হতো ঢাকার বাসিন্দাদের? 

ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঢাকায় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৭২ কিলোমিটার, আর কলকাতায় ছিল ১১২ কিলোমিটার। কলকাতার সামনে সুন্দরবন ছিল না, ঢাকার সামনে ছিল। ২২০ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে যে ঝড় সুন্দরবনের ওপর আছড়ে পড়েছে, সেই ঝড় সুন্দরবন থেকে বের হতে হতে গতিবেগ কমে হয়ে গেছে ১৫১ কিলোমিটার। তাই আবহাওয়াবিদরা নিশ্চিত হয়েই বলছেন, সুন্দরবন না থাকলে ঢাকাতেই ১০০ কিলোমিটারের বেশি গতি নিয়ে ঝড়টি চলে আসত। আর তাতে যে লঙ্কাকাণ্ডটা বেঁধে যেতো, সেটা ঢাকার মানুষ কখনও দেখেননি। 

সুন্দরবন নিজে আঘাত সয়েছে, নির্ভীক যোদ্ধার মতো সামনে দাঁড়িয়ে লড়েছে, বুক পেতে দিয়েছে ঝড়ের তাণ্ডবের সামনে। মানুষের জীবন বেঁচেছে, ঘরবাড়ি রক্ষা পেয়েছে, কিন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুন্দরবন নিজে। বন বিভাগের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার মতো এবারও সুন্দরবনের মিষ্টি পানির উৎস ৬৫টি পুকুর, বন বিভাগের ১৮টি টিনের তৈরি ফাঁড়ি, ২৮টি জেটিসহ অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। বমের ভেতরে কেওড়াসহ বিভিন্ন গাছও ভেঙে পড়েছে। সুন্দরবনের সাতক্ষীরা ও খুলনা এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। 

এবারই প্রথম নয়, এর আগেও অজস্রবার এভাবে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে সুন্দরবন, বাঁচিয়েছে বাংলার মানুষের জীবন, সম্পদ। ১৯৮৮ ও ১৯৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৯ সালে আইলা, ২০১৬ সালে রোয়ানু, ২০১৮ সালে বুলবুল ও ২০১৯ সালের ফণী এবং এবার আম্পানের গতি থমকে দিয়েছে সুন্দরবন। সব মিলিয়ে গত তিন যুগেই আটবার নড় ধরণের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে আমাদের বাঁচিয়েছে সুন্দরবন। অথচ সেই ঋণ শোধের পরিবর্তে আমরা সুন্দরবনকে গলা টিপে মেরে ফেলার মিশনে নেমেছি। 

সুন্দবনের সীমানা থেকে সামান্য দূরে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর মতো আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা, বিরোধিতা স্বত্বেও সেই প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে। সুন্দবনের ভেতরে শ্যালা নদীতে তেলবোঝাই কার্গো ডুবিয়ে পরিবেশের বারোটা বাজিয়েছি, বন উজাড় করে চিংড়ি ঘের বানিয়ে বন ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে বছরের পর বছর ধরে। সুন্দরবন উজাড় হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, এই বনের কথা আমাদের মনে পড়ে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে, বিপদ কেটে যাওয়ার পর আমরা আবার ভুলে যাই তার অবদান। 

আমাদের এই উদাসীনতা আর দখলদারী মানসিকতার বলি হয়ে একদিন সুন্দরবন হয়তো ধ্বংস হয়ে যাবে পুরোপুরি। সেদিন এরকম কোন আইলা বা আম্পানের হাত থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র বা চিংড়ি ঘেরগুলো আমাদের রক্ষা করবে না। এই সহজ সত্যিটা আমরা বুঝতে চাইছি না। যেদিন বোঝার শক্তি হবে, সেদিন হয়তো করার কিছুই থাকবে না...

ফিচার্ড ইমেজ কৃতজ্ঞতা- মাসুদ আল মামুুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা